মেসি ও রামোস ছাড়া প্রথম ক্লাসিকো

কাশীনাথ ভট্টাচার্য

২৩ অক্টোবর ২০২১

মেসি ও রামোস ছাড়া প্রথম ক্লাসিকো

সুযোগ থাকলে লিওনেল মেসি আর সার্জিও রামোস বেশ আয়েশ করে টেলিভিশনে দেখতে পারতেন ‘এল ক্লাসিকো’। হয়তো পাশাপাশি বসে সেদিনকার দুই প্রতিদ্বন্দ্বী এখনকার পিএসজি সতীর্থ বার্সেলোনা আর রিয়াল মাদ্রিদের খেলার নানা দিক নিয়ে আলোচনাও করতে পারতেন। সেরকম কিছু ঘটছে না বটে। তবে ঘটনা হলো, প্রায় দেড় দশক পর এই দুজন একই সঙ্গে এল ক্লাসিকোতে নেই। তা ন্যু ক্যাম্পের এই ম্যাচে কে এগিয়ে?

বছর ষোল আগের কথা। ১৯ নভেম্বর ২০০৫। সান্তিয়াগো বার্নাব্যু-তে এল ক্লাসিকো। বার্সেলোনা জিতেছিল ৩-০। রোনালদিনহো অপ্রতিরোধ্য। দুটি গোল করেছিলেন। অন্য গোল স্যামুয়েল এতো-র। খেলা শেষে বার্নাব্যু-এর দর্শক উঠে দাঁড়িয়ে হাততালি দিয়ে অভিনন্দন জানিয়েছিলেন ব্রাজিলীয় রোনালদিনহোকে। রিয়াল মাদ্রিদ্রের ঘরের মাঠে এমন সম্মান আর একজনই পেয়েছিলেন আগে–ডিয়েগো ম্যারাডোনা!

হঠাৎ ১৫ বছর আগে ফেরার কারণ?

লিওনেল মেসি এবং সার্জিও রামোস, এল ক্লাসিকোর ইতিহাসে যে দুজন সবচেয়ে বেশি ৪৫টি করে ম্যাচ খেলেছেন, দুজনেই এখন একই ক্লাবের সাজঘরে, বার্সেলোনা থেকে খানিক দূরের প্যারিস শহরের প্রাণকেন্দ্রে। মেসি আর রামোসের এল ক্লাসিকো অভিষেক হয়েছিল ২০০৫ সালের ওই ম্যাচে, যেখানে রোনালদিনহোকে আটকাতে গিয়ে হিমসিম রামোস। তখনও তিনি রাইট ব্যাক আর বার্সেলোনার আক্রমণে বাঁ প্রান্ত ধরে উঠে আসতেন রোনালদিনহো।সেই ম্যাচের পর স্বাভাবিকভাবেই আনন্দে ভেসে সাজঘরে ফিরেছিলেন মেসি, আর রামোস ফিরেছিলেন হতভম্ব হয়ে। পরে আরও ৪৪ ম্যাচে পরস্পরের বিপক্ষে খেলেছেন দুজন। এল ক্লাসিকোর ইতিহাসে সর্বোচ্চ ২৬ গোলের গৌরব যেমন মেসির সঙ্গী, রামোসের সঙ্গে আবার থেকে গিয়েছে সর্বোচ্চ লাল এবং হলুদ কার্ড দেখার কুখ্যাত নজির।

মজার ব্যাপার, ৪৫ ম্যাচ এবং ১৫ বছর পর, দুজনে একসঙ্গে দেখতেই পারেন রবিবারের ম্যাচ। কিন্তু নিজেদেরও খেলা আছে, সময়ের হিসাবে এল ক্লাসিকো শেষ হওয়ার পর। তাই, ইচ্ছে থাকলেও উপায় থাকবে না হয়তো। আর, দুই তারকার দলবদলজনিত অনুপস্থিতিতে, এল ক্লাসিকো-র ‘থিম’ আবারও অভিষেক!

বার্সেলোনার আনসু ফাতি, গাভি, মেমফিস দেপাই-এর অভিষেক হওয়ার সম্ভাবনা যেমন, রিয়াল মাদ্রিদ্রের হয়ে ডেভিড আলাবা, এদুয়ার্দো কামাভিনগার প্রথম এল ক্লাসিকো দেখতে চলেছে ক্যাম্প নু। কোভিড অতিমারীতেও বার্সেলোনার ঘরের মাঠে সব টিকিট বিক্রি হয়েছে। পুরোপুরি ভর্তি গ্যালারি দেখার সুযোগও বিশ্বের ফুটবল-দর্শকের সামনে।

আশা দেখাচ্ছেন ফাতি! ছবি: নূরফটো
মেসিকে ছেড়ে যতটা বিপাকে পড়েছে বার্সেলোনা, রামোসকে ছেড়ে ততটা সমস্যায় পড়েনি রিয়াল মাদ্রিদ্র। লা লিগায় এখনও পর্যন্ত আট ম্যাচে ১৭ পয়েন্ট নিয়ে তৃতীয় রিয়াল, বার্সেলোনা সমসংখ্যক ম্যাচে ১৫ নিয়ে সপ্তম। মৌসুমে এখনও ৩০ ম্যাচ বাকি দুই দলেরই। তাই উত্থান স্বাভাবিক। দুদলই শেষ ম্যাচ খেলেছিল ইউরোপে। রিয়াল ৫-০ জিতেছিল, বার্সেলোনা কোনও রকমে ১-০ জিতে এবার ইউরোপে প্রথম পয়েন্ট পেয়েছে ডায়নামো কিয়েভের বিপক্ষে।

ভবিষ্যতে চোখ রাখলে এই ম্যাচ হতে চলেছে দুই উঠতি তারকার লড়াই। স্পেনের আনসু ফাতি ও ব্রাজিলের ভিনিসিউস জুনিয়র। ফাতি গত বছর শুরু করেছিলেন সাড়া জাগিয়ে। কিন্তু চোটের কারণে দীর্ঘ অনুপস্থিতি তাঁকে পিছিয়ে দিয়েছে। ফিরে আসছেন সবে। ভিনিসিয়ুস সেখানে অনেকটাই প্রতিষ্ঠিত। এবার লা লিগায় পাঁচ গোল পেয়ে গিয়েছেন। চোটের কারণে করিম বেনজেমা খেলতে না পারলে বড় ধাক্কা হতে পারে রিয়ালের। কিন্তু ভিনিসিয়ুসদের সামনে খুলে যাবে দরজা, ফ্রান্সের হয়ে নেশনস লিগজয়ী বেনজেমার অনুপস্থিতিতে দলের দায়িত্ব কাঁধে নিয়ে এগিয়ে দেওয়ার।

তারকা হবার লড়াইয়ে! ছবি:রিয়াল মাদ্রিদ
বার্সেলোনার আক্রমণভাগে তিন অস্ত্র কুতিনহো-ফাতি-দেপাই। কুতিনহো আগে খেললেও মেসির ছত্রছায়ায় ছিলেন। এবার তাঁর সামনে সুযোগ নিজেকে অপরিহার্য প্রমাণের। আর দেপাইকে অনেক আশা নিয়ে সই করিয়েছেন রোনাল্ড কোম্যান। এই ম্যাচে সাফল্য আগের ম্যাচগুলির ব্যর্থতা ভোলাতে পারে সহজেই।

আর রিয়ালের মাঝমাঠের অভিজ্ঞতা এবং দক্ষতার সঙ্গে এই মুহূর্তে কোনও তুলনাই হবে না বার্সেলোনার। কার্লো আনচেলোত্তির সবচেয়ে বড় সুবিধা –টনি ক্রুস, কাসেমিরো এবং লুকা মদরিচের উপস্থিতি। মাঝমাঠ থেকে তিনজনেই খেলা নিয়ন্ত্রণের পাশাপাশি বিপক্ষের আক্রমণ ভোঁতা করার কাজেও সমান উপযোগী। সেখানে বুসকেতস-ফ্রাঙ্কি দে ইয়ং-গাভি ত্রয়ীর ওপর চাপটা বেশি, রিয়াল ত্রয়ীকে আটকানোর। কাগজে কলমে রিয়াল মাঝমাঠ অনেক বেশি আত্মবিশ্বাসী থাকবে বিপক্ষের ঘরের মাঠেও।

রক্ষণে অবশ্য দুটি দলই এখনও নিজেদের গুছিয়ে নেওয়ার চেষ্টায়। বার্সেলোনা ৮ ম্যাচে ৮ গোল খেয়ে থাকলে রিয়াল খেয়েছে ১০টি। আলবা শেষ পর্যন্ত খেলার মতো সুস্থ হলে বার্সেলোনার রক্ষণে বাকি তিনজন–এরিক গার্সিয়া, জেরার্ড পিকে এবং সের্জিনিও দেস্ত। রিয়ালের চারজন লুকাস ভাজকেস, এদের মিলিতাও, ডেভিড আলবা ও ফেরলান্দ মেন্দি। তিনকাঠির তলায় মার্ক আন্দ্রে টের স্টেগেন ও থিবো কোর্তোয়াকে নিয়ে ভাবনার জায়গা নেই। এখনকার বিশ্বের অন্যতম সেরা দুই গোলরক্ষকের বিশ্বস্ত হাত বেশ কয়েকবার নিশ্চিত গোল বাঁচাবেই।

দুই কোচের মধ্যে অবশ্যই বেশি অভিজ্ঞ কার্লোস আনচেলোত্তি। ইতালীয় কোচের পরিচিতি আরও বেশি, সমান-সমান ম্যাচ বের করে আনার জন্য। বার্সেলোনার কোম্যান এখনও সেখানে পরিচিত গণ্ডি ছেড়ে বেরোবেন কিনা, বেরোলেও কী করবেন, তা নিয়ে দ্বিধায়। বল পায়ে থাকলে ভালো, না থাকলেও আনচেলোত্তির দল কখনও ‘শেপ’ হারায় না, উল্টে তীব্র গতির প্রতি আক্রমণে বিপক্ষের নাভিশ্বাস তুলে দেয়। কোম্যানের বার্সেলোনা মেসি-হারানোর শোক কাটিয়ে উঠে এখনও বল পায়েই খেলতে চাইছে, কিন্তু মাঠে প্রকৃত নেতার অভাব, যা সামলে দেওয়া বুসকেতসের পক্ষে অনেকটাই কঠিন। যদিও, স্পেনের হয়ে বেশ ভাল খেলেছিলেন বুসকেতস, এই ম্যাচ মোটেও তাঁকে সেই সুযোগ দেবে না।

এবারের এল ক্লাসিকো তাই নতুন প্রজন্মের তারকাদের একে অপরকে ছাপিয়ে যাওয়ার ম্যাচ, দু-দলেরই বেশ কয়েকজন সিনিয়রের উপস্থিতিতে।

ধরে নেওয়া যাক এবং এর পেছনে যথেষ্ট কারণও রয়েছে যে, সার্জিও আগুয়েরো এই ম্যাচে শুরু থেকে খেলবেন না। ফাতি আর ভিনিসিউসের নায়ক হওয়ার এই যুদ্ধে তাই মাঝমাঠের অভিজ্ঞ ত্রয়ীর কারণেই সামান্য হলেও এগিয়েই থাকছেন ভিনিসিয়ুস জুনিয়র!

শেয়ার করুনঃ
আপনার মন্তব্য
আরও পড়ুন
×