জেমি ডের সঙ্গে অস্কার ব্রুজোনের পার্থক্য যেখানে

সাইফুল বারী টিটু

২ অক্টোবর ২০২১

জেমি ডের সঙ্গে অস্কার ব্রুজোনের পার্থক্য যেখানে

জয়সূচক গোল করার পর তপু বর্মন

শ্রীলঙ্কার বিপক্ষে ১-০ গোলের জয় দিয়ে শুরু হয়েছে বাংলাদেশের সাফ চ্যাম্পিয়নশিপ। এই টুর্নামেন্টের ঠিক আগে আগে দায়িত্ব নেওয়া অস্কার ব্রুজোনের বাংলাদেশ কেমন খেলল? আগের কোচ জেমি ডের সঙ্গে কোথায় পার্থক্য তাঁর দর্শনে? এসব প্রশ্নের উত্তর পাওয়া যাবে আরেক কোচ সাইফুল বারী টিটুর এই লেখায়।

ম্যাচটা বাংলাদেশের জেতারই কথা ছিল। কারণ শ্রীলঙ্কার বিপক্ষে পরিষ্কার ফেবারিট ছিল বাংলাদেশ। ম্যাচটা নিয়ে একটু বাড়তি কৌতূহল ছিল সবার একটা কারণেই। হুট করে প্রায় আড়াই/তিন বছরের কোচ জেমি ডেকে সরিয়ে দিয়ে অস্কার ব্রুজোনকে দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে এই টুর্নামেন্টের আগে। ব্রুজোনের প্রথম ম্যাচে বাংলাদেশ কেমন খেলে, এ নিয়ে কৌতূহল থাকাটাই তাই স্বাভাবিক।

আমার চোখ মূল যে পার্থক্যটা চোখে পড়েছে, সেটাই আগে বলি। জেমি ডের সময়ে বাংলাদেশি খেলোয়াড়দের বলের পজেশন রাখার ব্যাপারটা ছিল কম। অনেক সময় ভালো পাসিং হয়েছে, তবে বেশিরভাগ সময় দুই/তিনটা পাসের পর বাংলাদেশ বল লুজ করে ফেলত। আরেকটা ব্যাপার, আজকের খেলায় ব্রুজোন যে খেলোয়াড়দের নামিয়েছে, জেমি হয়তো সেটা করার কথা ভাবতই না। এটাকে হয়তো সে ঝুঁকি মনে করত। 

কিন্তু অস্কার ব্রুজোনের চিন্তাভাবনা সবসময় ভিন্ন। বসুন্ধরা কিংসে ইব্রাহিমকে ও লেফট ব্যাকে খেলিয়েছে। আদতে যে লেফট উইঙ্গার। আজও যেমন ও সেন্ট্রাল মিডফিল্ডার হিসেবে খেলল। কোয়ালিটি খেলোয়াড়কে অস্কার যেভাবেই হোক, খেলিয়ে দেয়। বসুন্ধরা কিংসের ক্ষেত্রে যেমনটা দেখেছি। 

জেমি ডের সঙ্গে এখানেই অস্কারের মূল পার্থক্য। মূল ব্যাপারটা অ্যাপ্রোচে। জেমি এত ঝুঁকি নিত না বা এতটা সাহস দেখাত না, অস্কার যেটা দেখাচ্ছে। একটা জিনিস মনে রাখতে হবে, কোচদের কোনো ম্যাজিক জানা নাই। না জেমির জানা ছিল, না অস্কারের জানা আছে। তাঁরা খেলোয়াড়দের নিয়ে কাজ করে। খেলোয়াড়রাই আসল। এখানে আসলে অস্কারের দর্শনটা ভিন্ন। তাঁর আরেকটি সুবিধা হলো, প্রথম একাদশে বসুন্ধরার পাঁচজনকে নিয়ে খেলা শুরু করেছে। তাতে করে যে দর্শনটা সে মাঠে ফলাতে চায়, সেটা এখানে প্রয়োগ করতে পেরেছে। তাই অস্কার মাত্র কদিন আগেই দায়িত্ব নেওয়ার পরও খেলোয়াড়েরা মানিয়ে নিতে পেরেছে। 

তবে আমি বলব, এটা মাত্রই শুরু। র‌্যাঙ্কিংয়ের বিচারে এই ম্যাচে আমরাই ফেবারিট ছিলাম। এই ম্যাচ থেকে বরং শিক্ষা নিতে হবে। কেন শ্রীলঙ্কা দশজনের দল হয়ে যাওয়ার পরও আমরা ম্যাচটা শাসন করতে পারলাম না, শ্রীলঙ্কা অনেকটা নিয়ন্ত্রণ নিতে পারল, এসব বিষয় নিয়ে কাজ করার আছে। আমাদের সামনের প্রতিপক্ষ ভারত, মালদ্বীপ, নেপাল আরও শক্তিশালী। তাই এই ম্যাচে যে ভুলগুলো হয়েছে, পরের ম্যাচের আগেই তা শুধরে নিতে হবে। 

শ্রীলঙ্কা যেহেতু পাঁচ ডিফেন্ডার নিয়ে খেলছিল, বাংলাদেশের ডিফেন্স থেকে একটু স্লো বিল্ড আপে আক্রমণে ওঠাই ঠিক ছিল। ওটা না করে লং পাসে খেললে শ্রীলঙ্কার মতো বল হারানোর শঙ্কা থাকত। অস্কার ব্রুজোনের গেম প্ল্যান ছিল বলের পজেশন বেশি রেখে খেলা। বলের পজেশন বেশি থাকলে ডিফেন্ড করায় শক্তি কম খরচ হয়। অস্কারের এই কৌশলটা বাংলাদেশের পক্ষে যাচ্ছিল।

বাংলাদেশের উইঙ্গাররা এই অঞ্চলের অন্য অনেক দলের তুলনায় অনেক ভালো। তাদের মতো মানের খেলোয়াড় আবার ফরোয়ার্ড ও অ্যাটাকিং মিডফিল্ডের জায়গায় নেই। তাই উইং দিয়ে খেলার চেষ্টাটা বেশি ছিল। মাঝখান থেকে রানগুলো বা চাপ তৈরি করার দৌড়টা তৈরি হচ্ছিল না। এজন্য অস্কার ব্রুজোনের চেষ্টা ছিল উইঙ্গারের ওভার ল্যাপিংয়ে আক্রমণ তৈরি করা। ডান পাশে বিশ্বনাথ আর ইয়সিন আরাফাত এই কাজটা করছিল। 

শ্রীলঙ্কার বিপক্ষে ম্যাচটাতে যদি আসি, শুরু থেকেই বাংলাদেশ দল বলের পজেশন রেখে খেলার কৌশলে গেছে। অপেক্ষাকৃত বেশি ভালো মানের খেলোয়াড়দের মাঠে রাখা হয়েছে। ভালো মানের বলতে হোল্ডিং মিডফিল্ডে যদি জামাল ভূইয়াকে রাখা হয়, তাহলে বিপলু ও ইব্রাহিম কোনো কোনো সময়ে উইং ধরেও খেলেছে। ওরা মাঝখানে খেলায় বল পায়ে রাখার নিশ্চয়তা পাওয়া যাচ্ছিল। ওপরে সুমন রেজা, একদিকে জুয়েল রানা, আরেক দিকে ছিল রাকিব। ওরা তিনজনই ভালো মানের খেলোয়াড়, যারা নাকি বল পায়ে খেলতে পছন্দ করে।

শ্রীলঙ্কার কথা যদি বলি, ওরা কিন্তু লং পাস ছাড়া ভিন্ন খেলায় যায়নি। ওদের মধ্যে আক্রমণ গড়ে তোলার কোনো মানসিকতা দেখা যায়নি। গোলকিপার থেকে তারা লং পাসে ব্যাকে বল দিচ্ছিল, যেটা আসলে উদ্দেশ্যহীন। ওরা আসলে এক পয়েন্টের জন্য খেলছিল। 

বাংলাদেশের ক্ষেত্রে আমি বলব, বিল্ড আপের পর যেটা আসল কাজ মানে প্রতিপক্ষকে চেপে ধরা, সেটা ওরা পারছিল না। লঙ্কানদের ডিফেন্সে পাঁচজন থাকায় জায়গা কম ছিল। বাংলাদেশের উইং ব্যাকের ওভারল্যাপিং সামর্থ্য না থাকার কারণে আক্রমণে ওভারল্যাপ হচ্ছিল না। 

প্রথমার্ধে বাংলাদেশ অত বেশি চাপ তৈরি করতে না পারলেও ৭০ শতাংশের মতো বল পজেশন ছিল। আর শ্রীলঙ্কার ভাবনা ছিল, গোল খাবে না। আক্রমণের দরকার নেই। ঝুঁকি নেওয়ার কোনো প্রবণতাই তাদের মধ্যে ছিল না। 

দ্বিতীয়ার্ধে শ্রীলঙ্কা ডিফেন্সিভ মিডফিল্ডারকে বদলে আক্রমণাত্মক মিডফিল্ডারকে নামায়। এই সময়ে ওরা একটু আক্রমণে গিয়ে খেলার প্রয়োজন অনুভব করে। দ্বিতীয়ার্ধের শুরুর দিকেই পেনাল্টি থেকে গোল পেয়ে যাওয়ায় বাংলাদেশ অনেকটাই নির্ভার হয়ে যায়। কিছুক্ষণ পর লঙ্কানদের ১০ জনের দলে পরিণত হওয়াটাই ছিল ম্যাচের টার্নিং পয়েন্ট। 

লিড নেওয়ার পর ভাবা হয়েছিল যে বাংলাদেশ খেলার নিয়ন্ত্রণ আরো ভালোভাবে নিয়ে নেবে। কিন্তু দেখা গেল ভিন্ন ব্যাপার। শ্রীলঙ্কা চাপ সৃষ্টি করতে থাকে। আক্রমণে যায়। বলের পজেশন বেশি রাখতে শুরু করে। বাংলাদেশ বদলি খেলোয়াড়ের মাধ্যমে ওটা সামাল দেয়। এভাবে আক্রমণে গিয়ে একটা সময় শ্রীলঙ্কার খেলোয়াড়েরা ক্লান্ত হয়ে গেছে।

তবে একটা কথা, বাংলাদেশের লিগের খেলা ও পেশাদারিত্ব থেকে শ্রীলঙ্কা অনেক দূরে। মানের দিক দিয়ে শ্রীলঙ্কার খেলোয়াড়দের চেয়ে অনেক ভালো খেলেছে বাংলাদেশ। 

সারমর্ম হিসেবে যদি কিছু বলতে চাই, তা হলো, বাংলাদেশের লক্ষ্য সফল। এখান থেকে এই শিক্ষা নিতে হবে যে, যখন ১-০ গোলে এগিয়ে যাব এবং প্রতিপক্ষ এমন ১০ জনে পরিণত হবে তখন যেন আমরা ম্যাচটাকে ২-০ করতে পারি। ওই চেষ্টাটা বাংলাদেশের থাকতে হবে। এখানটায় একটু কমতি চোখে লেগেছে। 

সম্পর্কিত বিষয়:

শেয়ার করুনঃ
আপনার মন্তব্য
আরও পড়ুন
×