হাঁটতে হাঁটতে গলদঘর্ম!

রিও ২০১৬ অলিম্পিকের দিন–রাত

উৎপল শুভ্র

২০ জুলাই ২০২১

হাঁটতে হাঁটতে গলদঘর্ম!

এমনই বিশাল জায়গাজুড়ে ছিল রিও অলিম্পিকের পার্ক। ছবি: অলিম্পিক

বিশ্বকাপ ফুটবল বা ক্রিকেটে যেমন এক শহর থেকে আরেক শহরে চক্করের ওপর থাকতে হয়, অলিম্পিকে সেই সমস্যা নেই। এক শহরেই সব। একবার নেমে পড়লে ফেরার আগে আর এয়ারপোর্টমুখী হওয়ার প্রয়োজন পড়ে না। এটাকে যদি শান্তি বলেন, চরম অশান্তি হয়ে বিদ্যমান এক ভেন্যু থেকে আরেক ভেন্যুর দূরত্ব। আর সেই অলিম্পিক যদি ব্রাজিলে হয়, তাহলে সমস্যাটা আরও গুরুতর রূপ ধারণ করে।

প্রথম প্রকাশ: ৮ আগস্ট ২০১৬। প্রথম আলো

অলিম্পিকে একটা ইভেন্ট আছে ২০ কিলোমিটার হাঁটা। যা দেখতে বড় মজা লাগে। কোমর দুলিয়ে হাঁটা আর দৌড়ানোর মাঝামাঝি একটা কিছু। আসলে হাঁটাই। কারণ নিয়মটা হলো, দুই পা কখনোই শূন্যে উঠতে পারবে না। উঠলেই ডিসকোয়ালিফায়েড।

অলিম্পিকের প্রথম সপ্তাহে সবচেয়ে আকর্ষণ হয়ে থাকে সাঁতার। মূল আকর্ষণ অ্যাথলেটিকসের জন্য বরাদ্দ দ্বিতীয় সপ্তাহটা। তারপরও অ্যাথলেটিকসের ইভেন্ট ২০ কিলোমিটার হাঁটা যে মাথায় ঘুরছে, সেটির কারণ আছে। অলিম্পিক কাভার করতে এলে সাংবাদিকদেরও যে অমন হাঁটার ওপরই থাকতে হয়। টানা ২০ কিলোমিটার হয়তো নয়। তবে দিন শেষে হিসাব করলে দেখা যাবে, খুব একটা কমও হয়নি।

বিশ্বকাপ ফুটবল বা ক্রিকেটে যেমন এক শহর থেকে আরেক শহরে চক্করের ওপর থাকতে হয়, অলিম্পিকে সেই সমস্যা নেই। এক শহরেই সব। একবার নেমে পড়লে ফেরার আগে আর এয়ারপোর্টমুখী হওয়ার প্রয়োজন পড়ে না। এটাকে যদি শান্তি বলেন, চরম অশান্তি হয়ে বিদ্যমান এক ভেন্যু থেকে আরেক ভেন্যুর দূরত্ব। আর সেই অলিম্পিক যদি ব্রাজিলে হয়, তাহলে সমস্যাটা আরও গুরুতর রূপ ধারণ করে।

এবার অলিম্পিকে আসার আগে বন্ধুবান্ধব অনেকেই বলেছেন, বিশ্বকাপ ফুটবলের কল্যাণে রিও তো চেনা শহর। ওখানে কোনো সমস্যা হবে না। আমি শুনে হেসেছি। আর মনে মনে বলেছি, যেন মাঝের দুই বছরে ব্রাজিলিয়ানরা সবাই ইংরেজিতে কোর্স-টোর্স করে ফেলেছে! 

তা আম-ব্রাজিলিয়ানরা ইংরেজি না জানুক, স্বেচ্ছাসেবকেরা তো জানবেন। অলিম্পিকে অনেক যাচাই-বাছাই করে স্বেচ্ছাসেবক নেওয়া হয়। ইংরেজি জানাটাও একটা আবশ্যকীয় শর্ত বলে জানতাম। একদমই ভুল জানতাম। গত দুই দিনে যত স্বেচ্ছাসেবকের সঙ্গে দেখা হয়েছে, তাঁদের বেশির ভাগই ইংরেজি জানেন না। যাঁরা জানেন, তাঁদের অ্যাক্রিডিটেশন কার্ডের ওপর আলাদা একটা কাগজে ‘আই স্পিক ইংলিশ’ লিখে দেওয়া হয়েছে। কিন্তু তাঁদের খুঁজে পেতে গলদঘর্ম অবস্থা। কথাটা আক্ষরিক অর্থেই নিতে বলি। পঞ্জিকা অনুযায়ী রিওতে এখন শীতকাল। রাতে তাপমাত্রা কখনো কখনো হঠাৎ নেমে গিয়ে তা মনে করিয়ে দেয়। গায়ে শীতের হালকা কাপড়ও চাপাতে হয়। কিন্তু দিনের বেলায় প্রচণ্ড রোদ ও প্রচণ্ড গরম। হাঁটতে গেলে তাই গলদঘর্ম না হয়ে উপায় নেই।

উপায় নেই না হেঁটেও। পরশু রাতেই যেমন সাঁতারের ভেন্যু রিও অ্যাকোয়াটিক সেন্টার খুঁজে পেতে এমপিসি থেকে ঘণ্টা দেড়েকেরও বেশি হাঁটতে হলো। ‘এমপিসি’ জিনিসটা কী, এটা বোধ হয় বলে নেওয়া ভালো। মেইন প্রেস সেন্টার। অলিম্পিকে সাংবাদিকদের মূল ঠিকানা। যেখানে বসে কয়েক হাজার সাংবাদিক একসঙ্গে কাজ করতে পারেন। এটির পাশেই টেলিভিশন সাংবাদিক ও কলাকুশলীদের জন্য আইবিসি—ইন্টারন্যাশনাল ব্রডকাস্টিং সেন্টার। রিওতে এই দুটিই অলিম্পিকের প্রাণকেন্দ্র বারা দা তুজিকায়। কোপাকাবানায় যে হোটেলে আছি, সেখান থেকে যেতে বাসে এক ঘণ্টারও বেশি লাগে।

এমপিসির আশপাশেই সাঁতার, টেনিস, সাইক্লিং এমন আরও অনেক খেলার স্টেডিয়াম আর মাঝে বিশাল খোলা জায়গা মিলিয়ে অলিম্পিক পার্ক। আগের তিনটি অলিম্পিক কাভার করার অভিজ্ঞতা থেকে জানি, অলিম্পিক পার্কের বিভিন্ন ভেন্যুতে যাওয়ার জন্য মিডিয়া শাটল থাকে। যেটি নির্দিষ্ট সময় পর পর এমপিসি থেকে ছেড়ে সব ভেন্যু ছুঁয়ে ছুঁয়ে আসে। কিন্তু কোত্থেকে ছাড়ে, কখন ছাড়ে এটি কে জানাবে! সবচেয়ে বড় সমস্যা, স্বেচ্ছাসেবকদের মধ্যে যাঁরা ইংরেজি জানেন, তাঁরা যেন মিটিং করে একেকজন একেক রকম তথ্য জানাবেন বলে ঠিক করে নিয়েছেন!

পরশুই যেমন এক স্বেচ্ছাসেবকের নির্দেশনা অনুযায়ী যখন মিডিয়া শাটল খুঁজছি, অন্য একজন দাবি করলেন, মিডিয়া শাটল-জাতীয় কিছু এই অলিম্পিকে নেই। এমপিসি থেকে যেখানেই যান, হেঁটেই যেতে হবে। তাঁর কথা বিশ্বাস করে হাঁটছি তো হাঁটছিই। শেষ পর্যন্ত অ্যাকোয়াটিক সেন্টার খুঁজে পাওয়া গেল। তখন আবার আরেক বিপত্তি। ঢোকার রাস্তা খুঁজে পাই না। একদিকে রাস্তা নেই দেখে অন্য দিকে যাই, সেখানে গিয়েই একই অবস্থা। স্বেচ্ছাসেবকদের এত গালমন্দ করছি, শেষ পর্যন্ত উদ্ধার করলেন অবশ্য বয়সী এক স্বেচ্ছাসেবকই। যদিও সেটি স্টেডিয়ামটা ঘিরে দুই চক্কর দেওয়ার পর। মিডিয়ার প্রবেশপথে গিয়ে শাটল বাসেরও দেখা মিলল। রাত ১২টা ছুঁই-ছুঁই সময়ে সাঁতার শেষ হওয়ার পর সেটিতেই এমপিসিতে ফিরলাম।

আসল ভোগান্তিটা তখনো জমা ছিল। এমপিসির ‘ট্রান্সপোর্ট হাব’ থেকে বিভিন্ন গন্তব্যে বাস ছেড়ে যায়। বাসের গায়ে ‘কোপাকাবানা’ স্টিকার লাগানো আছে দেখার পরও এটাই সেই বাস কি না, কয়েকবার জিজ্ঞেস করে তা নিশ্চিত হওয়ার পর বাসে উঠলাম। আরও নিশ্চিত হতে বলা হলো হোটেলের নামও। ঘণ্টা খানেক পর কোপাকাবানার দেখা মিলল। সমুদ্রসৈকতের জন্যই কোপাকাবানা বিখ্যাত, তবে শুধুই তো সৈকত নয়। এর আশপাশে বিশাল এলাকার নামও কোপাকাবানা। সেখানে এই হোটেল সেই হোটেলে সাংবাদিকদের নামিয়ে দেওয়া হচ্ছে। নামাতে নামাতে বাসে অবশিষ্ট মাত্র ছয়জন সাংবাদিক। যাঁদের তিনজনই বাংলাদেশের। বাসের যাত্রা যেখানে শেষ, সেখানেই আমাদের নামার কথা। কিন্তু বাস চলছে তো চলছেই। ড্রাইভারের সঙ্গে কথা বলতে গেলেই পর্তুগিজে হড়বড় করে কী যেন বলতে থাকেন। কোপাকাবানায় ঘণ্টা খানেক চক্কর দেওয়ার পর বাস যখন তীব্রগতিতে উল্টো দিকে চলতে শুরু করল, তখন বুঝলাম সর্বনাশ হয়েছে। এটি তো আবার বারা দা তুজিকায় যাওয়ার পথ ধরেছে। ড্রাইভারকে কোনোভাবে বুঝিয়ে বাস থামিয়ে নেমে যেতে পারলে তখন বাঁচি। হোটেলে না হয় ট্যাক্সিতেই ফিরব। অনেক কষ্টে সেটি বোঝানো গেল। বাস থেকে নেমে ট্যাক্সিতে ওঠার পর বুঝতে পারলাম, কোপাকাবানা ছাড়িয়ে রিওর আরেক বিখ্যাত সৈকত ইপেনামায় চলে গেছি। সেখান থেকে রুমে ঢুকতে ঢুকতে রাত আড়াইটা।

এই লেখাটা পাঠিয়েই বেরিয়ে পড়তে হবে আবার। আজ আবার কী ভোগান্তি অপেক্ষা করছে, কে জানে!

শেয়ার করুনঃ
আপনার মন্তব্য
আরও পড়ুন
×