দোহায় কি ফিরবে সল্টলেক?
আবার বাংলাদেশ-ভারত
এক সময় দক্ষিণ এশিয়ার ফুটবল-শ্রেষ্ঠত্বের লড়াইটা ছিল ভারত আর বাংলাদেশের মধ্যেই। এখন ফিফা র্যাঙ্কিংয়ে অনেক এগিয়ে গেলেও ভারতের বিপক্ষে ম্যাচ এখনো বাংলাদেশে অন্যরকম একটা শিহরণ জাগায়। ফিরিয়ে আনে পুরোনো অনেক স্মৃতিও। আরেকটি বাংলাদেশ-ভারত ম্যাচের আগে তার কত কিছুই না মনে পড়ছে!
বাংলাদেশ-ভারত ফুটবল ম্যাচের কথা বললে প্রথমেই আপনার কী মনে পড়ে? সবচেয়ে বেশি কোন উত্তরটা পাওয়া যাবে, তা সহজেই অনুমান করতে পারছি। ২০১৯ সালের অক্টোবরে সল্টলেক স্টেডিয়ামের সেই ম্যাচটাই হয়তো ভেসে উঠছে চোখের সামনে। এটাই স্বাভাবিক। প্রথমত স্মৃতিটা এখনো মোটামুটি টাটকা। বাংলাদেশের পারফরম্যান্সটাও ছিল মনে গেঁথে থাকার মতো।
এত দর্শকের সামনে বাংলাদেশের এই প্রজন্মের ফুটবলারদের খেলার অভিজ্ঞতা নেই। এই অভূতপূর্ব আবহকে চাপের বদলে অনুপ্রেরণায় পরিণত করে কী উজ্জীবিত খেলাটাই না খেলেছিল আমাদের দল। ৮৮ মিনিটে গোল খেয়ে না বসলে জয় নিয়েই ফেরা যেত। আরেকটি ভারত-বাংলাদেশ ম্যাচের আগে খুব মনে পড়ছে ওই ম্যাচটার কথা। আর এই মনে পড়ায় আমি যে নিঃসঙ্গ নই, তা তো বুঝতেই পারছি। ঘুম থেকে উঠেই ফেসবুকে দেখলাম, ক্রিকেট অন্তঃপ্রাণ জালাল আহমেদ চৌধুরী আজকের ম্যাচটা নিয়ে স্ট্যাটাস দিয়েছেন। ফুটবল নিয়ে ঘুম ভাঙার সেই দিনগুলোর কথা মনে করে যেন একটু স্মৃতিকাতরতায়ও আক্রান্ত তিনি। আমরা কে তা নই!
করোনা নামের এই বিভীষিকা দেখা না দিলে এই ম্যাচটা ঢাকায় হতো, ফুটবল নিয়ে বাঙালির অবদমিত উত্তেজনার প্রত্যক্ষ সাক্ষীও হওয়া যেত। কপাল খারাপ, অ্যাওয়ে ম্যাচে অমন দারুণ পারফরম্যান্সের পরও বাংলাদেশের হোম ম্যাচটাও কি না অ্যাওয়ে ম্যাচই হয়ে গেল!
বিশ্বকাপ আর এশিয়ান কাপের বাছাই পর্বের ম্যাচ, বাছাইয়ের বৃহত্তর প্রেক্ষাপটে এই ম্যাচের কোনো মূল্য নেই। কিন্তু বাংলাদেশের ফুটবলের জন্য প্রতিটি আন্তর্জাতিক ম্যাচই মহাগুরুত্বপূর্ণ। গত কয়েক বছর জাতীয় দলের পারফরম্যান্স অনেকটা বানরের বাঁশ বেয়ে ওঠার সেই পাটিগণিতের অংকের মতো। একটু ওঠে তো, আবার ধপ করে নেমে যায়। মাঝেমধ্যে জেগে ওঠার টিমটিমে একটা আলো জ্বলে ওঠে, আবার এক ফুৎকারে তা নিভেও যায়। ওঠার কথা বলায় নিরপেক্ষ যে ভেন্যুতে আজ বাংলাদেশ-ভারত ম্যাচ, সেই কাতারের বিপক্ষে জামাল ভুঁইয়ার গোলে পাওয়া জয়টার কথা মনে পড়ছে। জাতীয় দলের বাইরে গেলে মনে পড়ে, কয়েক বছর আগে ভারতের আইএফএ শিল্ডে শেখ জামাল ক্রীড়াচক্রের সেই অসাধারণ খেলা। ভারতের ফুটবল সাংবাদিক বন্ধুদের সঙ্গে আড্ডায় যে প্রসঙ্গ ঘুরেফিরে আসে। আসে মামুনুলের পারফরম্যান্সের কথা। সেই সূত্র ধরে ইস্টবেঙ্গলে খেলতে গিয়ে কলকাতার ফুটবলের মহানায়ক হয়ে যাওয়া মোনেম মুন্নাও।
জাতীয় দলের কথা বলতে গিয়ে ক্লাব চলে এল। জেগে উঠল মনে বয়ে বেড়ানো আক্ষেপটাও। ফুটবলের প্রাণই তো ক্লাব ফুটবল। বাংলাদেশে সেটাই তো মরে গেল। বাংলাদেশের লিগগুলোতে, ঘরোয়া টুর্নামেন্টগুলোতে আবার মাঠ ভরে উঠুক দর্শকে, দেখবেন, ফুটবল আবারও জনমানুষের মুখে মুখে ফিরবে। ফুটবলারদেরও তো খেলতে অনু্প্রেরণা লাগে। দর্শকহীন মাঠে খেললে কী আর নিজেকে উজাড় করে দেওয়ার প্রতিজ্ঞা কাজ করে মনে! (লিখতে গিয়েই অবশ্য আবারও করোনার উঁকি, এখন তো শূন্য গ্যালারিতে খেলাই 'নেম অব দ্য গেম')।
দর্শক মাঠে যায় না বলে আমাদের ফুটবল জাগে না, নাকি ফুটবল জেগে ওঠে না বলে দর্শক মাঠে যায় না--এই দুষ্ট চক্র নিয়ে পরে কোনো এক সময় সবিস্তারে আলোচনা করা যাবে। আপাতত বাংলাদেশ-ভারত ম্যাচে ফিরি। বাংলাদেশ-ভারত বললে কোন ম্যাচটার কথা প্রথমে মনে হয়, এই প্রশ্ন দিয়ে শুরু করেছিলাম লেখাটা। সল্টলেক আমারও মনে হয়, মনে পড়ে যায় সাদউদ্দিনের সেই গোল আর গোলের মতোই দর্শনীয় তাঁর উদযাপন। তবে বয়স হয়েছে তো, এই বয়সে স্মৃতির সঙ্গে আড্ডা দেওয়ার অবধারিত রোগ আমার মনকে শুধু পুরোনো দিনে ফিরিয়ে নিতে চায়। বাংলাদেশ-ভারত ম্যাচ যেমন নিয়ে যায় সেই ১৯৮৫ সাফ গেমস ফুটবল ফাইনালে, ১৯৯১ কলম্বো সাফে, চার বছর পর মাদ্রাজে একই টুর্নামেন্টে...১৯৯৭ কলম্বো সাফ ফুটবলে, ২০০৩ সালে ঢাকায় মতিউর মুন্নার সেই গোল্ডেন গোলে বাংলাদেশের সর্বশেষ জয়ে ...বলতে থাকলে তা আর শেষ হওয়ার নয়। সব যে মাঠে বসে দেখেছি, তা নয়।
১৯৮৫ সাফ গেমস ফুটবলের ফাইনাল যেমন টেলিভিশনে দেখা। স্মৃতি যদি প্রতারণা না করে, দর্শকে ভরা বঙ্গবন্ধু স্টেডিয়ামে (তখন ঢাকা স্টেডিয়াম) প্রায় ৩০/৩৫ দূর থেকে নেওয়া আসলামের দুর্দান্ত ফ্রি কিকে বাংলাদেশের সমতায় ফেরা। তারপর টাইব্রেকারে স্বপ্নভঙ্গ। বিস্তারিত মনে নেই, তবে একটা দৃশ্য এখনো চোখে ভাসে। পেনাল্টি মিস করার পর ইউসুফের মাথায় হাত দিয়ে বসে পড়া...নাকি শুয়েই পড়েছিলেন? বাংলাদেশের ফুটবলের একনিষ্ঠ ভক্ত প্রথম আলোতে আমার সাবেক সহকর্মী নাইর ইকবাল তনয়ের সঙ্গে এই ম্যাচ নিয়ে কথা বলতে গিয়ে দেখি, তাঁরও এই দৃশ্যটাই শুধু মনে আছে। অথচ তনয়ের বয়স তখন মাত্র পাঁচ!
তখন তো মূলত সাফ গেমস ফুটবলেই দেখা হতো বাংলাদেশের। দক্ষিণ এশিয়ার শ্রেষ্ঠত্ব নিয়ে প্রতিদ্বন্দ্বিতাও ছিল এই দুই দেশের মধ্যেই। পার্থক্যটাও ছিল উনিশ-বিশই। তখন তো আর র্যাঙ্কিং-ফ্যাঙ্কিং ছিল না। অনুমানে আমরা একটা র্যাঙ্কিং করে নিতাম। এখন তো আর তা করার সুযোগ নেই, দরকারও নেই। যে কারণে আমাদের মন খারাপ করিয়ে দিয়ে ফিফা র্যাঙ্কিং জানিয়ে দেয়, ভারতের চেয়ে প্রায় ৮০ ধাপ পিছিয়ে বাংলাদেশ।
১৯৮৫ সাফ গেমস ফুটবলে বাংলাদেশ-ভারত বললাম, ফাস্ট ফরোয়ার্ড করে দশ বছর এগিয়ে যাই। মাদ্রাজে আবার এই দ্বৈরথ। মুন্না তখন সুপারস্টার। ভারত রীতিমতো তাঁকে ভয় পায়। এ কারণেই কি না, একটু ছলাকলার আশ্রয়ও হয়তো এ কারণেই। ফাইনালের দিন বাংলাদেশ দলের বাস থামিয়ে দেওয়া হয়েছিল স্টেডিয়াম থেকে অনেক দূরে। অনেকটা হেঁটে বাংলাদেশের ফুটবলারদের মাঠে আসতে হয়েছিল। ম্যাচে হারার অজুহাত দিতে বলছি না, মুন্নাও তা বলেননি। তবে এর মধ্যে স্বাগতিকদের 'খেলা' একটা তো ছিলই।
এক গোলেই হেরেছিল বাংলাদেশ। গোলটা করেছিলেন সাবির পাশা, এটা পরিষ্কার মনে আছে। গোলটা যে হাসান আল মামুনের ছেলেমানুষী একটা ভুল থেকে হয়েছিল, এটা লিখতে গিয়ে অবশ্য পুরোপুরি নিশ্চিত হতে পারছি না। ভুল একটা হয়েছিল, তবে অন্য কেউ তা করেছিলেন কি না, তা আর এখন ঘাঁটতে ইচ্ছা করছে না। ওই ম্যাচের একটা ঘটনা এখনো ভুলতে পারি না। ভারতের মূল স্ট্রাইকার তখন আই এম বিজয়ন। স্ট্রাইকার যখন, মুন্নার সঙ্গে মুখোমুখি একটা লড়াই তো থাকবেই। ম্যাচের শুরুর দিকেই বিজয়নের দিক থেকে তা একটু মাত্রা ছাড়াল। কয়েক মিনিট পর মুন্না এমন একটা ট্যাকলে তার জবাব দিলেন যে, অবাক হয়ে দেখলাম, ম্যাচের বাকি সময়টায় পারতপক্ষে আর মুন্নার কাছেই ঘেঁষলেন না বিজয়ন। পজিশন বদলে মাঝখান থেকে বরং সরে গেলেন ডান দিকে।
দুই বছর পর এই বিজয়নই বাংলাদেশকে বলতে গেলে একাই হারিয়ে দিলেন। নেপালে ১৯৯৭ সাফ ফুটবলে (সাফ গেমস ফুটবল নয়) ভারতের ৩-০ গোলের জয়ে দুটিই তাঁর। অন্যটি ভারতীয় ফুটবলের সে সময়ের সুপারস্টার বাইচুং ভুটিয়ার। অথচ ৭৪ মিনিট পর্যন্ত সেই ম্যাচ ছিল গোলশূন্য। ভারতের কাছে হেরে আর মালদ্বীপের সঙ্গে ড্র করে বাংলাদেশ গ্রুপ পর্ব থেকেই বিদায় নিল।
কিছুক্ষণ পরই যখন আরেকটি বাংলাদেশ-ভারত ম্যাচ শুরু হয়ে যাচ্ছে, একটা সুখস্মৃতি দিয়েই শেষ করি। ভারতের বিপক্ষে বাংলাদেশের সেরা ম্যাচ বেছে নিতে হলে যেটিকে আমি ওপরের দিকেই রাখব। তা বাংলাদেশ শুধু ২-১ গোলে জিতেছিল বলেই নয়, খেলেছিলও দারুণ। ওই ম্যাচটা এমন স্মরণীয় হয়ে থাকার আরেকটা কারণ অবশ্য এটাও হতে পারে যে, আমার খুব পছন্দের খেলোয়াড় রুমি রিজভি করিম দুর্দান্ত খেলেছিলেন ওই ম্যাচে। বাংলাদেশের দুটি গোলও ছিল তাঁর। রুমির কথা বলতে গিয়ে একটু নস্টালজিকই হয়ে যাচ্ছি। দেখার জন্য এমন দারুণ ফুটবলার বাংলাদেশে আর এসেছে কি না সন্দেহ!
একটু পরেই টেলিভিশনের সামনে খেলা দেখতে বসব তো অবশ্যই বাংলাদেশের জয়ের আশা নিয়ে। সঙ্গে আরেকটা চাওয়াও যদি জানিয়ে রাখি, রুমির মতো কারও যদি দেখা মেলে!
শুভকামনা, বাংলাদেশ!
* বাংলাদেশ-ভারত ম্যাচশেষে ম্যাচ রিপোর্টের সঙ্গে ট্যাকটিক্যাল বিশ্লেষণ করবেন এই সময়ে বাংলাদেশের সেরা কোচদের একজন সাইফুল বারী টিটু। ফেসবুক লিংকের অপেক্ষায় না থেকে উৎপলশুভ্রডটকম ওয়েবসাইটে একটু ঢুঁ মারতে অনুরোধ করছি।