এথেন্স অলিম্পিকের আসল বিজয়ী!

২০০৪ অলিম্পিক

উৎপল শুভ্র

২০ জুলাই ২০২১

এথেন্স অলিম্পিকের আসল বিজয়ী!

অলিম্পিকের মশালটা জিয়ান্নার হাতেই সবচেয়ে ভালো মানাত। তাঁর কারণেই তো গ্রিসে অলিম্পিক ফিরেছিল। ছবি: জিয়ান্না অ্যাঞ্জেলোপোলস

অলিম্পিকের আয়োজন এখন এমনই সোনার ডিম পাড়া হাঁস যে, ইতিহাসের দোহাই আর আবেগ দিয়েই অলিম্পিকের আয়োজক হওয়া যায় না। প্রথম আসরের মতো শতবর্ষের অলিম্পিক তাই এথেন্সে না বসে চলে যায় আটালান্টায়। শতবর্ষীয় অলিম্পিক হারিয়ে গ্রিসের বোধোদয় ঘটে, অলিম্পিক তাই ঘরে ফেরে ১০৮ বছর পরে, একজন জিয়ান্না অ্যাঞ্জেলোপোলসের কারণে।

প্রথম প্রকাশ: ১২ আগস্ট ২০০৪। প্রথম আলো

গত দু-তিন সপ্তাহে যতবার হাসিমুখে দেখা গেছে তাঁকে, আগের চার বছরেও তা দেখা যায়নি। ওই সময়টায় জিয়ান্না অ্যাঞ্জেলোপোলস-ডাসকালাকিকে কেউ হাসতে দেখলে সেটি নাকি রীতিমতো গল্প করার বিষয় হয়ে যেত। উদ্ধত, বদমেজাজি, নিষ্ঠুর... এই বিশেষণগুলো এমনভাবে তার নামের সঙ্গে জড়িয়ে গিয়েছিল যে, এখন হাসিমুখের অ্যাঞ্জেলোপোলসকে দেখেও অনেকের তা বিশ্বাস হতে চাইছে না।

কারও কাছে গ্রিস সক্রেটিস-প্লেটো-অ্যারিস্টটলের দেশ, কারও কাছে আলেকজান্ডারের, আবার কারও কাছে বা হোমার-সফোক্লিসের। তবে সবকিছুর পর গ্রিস সম্ভবত পুরাণের দেশ। জিয়ান্না অ্যাঞ্জেলোপোলসের কীর্তি যেন সেই গ্রিক পুরাণেরই এক আধুনিক অধ্যায়। আজ সন্ধ্যায় পুরো বিশ্ব যখন এথেন্সের অলিম্পিক স্টেডিয়ামের দিকে তাকিয়ে থাকবে, তখন আরও হাসবেন অ্যাঞ্জেলোপোলস। হাসারই কথা, এটি যে তারই অলিম্পিক! অলিম্পিক ইতিহাসে আর কোনো আয়োজনের পাশে একজন মানুষের ছায়া যে এত বড় হয়ে নেই। 

এথেন্স ২০০৪-কে বলা হচ্ছে অলিম্পিকের ঘরে ফেরা। তবে আরও আট বছর আগেই জন্মভূমিতে ফিরতে পারত অলিম্পিক। অলিম্পিকের জন্মদাতা গ্রিস, শতবার্ষিকী অলিম্পিকটি এখানে হলেই মানাত ভালো। গ্রিসও তা-ই চেয়েছিল, কিন্তু ওই চাওয়া পর্যন্তই। অলিম্পিক আয়োজক হওয়ার লড়াইটা এখন এমন যুদ্ধংদেহি রূপ নেয় যে, শুধু ইতিহাসের দোহাই আর আবেগ দিয়ে তাতে জয়ী হওয়া যায় না। গ্রিস সেটাই হতে চেয়েছিল এবং হতে পারেনি। শতবার্ষিকী অলিম্পিক চলে যায় আটলান্টায়। দায়টা নিজেদের কাঁধেই নিতে চান অ্যাঞ্জেলোপোলস, ‘আমাদের কিছু লোক এমন উদ্ধত আর নিশ্চিত হয়ে বসেছিল যে, অলিম্পিকের জন্মস্থানেই শতবার্ষিকী অলিম্পিক হওয়া উচিত—এ দাবি জানিয়েই চুপচাপ বসে ছিল, আর কিছুই করেনি।’

শতবার্ষিকী অলিম্পিক হারিয়ে ফেলার পর গ্রিসের বোধোদয় হয়। ২০০৪ অলিম্পিকের আয়োজক হতে কোমর বেঁধে নামে তারা। তারই অংশ হিসেবে সে সময়কার গ্রিক প্রধানমন্ত্রী জিয়ান্না অ্যাঞ্জেলোপোলসকে নিজের অফিসে ডেকে তাঁর হাতে তুলে দেন ২০০৪ অলিম্পিক গ্রিসে আনার দায়িত্বভার। অলিম্পিক ইতিহাস কোনো বিডিং কমিটির প্রধান হিসেবে একজন মহিলাকে দেখল সেই প্রথম। 

কিন্তু জিয়ান্না অ্যাঞ্জেলোপোলস কেন? পেশায় উকিল, আশির দশকের শেষ দিকে কিছুদিনের রাজনীতিক-জীবন (সংসদ সদস্য পর্যন্ত যেতে পেরেছিলেন) শেষে লন্ডন প্রবাসী... এই পরিচয় আর যা-ই হোক, অলিম্পিক বিডিং কমিটির প্রধান হওয়ার জন্য যথেষ্ট উজ্জ্বল বায়োডাটা নয়। 

সবচেয়ে জনপ্রিয় এবং মোটামুটি সর্বজনগৃহীত তত্ত্বটা হলো, স্বামীর ভাগ্যেই অ্যাঞ্জেলোপোলসের এই প্রাপ্তি। জাহাজ বহর আর বেশ কটি তেল কোম্পানির মালিক থিওডোর অ্যাঞ্জেলোপোলস গ্রিসের সবচেয়ে ধনাঢ্যদের একজন। এতই ধনী যে, তাঁর কত টাকা আছে, তা নিয়ে গল্পগাথা রচিত হয়। ব্যক্তিগত বিমান আছে, এথেন্সের ফ্লেইভস মেরিনাতে আলফা-আলফা নামে থিওডোর অ্যাঞ্জেলোপোলসের যে ইয়টটিকে প্রায়ই নোঙর ফেলে থাকতে দেখা যায়, সেটির মূল্য মাত্র ২৭৫ কোটি টাকা! অলিম্পিক বিডিংয়ে টাকা-পয়সার এমন শ্রাদ্ধ হয় যে, গ্রিক সরকার এমন একজনকেই যুক্ত করতে চাইছিল এর সঙ্গে। থিওডোর অ্যাঞ্জেলোপোলস দেশের জন্য তাঁর বিপুল বৈভবের খানিকটা খরচ করতে রাজিও হলেন। তবে শর্ত থাকল একটাই, নেপথ্যে থাকবেন তিনি। কারণটা মজার, মিডিয়া-ভীতি। স্ত্রী আবার স্বামীর বিপরীত, স্পটলাইট বড় পছন্দ তাঁর। অলিম্পিককে জন্মভূমিতে ফিরিয়ে আনার দায়িত্ব নিলেন জিয়ান্না অ্যাঞ্জেলোপোলস এবং সফলও হলেন। সমস্যাটা হলো এরপর, রাজনীতিবিদরা এই গৌরবের আলোয় আলোকিত হওয়ার জন্য এমন প্রতিযোগিতায় নামলেন, জিয়ান্না অ্যাঞ্জেলোপোলসের কৃতিত্বটা প্রায় মুছেই গেল তাতে। ক্ষুব্ধ-তিতিবিরক্ত অ্যাঞ্জেলোপোলস ফিরে গেলেন লন্ডনের প্রবাসজীবনে, চেলসিতে অ্যাঞ্জেলোপোলস পরিবারের ৪০ মিলিয়ন ডলারের প্রাসাদোপম বাড়িতে, যে বাড়ির পাশে নাকি বাকিংহাম প্যালেসকেও ম্লান দেখায়।

অলিম্পিকের উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে বক্তব্য রাখছেন জিয়ান্না। ছবি: গেটি ইমেজেস

অ্যাঞ্জেলোপোলস তো গেলেন, কিন্তু সঙ্গে চলে যাওয়ার উপক্রম হলো গ্রিসের অলিম্পিক-স্বপ্নও। অলিম্পিকের বিশাল আয়োজন করতে গিয়ে গ্রিস এমন জগাখিচুড়ি পাকিয়ে বসল যে, ২০০০ অলিম্পিকের সফল আয়োজক সিডনিতে চলে যাওয়ার উপক্রম হয়েছিল ২০০৪ সালের অলিম্পিকও। সেই সময়টায় আইওসির কর্মকর্তারা বারবার এথেন্সে এসেছেন আর প্রতিবারই প্রকাশ করেছেন শঙ্কা, শুনিয়েছেন সতর্কবাণী। অলিম্পিক ইতিহাসে আর কোনো আয়োজন এতটা অনিশ্চয়তার মধ্যে পড়েনি।

দুজন পুরুষ প্রধান নির্বাহীকে দিয়ে চেষ্টা করেও ব্যর্থ হওয়ার পর গ্রিক সরকার বাধ্য হয়ে আবার জিয়ান্নি অ্যাঞ্জেলোপোলসের শরণাপন্ন হয়, অনুনয়-বিনয় করে লন্ডন থেকে ফিরিয়ে আনে তাঁকে। প্রথম মেয়ে হিসেবে অলিম্পিক বিডিং কমিটির প্রধান হয়েছিলেন, অলিম্পিক গেমসের সাংগঠনিক কমিটির প্রথম মেয়ে প্রধান হিসেবেও লেখা হয়ে গেল জিয়ান্না অ্যাঞ্জেলোপোলসের নাম। 

অ্যাঞ্জেলোপোলসের চার বছরের গতিশীল নেতৃত্বে ঘড়ির কাঁটাকে পেছনে ফেলল এথেন্স। যে এথেন্স আইওসির এমন মাথাব্যথার কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছিল, গত কদিন ধরে সেই এথেন্সের প্রশংসাতেই পঞ্চমুখ আইওসির সভাপতি জ্যাক রগ। জিয়ান্না অ্যাঞ্জেলোপোলস হাসবেন না তো কে হাসবেন? গত পরশু অলিম্পিকের মেইন প্রেস সেন্টারের বাইরে সাংবাদিকদের সঙ্গে কথা বলার সময়ও কারণে-অকারণে হাসলেন। হাভানা চুরুটে টান দিয়ে ধোঁয়া ছাড়তে ছাড়তে গল্পও বললেন একটা। গল্পের বিষয়টা ঠিকই অনুমান করেছেন। অলিম্পিকের জন্য এথেন্স সময়মতো প্রস্তুত হতে পারবে কি না, এই অনিশ্চয়তার সময়টা নিয়েই গল্প। 

অলিম্পিক নিয়ে আলোচনা করছে দুই গ্রিক। একজন জিজ্ঞেস করল, ‘আচ্ছা অলিম্পিকের উদ্বোধনী অনুষ্ঠান যেন কবে?’ অন্যজন উত্তর দিল, ‘১৩ আগস্ট।’ শুনে প্রশ্নকারী বিষণ্ন মুখে ‘এত তাড়াতাড়ি’ বলে কিছুক্ষণ চুপ করে থাকার পর জিজ্ঞেস করল, ‘১৩ তারিখ কখন?’ ‘সন্ধ্যায়’। এবার তাঁর মুখে হাসি, ‘ও, তাহলে তো সময় আছে।’

খেলার মাঠে জয়-পরাজয় নিয়েই অলিম্পিক। অ্যাথলেটরাই এখানে ‘হিরো’। তবে জিয়ান্না অ্যাঞ্জেলোপোলসের কীর্তি শোনার পর মনে হওয়া খুবই স্বাভাবিক যে, মাঠে যে-ই জিতুন না কেন, আসল জয়ীকে পেয়ে গেছে এথেন্স অলিম্পিক। এথেন্স ২০০৪ তো জিয়ান্না অ্যাঞ্জেলোপোলসেরই জয়ের গল্প। 

সেই গল্প এখানেই শেষ হচ্ছে, এমন ভাবার কোনো কারণ নেই। অ্যাঞ্জেলোপোলসের অনেক কিছুই আছে, সঙ্গে আছে উচ্চাভিলাষও। গ্রিসে জোর গুঞ্জন, অলিম্পিককে কাজে লাগিয়ে দেশের প্রেসিডেন্ট হওয়াটাই তাঁর পরবর্তী লক্ষ্য। গ্রিসের বর্তমান প্রেসিডেন্টের মেয়াদ শেষ হচ্ছে আগামী বছর, বাংলাদেশের মতো এখানেও প্রেসিডেন্ট আলঙ্কারিক পদ, নির্বাচিত হন সংসদের মাধ্যমে। জিয়ান্না অ্যাঞ্জেলোপোলস সংসদের সমর্থন পাবেন কি না, তা নিয়ে অবশ্য যথেষ্ট সংশয় প্রকাশ করলেন কয়েকজন গ্রিক সাংবাদিক।

প্রেসিডেন্ট হতে চান কি না, সেটি নিশ্চিত নয়। হতে চাইলেও পারবেন কি না, তা-ও নয়। তবে জিয়ান্না অ্যাঞ্জেলোপোলস-ডাসকালাকি নামটি মনে রাখলে ভালো করবেন। ভবিষ্যতে আরও অনেকবার শুনতে হবে এটি।

সম্পর্কিত বিষয়:

শেয়ার করুনঃ
আপনার মন্তব্য
আরও পড়ুন
×