শুধু সোনাই জেতেননি ম্যানুয়েল

২০১৬ রিও অলিম্পিক

উৎপল শুভ্র

২০ জুলাই ২০২১

শুধু সোনাই জেতেননি ম্যানুয়েল

সিমোন ম্যানুয়েলের সোনালি হাসি। ছবি: গেটি ইমেজেস

ইভেন্টটা হওয়ার কথা ছিল কেট নয়তো ব্রন্টি ক্যাম্পবেলের। সেই কেট ১০০ মিটার ফ্রিস্টাইল সাঁতার শেষ করলেন ষষ্ঠ হয়ে, ব্রন্টি ৪ নম্বরে থেকে। স্বর্ণ জিতেছিলেন সিমোন ম্যানুয়েল, অলিম্পিক দূরে থাক, আন্তর্জাতিক কোনো প্রতিযোগিতাতেই যাঁর এর আগে কখনো সোনা জেতা হয়নি।

প্রথম প্রকাশ: ১৩ আগস্ট ২০১৬। প্রথম আলো

ইভেন্টটা হওয়ার কথা ছিল বয়সে দুই বছরের ছোট-বড় দুই ক্যাম্পবেল বোনের লড়াই। ১০০ মিটার ফ্রিস্টাইলের বিশ্ব রেকর্ড কেট ক্যাম্পবেলের। আগের রাতে হিটে ভেঙেছেন অলিম্পিক রেকর্ডও। ব্রন্টি ক্যাম্পবেল আবার এই ইভেন্টে বিশ্ব চ্যাম্পিয়ন। দুই বোন এক-দুই হলে কী দারুণ একটা গল্পই না হতো! সারা শোস্ট্রম বাগড়া না দিলে যা না হওয়ার কোনো কারণও দেখা যাচ্ছিল না।

৫০ মিটার শেষে টার্নিংয়ের পরও দুই বোনই এক-দুই। কেট নিজের বিশ্ব রেকর্ড ভেঙে দেওয়ার সম্ভাবনা জাগিয়ে সবার আগে। শেষ পর্যন্ত সেই কেটই কি না ষষ্ঠ, ব্রন্টি শেষ করলেন ৪ নম্বরে! তবে গল্প একটা ঠিকই লেখা হলো। দুই বোনের প্রতিদ্বন্দ্বিতার চেয়েও অপরূপ গল্প। সোনা জিতে যেটি লিখলেন সিমোন ম্যানুয়েল। অ্যাথলেটিকসে আফ্রো-আমেরিকানদের দাপট অনেক পুরোনো। কিন্তু মেয়েদের সাঁতারে কারও ব্যক্তিগত সোনা এই প্রথম। যা বুঝতে পারার পর ম্যানুয়েলের প্রতিক্রিয়াটা এই অলিম্পিকের অমর এক ছবি হয়ে গেল। প্রথমে বিস্ময়ে হাঁ হয়ে গেল মুখ। এরপর কাঁদতে শুরু করলেন।ব্রন্টি ও কেট ক্যাম্পবেল। ছবি: গেটি ইমেজেস

শুধু সিমোন ম্যানুয়েলের জয়টাই যথেষ্ট ছিল। আন্তর্জাতিক কোনো প্রতিযোগিতাতেই কখনো সোনা জেতেননি, আর অলিম্পিকে নেমেই কি না সোনা! কিন্তু অপরূপ এই গল্পের যে আরেকটি অধ্যায় আছে। সোনা ম্যানুয়েল একা জেতেননি। একই সময়ে শেষ করে তা জিতেছেন পেনি ওলেকসিয়াকও। একবিংশ শতাব্দীতে জন্মানো কারও অলিম্পিকে প্রথম সোনা।

অলিম্পিক সাঁতারে সোনা ভাগাভাগি করার ঘটনা এর আগে মাত্র দুবারই ঘটেছে। ১৯৮৪ লস অ্যাঞ্জেলেসে এই মেয়েদের ১০০ মিটার ফ্রিস্টাইলেই, এরপর ২০০০ সিডনিতে পুরুষদের ৫০ মিটার ফ্রিস্টাইলে। কাকতালীয়ই বলতে হবে, সিডনিতে গ্যারি হল জুনিয়রের সঙ্গে সোনা ভাগাভাগি করা অ্যান্থনি আরভিন সাঁতারে সোনাজয়ী প্রথম আফ্রো-আমেরিকান। যিনি আছেন এই অলিম্পিকেও।

ক্যাম্পবেল-শোস্ট্রমদের পেছনে ফেলে ম্যানুয়েল-ওলেকসিয়াকের এই জয়কে অপ্রত্যাশিত বলেও যেন সবটা বোঝানো যাচ্ছে না। ঠিক এর আগের সাঁতারটাতেই ২০০ মিটার মিডলেতে টানা চার অলিম্পিকে সোনা জয়ের কীর্তি গড়েছেন মাইকেল ফেলপস। সেই ফেলপস যেন ম্লান রূপকথার এই গল্পের কাছে! 

সোনাজয়ী দুজন একসঙ্গে সংবাদ সম্মেলন করলেন। একটু পর ব্রোঞ্জজয়ী শোস্ট্রম একা। হাসতে হাসতে যিনি বললেন, ‘আমার মনে হয়, যা হয়েছে তা বুঝতে অনেকেরই কষ্ট হয়েছে। এবারের সাঁতারের সবচেয়ে বড় বিস্ময় এটি।’ ম্যানুয়েল নিজেই তো বিস্মিত। শুধু বিস্মিত নয়, মহাবিস্মিত। ‘সুপার সারপ্রাইজড’-এর বাংলা তো এটাই হয়। ফাইনালে ওঠাটাই ছিল তাঁর কাছে স্বপ্নপূরণ। সেমিফাইনালে ওঠাটাই বিবেচিত হতো সাফল্য বলে। আর ওলেকসিয়াক? কানাডিয়ান তরুণীর চোখমুখই বলে দিচ্ছিল, এখনো যেন তাঁর বিশ্বাস হচ্ছে না। বললেনও, প্রথম অলিম্পিকে এসেই ১৬ বছর বয়সে সোনা জেতাটা ‘পাগুলে ব্যাপার’ মনে হচ্ছে তাঁর কাছে।

সংবাদ সম্মেলনের প্রায় পুরোটাই অবশ্য শ্রোতার ভূমিকায় থাকতে হলো ওলেকসিয়াককে। সিমোন ম্যানুয়েলের জয় যে সাঁতারের সীমানা ছাড়িয়ে আরও বড় তাৎপর্য নিয়ে দেখা দিয়েছে। গায়ের রং দিয়ে মানুষকে বিচার করার আদিমতম সংস্কৃতি এখনো সমস্যা হয়ে আছে যুক্তরাষ্ট্রে। কিছুদিন আগে টেক্সাসে ‘পুলিশি বর্বরতা’র প্রসঙ্গ ছুঁয়ে গেলেন ম্যানুয়েল নিজেই। জাতিধর্মবর্ণ নিয়ে বিশ্বজুড়ে নারকীয় যা ঘটছে, সেটির আলোকে দেখলেন নিজের সাফল্যকে। ‘আশা করি, আমার এই সাফল্য পিছিয়ে থাকা মানুষদের জন্য বড় একটা অনুপ্রেরণা হবে। আমিও যেমন অনেকের কাছ থেকে অনুপ্রেরণা খুঁজে নিয়েছি, আমাকে দেখেও অনেকে তা নেবে’—পুলে কাঁদছিলেন, এবার ম্যানুয়েলের হাসি যেন আলো ছড়াচ্ছে।

মুক্তিও চাইলেন। অহর্নিশি শুনতে থাকা ‘ব্ল্যাক’ ‘ব্ল্যাক’ বলে পরিচয় থেকে মুক্তি, ‘সিমোন কালো সাঁতারু—এ কথাটা শুনতে শুনতে আমি ক্লান্ত। আমি আর এটি শুনতে চাই না। কারণ এর অর্থ হচ্ছে, এই পরিচয় ছাড়া আমি যথেষ্ট ভালো না।’ মুক্তি চাইলেন বিশাল কৃষ্ণাঙ্গ জনগোষ্ঠীর প্রত্যাশা পূরণের দায় থেকেও, ‘এটা আমাকে অনেক ভুগিয়েছে। আমার জন্য সব সময়ই যা বড় একটা বোঝা হয়ে আছে। এটিকে আমার কাঁধ থেকে নামাতে চাই।’

সিমোন ম্যানুয়েল চাইলেই তো আর হবে না। রিওর পুলে রূপকথা লেখার পর বোঝাটা না উল্টো আরও বেড়ে যায়!

শেয়ার করুনঃ
আপনার মন্তব্য
আরও পড়ুন
×