মেসি-নেইমার-এমবাপ্পেকে কিভাবে একসঙ্গে খেলাবেন পচেত্তিনো?

দ্য অ্যাথলেটিক

১৩ আগস্ট ২০২১

মেসি-নেইমার-এমবাপ্পেকে কিভাবে একসঙ্গে খেলাবেন পচেত্তিনো?

পিএসজির স্বপ্নের এমএনএম জুটি কি হবে? ছবি: স্কাই স্পোর্টস

লিওনেল মেসিকে ঘিরে প্যারিস সেন্ট-জার্মেইর উৎসব ফুরোয়নি এখনো। তবে মরিসিও পচেত্তিনো সে উৎসবে শামিল হতে পারছেন বলে মনে হয় না। মেসি-নেইমার-এমবাপ্পেকে একসঙ্গে কোচিং করাতে পারা নিশ্চয়ই গর্বের, কিন্তু মাঠে তাঁদের এক সাথে কিভাবে খেলানো যায়, এই চিন্তাতে তো তাঁর ঘুম হারাম হয়ে যাওয়ার কথা। `দ্য অ্যাথলেটিক`-এর লেখাটা এ নিয়েই।

পড়তে শুরু করার আগে প্যারিস সেন্ট-জার্মেইর ইনস্টাগ্রাম পাতাটা একটু ঘুরে আসুন। কী দেখলেন বলে দেব? দেখতে পেলেন, পুরো পাতাটাই লিওনেল মেসিময়, যেন পিএসজিতে খেলোয়াড় বলতে এক মেসিই আছেন। সর্বশেষ ২৪টা পোস্টের সবগুলোতেই প্রকাশ পাচ্ছে তাঁর আগমনে পিএসজির উচ্ছ্বাস। দুই বছরের চুক্তিতে মেসিকে দলে ভিড়িয়ে প্যারিস যেন এখন সাত আসমান ওপরে পৌঁছেছে।

তবে ভেতরের খুশি সংবরণ করে পারিসিয়ানদের বাস্তবতার জমিনে নেমে আসতে হবে শিগগিরই। ফ্রেঞ্চ লিগ শুরু হয়ে গেছে আরও দিন পাঁচেক আগেই, মেসিকেও সম্ভবত মাঠে দেখা যাবে তৃতীয় গেমউইক থেকেই। মরিসিও পচেত্তিনোকে এর আগেই ভেবে বের করতে হবে, মেসিকে তিনি ঠিক কিভাবে ব্যবহার করবেন? তার চেয়েও বড় প্রশ্ন, মেসি আর নেইমারের কাছ থেকে সেরাটা বের করে আনবেন কিভাবে?

বয়স হয়ে গেছে ৩৪, মেসি তাই ক্ষয়ে গেছেন বলেই ধারণা অনেকের। পরিসংখ্যানও তো তেমনটাই বলে। লা লিগায় গত মৌসুমে পেনাল্টি ছাড়া যে কটা গোল পেয়েছিলেন, তা তাঁর ক্যারিয়ারের নবম সর্বোচ্চ। অ্যাসিস্টের হিসাব করলে এর চেয়েও ভালো মৌসুম কাটিয়েছেন ১৪ বার। একটা 'পাদটীকা' অবশ্য জুড়তে হচ্ছে সঙ্গে। নিজের মানদণ্ডে বেশ খারাপ মৌসুম কাটানো মেসিও লা লিগায় গোল পেয়েছেন ৩০টি, সঙ্গে ছিল ৯ অ্যাসিস্ট। যে সংখ্যাটা তাঁর হবু সতীর্থ কিলিয়ান এমবাপ্পের চেয়ে ৫ বেশি (২৭ গোল, ৭ অ্যাসিস্ট)। শুধু এমবাপ্পেই নন, ইউরোপের শীর্ষ পাঁচ লিগে এক রবার্ট লেভানডফস্কিই মেসির চেয়ে বেশি পরিমাণ গোলে জড়াতে পেরেছিলেন (৪১ গোল, ৭ অ্যাসিস্ট) নিজেকে। নিজের নিষ্প্রভ মৌসুমে, দুর্বল এক বার্সেলোনাকে নিয়ে তাঁর এই অর্জনকে খাটো করে দেখার অবকাশ নেই কোনো।

আর শুধু তো গোলই নয়, গত মৌসুমে বার্সার আক্রমণের বেশির ভাগই রচিত হয়েছে মেসির পায়ে। প্রতিপক্ষের রক্ষণভাগে প্রতি ৯০ মিনিটে মেসি বল ছুঁয়েছিয়েন শতকরা ১৮.৮ ভাগ, সংখ্যাটা বার্সেলোনার অন্য সব খেলোয়াড়ের চেয়ে কমপক্ষে ২.৬ শতাংশ বেশি।

গত মৌসুমে ফাইনাল থার্ডে বার্সেলোনার খেলোয়াড়েরা। ছবি: দ্য অ্যাথলেটিক

এমন একজন ফরোয়ার্ডকে বিনা খরচায় পেয়ে পিএসজি উল্লাস করতেই পারে। তবে সমস্যা হচ্ছে, মেসি হওয়ার দায়িত্বটা পিএসজি চার মৌসুম আগেই ২২২ মিলিয়ন ইউরো খরচ করে নেইমারকে দিয়েছে। গত মৌসুমের কথাই যদি ধরা হয় তো লিগ ওয়ানে প্রতি ৯০ মিনিটে প্রতিপক্ষের রক্ষণভাগে নেইমারের পায়ে বল ছিল ২২.৪ শতাংশ, সংখ্যাটা তাঁর যেকোনো পিএসজি সতীর্থর চাইতেই বেশি।

বার্সেলোনার যা ছিলেন মেসি, পিএসজিতে সেটাই নেইমার: দ্য অ্যাথলেটিক​​​​​

মেসি আর নেইমারকে তাঁদের স্ব স্ব দলে কতটা গুরুত্ব দেওয়া হচ্ছিল, ওপরের পরিসংখ্যান তারই প্রমাণ। আরও স্পষ্টভাবে বুঝতে চাইলে তাকানো যায় 'ইউজেজ রেট' মানদণ্ডের দিকে। 'ইউজেস্ রেট' ব্যাপারটা আবার কী? 'দ্য অ্যাথলেটিক' ব্যাখ্যা দিচ্ছে, একজন খেলোয়াড় যতক্ষণ মাঠে থাকছেন, সে সময়টায় তাঁর দলের গোলমুখ লক্ষ্য করে নেওয়া শটে, কি-পাসে, বলের নিয়ন্ত্রণ হারাতে কিংবা প্রতিপক্ষ ডিফেন্ডার পার করায় ব্যর্থ হয়ে তিনি যে ভূমিকা রেখেছেন, সেসবের অনুপাতকেই 'ইউজেস্ রেট' বলা হচ্ছে। এই পরিমাপকে লা লিগা আর লিগ ওয়ানে ২০১৭-১৮ মৌসুম থেকে ২০২০-২১ মৌসুম পর্যন্ত কমপক্ষে ৪৫০ মিনিট খেলা ফুটবলারদের ফেলে দেখা যাচ্ছে, নেইমার প্রতি মৌসুমেই অবস্থান করছেন সবার ওপরে।

`ইউজেস রেট`-এর হিসাব-নিকাশ। ছবি: দ্য অ্যাথলেটিক

ওপরের ছক থেকে তো 'শট ক্রিয়েশন রেট' আর খেলোয়াড়ের ফিটনেস সম্পর্কেও ধারণা পাওয়া যাচ্ছে। শট ক্রিয়েশন রেট মানদণ্ডে বোঝানো হচ্ছে, খেলোয়াড়ের দখলে থাকা বলের কত শতাংশ থেকে গোলমুখে শট কিংবা সুযোগ তৈরি হয়েছে। এবং এই হিসাবে মেসি উঠে যাচ্ছেন সবার ওপরে। মানেটা দাঁড়াচ্ছে, মেসি যতক্ষণ বলের দখল নিজের কাছে রেখেছেন, সেখান থেকে বেশি পরিমাণ গোলের সুযোগ সৃষ্টি হয়েছে, বিপরীতে নেইমার বেশির ভাগ সময়ই বলের দখল হারিয়েছেন।

আর নেইমারের চেয়ে বয়সে বছর পাঁচেক বড় হওয়া সত্ত্বেও মেসিকেই মাঠে পাওয়া গিয়েছে বেশি। গত চার মৌসুমে নেইমারের যেখানে প্রতি ৯০ মিনিটে ৪৫ মিনিট মাঠে থাকতেই কষ্ট হচ্ছে, মেসি মাঠে ছিলেন প্রায় ৮০ শতাংশ মিনিট।

এর আগে বার্সেলোনায় যখন খেলেছেন, নেইমার তখন আক্রমণভাগের বাকি দুজন সতীর্থ, অর্থাৎ মেসি আর সুয়ারেজের সঙ্গে আক্রমণের দায়িত্বটা ভাগাভাগি করেছেন। যেটা আমরা দেখতে পাই তাঁর শট ম্যাপে, মাঠের বাঁ-প্রান্ত থেকেই তিনি শট নিতেন বেশির ভাগ সময়।

গত মৌসুমে পেনাল্টি ছাড়া মেসির গোলে শট। ছবি: দ্য অ্যাথলেটিক

কিন্তু পিএসজিতে সব কোচরাই তাঁকে দিয়েছেন অবাধে মাঠ দাপিয়ে বেড়ানোর স্বাধীনতা। যে কারণে ডানে-বাঁয়ে-মাঝে, আক্রমণভাগের যেকোনো জায়গা থেকেই শট নিয়েছেন তিনি। পিএসজির হয়ে গত মৌসুমের শট ম্যাপের দিকে তাকালেই সেটা আরও পরিষ্কার বুঝতে পারবেন আপনি।

পেনাল্টি ছাড়া নেইমারের গোলে শট। ছবি: দ্য অ্যাথলেটিক

এবং, এখানেই মরিসিও পচেত্তিনোর দুশ্চিন্তা। অনুশীলনে না হয় গণ্ডাখানেক বল দিয়ে মন ভরাবেন দুজনের, কিন্তু খেলতে গেলে তো মাঠে বল থাকবে একটাই। তখন কোন ভূমিকায় খেলিয়ে দুজনকেই সন্তুষ্ট করতে পারবেন, পচেত্তিনোকে খুঁজে বের করতে হবে সেই প্রশ্নের উত্তরই।

প্রশ্ন হতে পারে, কিলিয়ান এমবাপ্পে আর আনহেল ডি মারিয়ার সঙ্গে নেইমারের সমন্বয় যখন খুঁজে বের করা গেছে, তখন মেসিকে নিয়ে সমস্যা হবে কেন? এমবাপ্পের কারণটা বোঝা খুব সহজ। ক্ষিপ্রগতির দৌড়ে প্রতিপক্ষকে ছিন্নভিন্ন করে দিতে চান বলে অ্যাটাকিং থার্ডে এমবাপ্পে নিজেই বলের দখল রাখতে চান কম, তাঁর ইউজেজ রেট মাত্র ১৬ শতাংশ। আর আনহেল ডি মারিয়া পিএসজির জার্সিতে খেলেছেন ১৮৫৩ মিনিট, এবং নেইমারের মাঠে পেয়েছেন অর্ধেকেরও কম সময়, মাত্র ৮৫৫ মিনিট। এবং, ওই সময়টা পিএসজি সমর্থকদের দুশ্চিন্তা বাড়ানোর কথা আরও। ওই স্বল্প সময়েই মার্শেই, লিল ও লিওঁর কাছে ১-০ ব্যবধানে হারতে হয়েছে পিএসজিকে। ওই তিন ম্যাচের একটিতে ড্র করতে পারলেও গত মৌসুমেও ফ্রেঞ্চ লিগের শিরোপা থাকত পিএসজির কাছেই।

পচেত্তিনোর কোচিং দর্শনেও বদল আনতে হতে পারে এবার। হাই-প্রেসিং, হাই-এনার্জি ফুটবল খেলানোর জন্য খ্যাত পচেত্তিনো এবার পাচ্ছেন এমন কিছু ফুটবলার, প্রেসিং ফুটবল খেলাটা যাদের ঠিক পছন্দ না। খেলোয়াড়দের ভেতরে স্বতন্ত্রভাবে যেই আক্রমণাত্মক প্রবৃত্তিগুলো লুকিয়ে আছে, সেগুলো বের করে এনে মালা গাঁথার কাজটাও তাঁকেই করতে হবে।

অবধারিতভাবেই প্রশ্ন চলে আসে, কোন ফর্মেশন মানলে মালা গাঁথা সহজ হবে? পচেত্তিনো ভাবতে পারেন বেশ কয়েকটি ফর্মেশনকে কেন্দ্র করেই। যেমন, গতানুগতিক ৪-৩-৩ ফর্মেশন একটা উপায় হতে পারে। মিডফিল্ডে থাকবেন টেকনিকের দিক থেকে তুলনাহীন লিয়ান্দ্রো পারেদেস আর ডিফেন্সে মরণকামড় দিতে থাকবেন ইদ্রিস গায়া। বাঁয়ে নেইমার আর ডানে এমবাপ্পে খেললে মাঝে ফলস নাইন হিসেবে খেলবেন মেসি। এই ফর্মেশন মানতে গেলে পচেত্তিনোকে অবশ্য নেইমারের দিকেই তাকিয়ে থাকতে হবে। দুটি কারণে। প্রথমত, বার্সেলোনাতে চার বছর আগে এই ভূমিকায় খেলা নেইমারের অতি দ্রুত সেই স্মৃতি বর্তমানে ফেরত আনতে হবে। এবং দ্বিতীয়ত, মেসিকেই পিএসজির 'মুখ্য চরিত্র' হিসেবে মেনে নিতে হবে।

বিকল্প হতে পারে ৪-২-৩-১ ফর্মেশনও। এবং এই ফর্মেশনটাই মাঠে দেখার জন্য দর্শকের জিব লকলক করার কথা। এই ছকে ১০ নম্বরের ভূমিকায় খেলবেন নেইমার, তাঁর দু'পাশে থাকবেন দুই আর্জেন্টাইন (ডানে মেসি, বাঁয়ে ডি মারিয়া), আর সবার ওপরে তো এমবাপ্পেই। আক্রমণে উঠলে ফর্মেশনটা বদলে যেতে পারে ৩-২-৫ ছকেও, যেখানে ডানপ্রান্ত ধরে উঠে আশরাফ হাকিমি পিএসজিকে সুযোগ দেবেন মাঠের প্রস্থ বাড়ানোর। প্রতিপক্ষের জমাট ডিফেন্স ভাঙার ক্ষেত্রে মেসি-নেইমারের সমন্বয় গড়া যেমন সহজ হবে, তেমনি গতি দিয়েও পরাস্ত করা যাবে। অবশ্য প্রশ্ন আছে এই ছকেও। মধ্যমাঠে ভারসাম্য থাকবে কি না, এবং যথাসময়ে আক্রমণভাগের খেলোয়াড়রা যথাযথ জায়গায় নিজেদের খুঁজে পাবেন কি না।

এত সাত-পাঁচ না ভেবে পচেত্তিনো খেলাতে পারেন 'রোটেশন' পদ্ধতিতেও। মাঠে কেবল একজন মেগাস্টারকেই রাখবেন, আর বাকিদের রাখবেন বেঞ্চে। পিএসজির স্কোয়াডের গভীরতা বিবেচনায় নিলে কাজটা খুব একটা কঠিনও হওয়ার কথা না। অবশ্য খেলোয়াড়েরা এই ফর্মেশন মানবেন কি না, সেখানেই মূল প্রশ্নটা ওঠার কথা।

যাক গে, এ সবই তাত্ত্বিক আলোচনা। শেষমেশ কী হবে, তা জানতে আরও কয়েকদিন অপেক্ষা করতে হবে। একটা জিনিস অবশ্য মাথায় ঢুকিয়ে নিতে হবে মেসি-নেইমার দুজনকেই, এই মৌসুমে নিজেদের পছন্দসই ভূমিকা পাওয়া দুজনের জন্যেই খুব কঠিন। যদি দুজনই তা মেনে নিতে পারেন, কোচও দলের ভারসাম্য খুঁজে পান, পিএসজির ইতিহাসের সেরা সময়টা এই লেখা হলো বলে।

 'দ্য অ্যাথলেটিক' থেকে ভাষান্তর: রিজওয়ান রেহমান সাদিদ

সম্পর্কিত বিষয়:

শেয়ার করুনঃ
আপনার মন্তব্য
আরও পড়ুন
×