মেসি কাঁদলেন, কাঁদালেন

উৎপলশুভ্রডটকম

৯ আগস্ট ২০২১

মেসি কাঁদলেন, কাঁদালেন

বার্সেলোনা ছাড়ছেন মেসি, খবরটা পুরনো। তবে খবরের ধাক্কার তীব্রতা সামলে মেসি জনসম্মুখে হাজির হলেন আজই প্রথম। সংবাদ সম্মেলনে উত্তর দিলেন সমস্ত প্রশ্নের। সঙ্গে তাঁর কান্নায় সংক্রমিত করলেন কোটি ভক্তকে।

চোখের জলে দু'কূল ভেসে যাবেই...এ নিয়ে সংশয় ছিল না কারও। কখন বাঁধ ভাঙে, সেটারই অপেক্ষা ছিল কেবল। লিওনেল মেসি অপেক্ষায় রাখলেন না বেশিক্ষণ। বাংলাদেশ সময় বিকাল চারটায় মেসির বার্সা-বিদায়ের সংবাদ সম্মেলনটা শুরুটাই হলো তাঁর কান্নাতে।

গলাটা তাঁর ধরে আসছিল সংবাদ সম্মেলনেও, কাঁদলেন শেষেও। এরই মধ্যে সাংবাদিকদের কৌতূহল মেটানোর চেষ্টা করলেন। কীভাবে হলো, কেন হলো, কোথায় যাবেন…. প্রশ্নের উত্তরে।

ক্যারিয়ারে কঠিন মুহূর্ত কম আসেনি তাঁর, এক মৌসুম আগেই তো ত্যক্তবিরক্ত হয়ে বার্সা ছাড়তে চেয়েছিলেন নিজে থেকেই। তখনও জানিয়েছিলেন, নিজের সঙ্গে কতটা বোঝা-পড়া করে তবে সিদ্ধান্তে পৌঁছাতে হয়েছে তাঁকে। গতবার ছাড়তে চেয়েও পারেননি, তবে এবার না চাইতেই ছাড়তে হলো। মেসি জানালেন, বাধ্য হয়ে ছাড়ার যন্ত্রণাটাই বেশি তীব্র, 'সর্বশেষ কিছুদিন আমার জন্য খুব কঠিন ছিল। গত বছর বুরোফ্যাক্স-কাণ্ডের সময় আমি কী বলব, সেটা ঠিক করাই ছিল। কিন্তু এ বছর পরিস্থিতি ভিন্ন। এটা (বার্সা) আমার ঘর, আমাদের ঘর। আমি এখানে থাকতে চেয়েছিলাম। সেটাই পরিকল্পনা ছিল। কিন্তু আজ সব কিছু ছেড়ে যেতে হচ্ছে।'

বার্সায় এসেছিলেন ১৩ বছর বয়সে, পরের ২১ বছরে হয়েছেন ক্লাবের কিংবদন্তি। কাতালান ক্লাবটার হয়ে ৭৭৮ ম্যাচে ৬৭২ গোল আর ২৮৮ অ্যাসিস্টের কথা তো পরিসংখ্যানই বলছে, তবে মেসি তো মেসি হয়েছেন লক্ষ-কোটি সমর্থকের মনে শত শত মুহূর্ত রচনা করে যাওয়ায়। নিজের প্রিয় মুহূর্ত হিসেবে অবশ্য বেছে নিলেন অভিষেকের দিনটাকেই, 'এত এত মুহূর্তের মধ্যে কোনো একটি বেছে নেওয়া কঠিন। কত শত দারুণ মুহূর্ত কেটেছে, কিছু কঠিন মুহূর্তও ছিল। তবে একটি বেছে নিতে হলে অভিষেককেই বাছাই করব। সেখান থেকেই তো সবকিছুর শুরু, আমার প্রথম স্বপ্ন পূরণ।'

কিছু স্বপ্ন তো পূরণও হয়নি। অধিনায়ক হয়েই সমর্থকদের যেমন বলেছিলেন, ন্যু ক্যাম্পে চ্যাম্পিয়নস লিগ ফেরত আনবেন। বিদায় নিতে হচ্ছে সেই প্রতিশ্রুতি পূরণ করতে না পেরেই। মেসি বলছেন, 'আমি আরও দু-একটা চ্যাম্পিয়নস লিগ জিততে চাইতাম। লিভারপুলের বিপক্ষে সেমিফাইনাল (২০১৯), পেপের (গার্দিওলা) অধীনে চেলসির বিপক্ষে সেমিফাইনাল (২০১২)। তবে আমার কোনো আক্ষেপ নেই। সব সময় সব কিছু উজাড় করেই চেষ্টা করেছি। কিন্তু যে দারুণ একটা প্রজন্ম পেয়েছিলাম, তাতে আমরা আরও চ্যাম্পিয়নস লিগ জিততে পারতাম।'

সংবাদ সম্মেলনে প্রবেশ করছেন মেসি, চোখ ছলছল।

কী হতে পারত শোনার চেয়ে কিভাবে কী হয়ে গেল প্রশ্নের উত্তরটাই তাঁর কাছ থেকে শুনতে চাইছিলেন সবাই। মেসি জানালেন, ক্লাবে থাকার জন্য ৫০ শতাংশ বেতন কমানোর প্রস্তাব তিনিই পাঠিয়েছিলেন কর্তাদের কাছে। ক্লাবও মেনে নিয়েছিল সেটাই। সেভাবেই এগোচ্ছিল সব কিছু। তবে এরপর কিভাবে পরিস্থিতি বদলে গেল, তা বুঝে উঠতে পারেননি এখনো, 'ক্লাবের ভেতরে কী হয়েছে, আমি বলতে পারছি না। লাপোর্তা জানিয়েছেন, চুক্তি নবায়ন হয়নি লা লিগার নিয়ম-নীতির কারণে। আমি শুধু এতটুকু বলতে পারি, আমি এখানে থাকার জন্য যা কিছু করা সম্ভব, সব করেছি। থাকতে চেয়েছি আমি। গত বছর চাইনি, সেটা বলেছিও। এ বছর আমি থাকতে চেয়েছি, কিন্তু পারিনি।'

তাঁর তরফ থেকে গাফিলতি হয়েছিল কি না, মেসি নেতিবাচক উত্তর দিলেন সে প্রশ্নেও, 'না, আমরা সম্ভাব্য সবকিছুই করেছি, কিন্তু শেষ পর্যন্ত চেষ্টাগুলো পরিণতি পেল না। নিয়মিত (প্রেসে) কথা না বললে আপনার সম্পর্কে অনেক কিছুই বলা হবে। কিন্তু সেগুলো সবকিছু সব সময় সত্যি হয় না। আমি শুধু আমার দিক থেকে কী হয়েছে সেটা বলতে পারি। আমি সব সময় সৎ থেকেছি, কাউকে ধোঁকা দিইনি। এটা আমার কাছে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ছিল।'

মেসি বলছেন, উদাসীনতা ছিল না অন্য পক্ষেও। বার্সার আর কিছু করার নেই বুঝতে পেরেই তাঁর সঙ্গে তখনই চুক্তির আলোচনা থামিয়েছিল কর্তৃপক্ষ, 'ক্লাব বুঝতে পেরেছিল, লা লিগা এটা (চুক্তি নবায়ন) হতে দেবে না। সম্ভবই ছিল না সেটা। এরপর আমারও ক্যারিয়ার নিয়ে সিদ্ধান্ত নিতে হতো, যেটা এখন করব।'

পরবর্তী ঠিকানা জানতে উন্মুখ হয়ে আছে গোটা বিশ্ব। মেসি জানাচ্ছেন, এখনো চূড়ান্ত সিদ্ধান্তে পৌঁছাতে পারেননি, 'সত্যি বলতে আজ পর্যন্ত কারও সঙ্গেই কিছু চূড়ান্ত হয়নি। (বার্সার পক্ষ থেকে মেসির চুক্তি নবায়ন না হওয়ার) বিবৃতি যখন এসেছে, এরপর থেকে অনেক ফোন এসেছে, অনেক ক্লাবই আগ্রহ দেখিয়েছে। তবে এখন পর্যন্ত কোনো কিছুই পাকাপাকি হয়নি। আমরা এ নিয়ে আলোচনা চালিয়ে যাচ্ছি।'

কিন্তু গণমাধ্যমে তো খবরও বেরিয়ে গেছে, কাল-পরশুর মাঝেই পিএসজির জার্সিতে হাজির হবেন তিনি। কিছুদিন আগে প্যারিসের ক্লাবটার চার ফুটবলারের সঙ্গে ইবিজায় তোলা তাঁর ছবিটাও আলোচনার খোরাক সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে। মেসি জানাচ্ছেন, এটাও এখনো সম্ভাবনার পর্যায়েই আছে। আর তিনি পিএসজিতে গেলেও ওই ছবিটার সঙ্গে এর যোগ নেই, 'কোপা আমেরিকা চলাকালেই ঠিক ছিল, (ছুটির মধ্যে ইবিজাতে) ডি মারিয়া আর পারেদেসের সঙ্গে দেখা করব। নেইমার তখন ফোন করল, সবাই একসঙ্গে দেখা হলাম। ভেরাত্তিও ছিল। ওটা (সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়া ছবিটা) শুধু একটা ছবিই। ওরা মজা করছিল, বলছিল, আমার উচিত পিএসজিতে যাওয়া। এখানে আলাদা কিছু নেই, এর পেছনে কোনো গল্প নেই, বিস্ময়ের কিছু নেই। কাকতালে ঘটে যাওয়া একটা ঘটনা।'

চেয়েছিলেন বার্সাতেই ক্যারিয়ার শেষ করতে। বার্সাকে তো নিজের ঘর মানেন এখনো। বার্সাতে আবারও ফিরবেন বলেও প্রত্যয় ব্যক্ত করলেন সংবাদ সম্মেলনেই, 'আমি এখানে আবার ফিরব, এটা আমার ঘর। আমার সন্তানদেরও আমি কথা দিয়েছি, আমি আবার এখানে ফিরে আসব।'

সে না হয় ফিরলেন। তবে ঘর ছেড়ে যাবার কষ্টে সর্বশেষ কয়েকটা দিন ভীষণ পুড়তে হয়েছে তাঁকে। যদিও একবার ফুটবল খেলতে শুরু করার পর সব কিছু স্বাভাবিক হয়ে যাবে বলেই বিশ্বাস তাঁর, 'আমার জীবন পুরো বদলে যাচ্ছে। এখন আবার শূন্য থেকে শুরু করতে হবে। বড় বদল এটা। আমার পরিবারের জন্যও এই শহর ছেড়ে যাওয়া কঠিন হবে। তবে আমরা ঠিকঠাকই থাকব। কঠিন চ্যালেঞ্জ এটা। তবে এটা মেনে নিতেই হবে, নতুন করে শুরু করতে হবে।'

নিজে মেনে নিচ্ছেন, কিন্তু তাঁকে ছাড়া বার্সা কি মানিয়ে নিতে পারবে? মেসি বলছেন, বার্সাকে পারতেই হবে, 'বার্সা বিশ্বের সবচেয়ে বড় ক্লাব, দারুণ একটা ক্লাব। খেলোয়াড় আসবে-যাবে। লাপোর্তা যা বলেছেন, যে কারও চেয়েই ক্লাব বড়...এটাই সত্য।'

মেসি যখন সংবাদ সম্মেলনে বক্তব্য রাখছেন, বাইরে তখন জড়ো হয়েছেন হাজারখানেক সমর্থক। করোনা মহামারীর কারণে সর্বশেষ এক বছরে ন্যু ক্যাম্পে প্রবেশাধিকার ছিল না যাঁদের। সমর্থকদের অভ্যর্থনা নিয়ে বিদায় নিতে পারলেন বলে মেসি কষ্ট পেয়েছেন ভীষণ। মনে মনে যে বিদায়ের ছবিটা এঁকেছিলেন, তাতে তো সমর্থকরাও ছিলেন, 'এভাবে বিদায় নিতে হবে কখনো ভাবিনি। মনে হয় না কেউই ভেবেছে। চেয়েছিলাম মাঠভর্তি দর্শকের সামনে থেকে বিদায় নিতে।'

কিন্তু জীবনের সব চাওয়া তো আর পূরণ হয় না। সমর্থকদেরও তাই মানিয়ে নিতে বলছেন পরিস্থিতির সঙ্গে, 'সমর্থকেরা এটার সঙ্গে অভ্যস্ত হয়ে যাবে, সব সময়ই এমনটা হয়েছে। ক্লাবে অনেক দারুণ খেলোয়াড় আছে, সবকিছুই শেষ পর্যন্ত ঠিকঠাকভাবেই চলবে।'

মেসি হয়তো ঠিকই বলেছেন, সব কিছুই ঠিকঠাক চলবে। তবে নিজে যেমন কাঁদলেন, অভ্যস্ত হওয়ার আগে বিশ্বজুড়ে ছড়িয়ে থাকা লক্ষ-কোটি চোখের তো ওই পরিণতিই হবে!

সম্পর্কিত বিষয়:

শেয়ার করুনঃ
আপনার মন্তব্য
আরও পড়ুন
×