ফেলপস-লোকটির উত্তরাধিকার হাগিনো-চেজ-সেতো

২০১৬ রিও অলিম্পিক

উৎপল শুভ্র

২০ জুলাই ২০২১

ফেলপস-লোকটির উত্তরাধিকার হাগিনো-চেজ-সেতো

রিও অলিম্পিকের ৪০০ মিটার ব্যক্তিগত মিডলে যেন নতুনের আবাহন। ছবি: গেটি ইমেজেস

৪০০ মিটার ব্যক্তিগত মিডলেতে এক সময় সেরা ৭টি টাইমিংয়ের ৬টিই ছিল ফেলপস কিংবা লোকটির দখলে। রিও অলিম্পিকে তাঁদের দুজনের একজনও ছিলেন না পুলে, মঞ্চটা তাই হয়ে গিয়েছিল নতুনদের। হাগিনো-চেজ-সেতো ওই সুযোগটাই লুফে নিলেন দু`হাত ভরে৷ লুফে নিলেন হাঙ্গেরির কাতিনকা হসুও। এর আগ পর্যন্ত অলিম্পিক যাঁর কাছে দুর্বোধ্য এক ধাঁধাই হয়ে ছিল।

প্রথম প্রকাশ: ৮ আগস্ট ২০১৬। প্রথম আলো

মাইকেল ফেলপস কোথায়? রায়ান লোকটি?

মিনিট চল্লিশেক আগে শেষ হওয়া ৪০০ মিটার ব্যক্তিগত মিডলের বিজয়মঞ্চে দাঁড়িয়ে তিন তরুণ। বয়সে যিনি সবচেয়ে বড়, তিনি পাঁচ মাস আগে ২২ ছুঁয়েছেন। বয়সে নবীনতম আগামী সপ্তাহে উদযাপন করবেন ২২তম জন্মদিন। 

এঁদের কারও নাম যে ফেলপস বা লোকটি নয়, তা তো বুঝেই ফেলেছেন। হওয়ার কথাও নয়। বিজয়মঞ্চে কেন, পুলেও তাঁরা ছিলেন না। যুক্তরাষ্ট্রের অলিম্পিক ট্রায়ালে তৃতীয় হয়ে বাদ পড়েছেন লন্ডন অলিম্পিকে সোনাজয়ী লোকটি। এর আগের দুটি অলিম্পিকের সোনা যাঁর, সেই ফেলপস ট্রায়ালেই নামেননি।

তারপরও বিজয়মঞ্চে ফেলপস ও লোকটির অনুপস্থিতি বিসদৃশ লাগার কারণ, প্রায় এক দশক এই ইভেন্টটাকে নিজেদের করে নিয়েছিলেন এই দুজন। সর্বকালের সেরা ৭টি টাইমিংয়ের ৬টিই ফেলপস বা লোকটির। লন্ডনে জেতার পর যে দ্বৈরথ সম্পর্কে লোকটি বলেছিলেন, ‘সাঁতারের সর্বকালের সেরা প্রতিদ্বন্দ্বিতা’।

ফেলপস খুব সুন্দর নাম দিয়েছেন ইভেন্টটার—সাঁতারের ডেকাথলন। সার্থক নামকরণ। অ্যাথলেটিকসে ডেকাথলন যেমন অলরাউন্ড সামর্থ্যের চূড়ান্ত পরীক্ষা নেয়, সাঁতারে তেমনি এই ব্যক্তিগত মিডলে। যাতে সবকিছুই পারতে হয়। ১০০ মিটার করে বাটারফ্লাই, ব্যাকস্ট্রোক, ব্রেস্টস্ট্রোক ও ফ্রিস্টাইল। রিওতে যেটি জিতলেন জাপানের কোসুকে হাগিনো। রুপা পেলেন যুক্তরাষ্ট্রের চেজ কালিজ, ব্রোঞ্জ আরেক জাপানি দাইয়া সেতো। ১৯৫৬ মেলবোর্ন অলিম্পিকের পর এই প্রথম সাঁতারের কোনো ইভেন্টে বিজয়মঞ্চে জাপানের দুজন।

ফেলপস আর লোকটির আবির্ভাবের অনেক আগে থেকেই এটি ‘যুক্তরাষ্ট্রের ইভেন্ট’। সেই ১৯৯৬ আটলান্টা অলিম্পিক থেকে টানা পাঁচবার সোনা, আগের ১৩ বারের মধ্যে আটবার।  

অলিম্পিকে এই ইভেন্ট প্রথম শুরু ১৯৬৪ টোকিও অলিম্পিকে। চার বছর পরের অলিম্পিক আবারও সেই টোকিওতে। এখনই বলে দেওয়া যাচ্ছে, দৈবদুর্বিপাকে কেউ ছিটকে না পড়লে টোকিওর ৪০০ মিটার ব্যক্তিগত মিডলে হবে রিওতে পদকজয়ী তিন তরুণের ত্রিমুখী প্রতিদ্বন্দ্বিতায় মুখর। সংবাদ সম্মেলনেও তিনজনের কথায় ঘুরেফিরে এল টোকিও। সেরা সাত টাইমিংয়ে ফেলপস ও লোকটির মাঝখানে ঢুকে পড়া কালিজ বারবারই বললেন, টোকিওই তাঁর আসল টার্গেট। ব্রোঞ্জজয়ী সেতোও বললেন, সামনের চারটা বছর অনেক খাটতে হবে। সেতো আবার এই ইভেন্টে বিশ্ব চ্যাম্পিয়ন। গত বছর কাজানে সেই প্রতিযোগিতায় অবশ্য হাগিনো ছিলেন না। প্রস্তুতি ক্যাম্পে সাইকেল থেকে পড়ে কনুইয়ে লাগা চোট আট সপ্তাহ অনুশীলনই করতে দেয়নি তাঁকে। 

রিওর পুলে নামার আগেই হাগিনো জানতেন, বড় চ্যালেঞ্জটা আসবে তাঁর দুপাশে বসে থাকা দুজনের কাছ থেকে। সেতো আরও এক ধাপ এগিয়ে গিয়ে বললেন, তাঁরা তিনজনই যে বিজয়মঞ্চে দাঁড়াবেন, এটি তাঁর জানাই ছিল। 

ফেলপস-লোকটির প্রসঙ্গ ওঠাটা অবধারিতই ছিল। হাগিনো ওই দুজনের তীব্র প্রতিদ্বন্দ্বিতা দেখতে দেখতেই বড় হয়েছেন। ওঁদের মতোই হতে চান। চেজ তো আরও বেশি। ট্রায়ালে লোকটিকে হারানো তাঁর জীবনের সবচেয়ে বড় পাওয়া। হাগিনোর যেমন ফেলপসকে হারানো। লন্ডন অলিম্পিকে ফেলপস পেছনে ফেলেই তাঁর ব্রোঞ্জ।

জাপানের হাগিনো। ছবি: গেটি ইমেজেস

পুরুষদের ৪০০ মিটার ব্যক্তিগত মিডলে যদি নতুনের আবাহন হয়, মেয়েদের ইভেন্টটা অনেক পুরোনো একজনকে অনেক দিনের পাওনা বুঝিয়ে দিল। হাঙ্গেরির কাতিনকা হসু শর্ট ও লং কোর্স মিলিয়ে ১১টি বিশ্ব শিরোপা জিতেছেন। কিন্তু অলিম্পিকের সঙ্গে তাঁর ছিল আশ্চর্য এক বৈরিতা। আগের তিনটি অলিম্পিকে অংশ নিয়ে সোনা দূরে থাক, কোনো পদকই পাননি। ২৭ বছর বয়সে এসে সেই দুঃখ ঘোচাল অবিশ্বাস্য এক পারফরম্যান্স। সোনা জিতলেন, সেটিও বিশ্ব রেকর্ড গড়ে। এতেও সব বলা হচ্ছে না। আগের রেকর্ড থেকে ২.০৭ সেকেন্ড মুছে দিয়েছেন। শেষ ১০০ মিটারের ফ্রিস্টাইল শুরুর আগে তো এগিয়ে ছিলেন ৫.২৫ সেকেন্ডে। শেষ ৫০ মিটারে একটু ক্লান্তি ভর করায় সেটি কমেছে। তার পরও রুপাজয়ীর ৪ সেকেন্ড আগে শেষ করেছেন, ব্রোঞ্জজয়ীর চেয়ে ৬ সেকেন্ড আগে। 

নিকনেম ‘আয়রন লেডি’। যুক্তরাষ্ট্রের বিশ্ববিদ্যালয়ে মনোবিজ্ঞান নিয়ে পড়াশোনা করেছেন। হাঙ্গেরিস আয়রন লেডি নামে একটি বইও লিখছেন। যেটিতে থাকবে পেশাদার ক্রীড়াবিদের মনোজগতের সন্ধান। হসুর পরিবারটাই পেশাদার ক্রীড়াবিদে ভরা। বাবা ছিলেন পেশাদার বাস্কেটবল খেলোয়াড়, হাঙ্গেরির পক্ষে ২০০টি ম্যাচ খেলেছেন। বড় ভাইয়েরাও অনুসরণ করেছেন বাবার পদাঙ্ক। শুধু হসু নেমে এসেছেন পুলের নীল জলে।

জাদুকরি সুইম স্যুটের কল্যাণে একসময় সাঁতারে বিশ্ব রেকর্ড পরিণত হয়েছিল হাসি-তামাশার বিষয়ে। সেসব নিষিদ্ধ হয়েছে বেশ কিছুদিন। অলিম্পিক সাঁতারের প্রথম দিনেই তিনটি বিশ্ব রেকর্ড তাই বলার মতো ঘটনাই। এর চেয়েও বেশি বলার মতো প্রথম দিনে যুক্তরাষ্ট্রের একটিও সোনা জিততে না-পারা। সাঁতারের চিরন্তন পরাশক্তি, অলিম্পিক সাঁতারের পদক তালিকায় বাকিদের চেয়ে হাজার মাইল এগিয়ে। যা একটু প্রতিদ্বন্দ্বিতা, তা অস্ট্রেলিয়ার সঙ্গে। লন্ডন অলিম্পিকে যেটির মৃত্যু হয়েছে বলেই মনে হয়েছিল। মাত্র একটি সোনা জিতেছিল অস্ট্রেলিয়া, সেটিও রিলেতে। ফ্রেজার-থর্পদের দেশে তা নিয়ে তুমুল তোলপাড়। রিওতে সাঁতারের প্রথম দিনেই অস্ট্রেলিয়াকে নিয়ে তোলপাড় হলো। তবে অন্য অর্থে। দুটি মিডলের সোনা যে জাপান আর হাঙ্গেরি নিয়ে গেছে, তা তো বলাই হলো। প্রথম দিনের বাকি দুটি সোনাই অস্ট্রেলিয়ার।

চীনের সুন ইয়াং রিওতে এসেছিলেন ৪০০, ৮০০ ও ১৫০০ মিটার ফ্রিস্টাইলের অভূতপূর্ব ‘ট্রেবল’ জেতার স্বপ্ন নিয়ে। ৪০০ মিটারে তাঁকে হারিয়ে শুরুতেই সেই স্বপ্নের সলিলসমাধি দিয়ে দিলেন ম্যাক হর্টন। কিছুক্ষণ পর সংবাদ সম্মেলনে যাওয়ার অপেক্ষায় মিক্সড জোনে টেলিভিশনের সামনে দাঁড়িয়ে হর্টন গলা ফাটালেন অস্ট্রেলিয়ান মেয়েদের জন্য।

মেয়েদের ৪x১০০ মিটার ফ্রিস্টাইল রিলেকে বলতে পারেন সাঁতারপুলে যুক্তরাষ্ট্র বনাম অস্ট্রেলিয়া প্রতিদ্বন্দ্বিতার একটা প্রতীক। গত কিছুদিন অবশ্য অস্ট্রেলিয়ারই আধিপত্য। সেটি ধরে রেখে অস্ট্রেলিয়ান মেয়েরাই জিতল। সেটিও নতুন বিশ্ব রেকর্ড গড়ে। অস্ট্রেলিয়ার এই দলে আবার আছেন দুই বোন—কেট ক্যাম্পবেল ও ব্রন্টি ক্যাম্পবেল।

কম দূরত্বের ফ্রিস্টাইলে এই দুই বোনই সাম্প্রতিক সময়ের সেরা। ৫০ ও ১০০ মিটার ফ্রিস্টাইলে দুই বছরের ছোট-বড় দুই বোনের লড়াই দেখতে ভুলবেন না যেন।

শেয়ার করুনঃ
আপনার মন্তব্য
আরও পড়ুন
×