নেইমার ২, মেসি ১, রোনালদো ০

উৎপল শুভ্র

১৫ জুন ২০২১

নেইমার ২, মেসি ১, রোনালদো ০

২০১৪ বিশ্বকাপের সময় রিওর কোপাকাবানা বিচে বালি দিয়ে বানানো নেইমার, মেসি ও রোনালদোর ভাস্কর্য

ইউরো আর কোপার চলতি আসরে বর্তমান ফুটবলের সবচেয়ে বড় তিন সুপারস্টারকে নিয়ে লিখলে অবশ্যই শিরোনামটা এমন হতো না। এই লেখাটা ২০১৪ বিশ্বকাপ ফুটবলে মেসি-রোনালদো-নেইমারের একটি করে ম্যাচ হয়ে যাওয়ার পর। কোপাকাবানার বিচে বালি দিয়ে বানানো এই তিন মূর্তিকে প্রথম ম্যাচে তাঁদের পারফরম্যান্সের প্রতীকী চিত্র বলে মনে হয়েছিল। স্মৃতি রোমন্থন আর কি!

প্রথম প্রকাশ: ১৮ জুন, ২০০৬। প্রথম আলো।

কোপাকাবানা সৈকতে সারি সারি বালুর ভাস্কর্য। থিম অবশ্যই বিশ্বকাপ।

একটিতে তাঁরা তিনজন। নেইমারকে খুব সহজেই চেনা যায়। ১০ নম্বর হলুদ জার্সি অবশ্যই বড় কারণ। সাহায্যে আসে চুলের স্টাইলটাও। মেসির মুখটা ঠিক হয়নি। তারপরও তাঁকে চিনিয়ে দেয় ডোরাকাটা নীল-সাদা জার্সির বুকে লেখা ১০ নম্বর। কিন্তু বর্তমান ফুটবলের হালচাল না জানলে তৃতীয়জনকে আপনি চিনতেই পারবেন না। 

গায়ে জার্সি আছে। তাতে পর্তুগালের ব্যাজটাও আবছা চোখে পড়ে। কিন্তু মেসি-নেইমারের মতো এই জার্সির কোনো রং নেই। মাটি-রং জার্সির লোকটা যে ক্রিস্টিয়ানো রোনালদো, তা বোঝার একমাত্র উপায় পাশে মেসি আর নেইমার। ওই দুজনের পাশে আর কে থাকবে?

নেইমার আর মেসির গায়ে জার্সিটা এত জীবন্ত, রোনালদো এমন কেন? পর্তুগালের জার্সির লাল রংটা আনতে পারেননি ভাস্কর? কই, কোনো চেষ্টাই তো করেননি। 

কারণ কী, কে জানে! তবে বিশ্বকাপে ওই তিনজনের প্রথম ম্যাচের পর বালুর ওই ভাস্কর্যটা এমনই প্রতীকী হয়ে উঠছে যে, কারও এমন মনে হতেই পারে, বুঝেশুনেই বোধ হয় অমন করা হয়েছে! 

২০১৪ বিশ্বকাপে প্রথম ম্যাচেই দুই গোল করেছিলেন নেইমার। ছবি: গেটি ইমেজেস

প্রথমেই আছেন নেইমার। প্রথম ম্যাচে যাঁর দুই গোল। এরপর মেসি। প্রথম ম্যাচে গোল একটি, তবে সম্ভবত এখন পর্যন্ত এই বিশ্বকাপের সেরা গোল। দলকে জিতিয়ে ম্যাচ-সেরার স্বীকৃতিও পেয়েছেন দুজনই। রোনালদো গোল তো পানইনি, দলও হেরেছে ৪-০ গোলে। যে স্কোরলাইন শুধুই একটা ম্যাচে পরাজয়ের চেয়ে আরও অনেক বেশি তাৎপর্যবহ হয়ে উঠতে পারে। শেষ পর্যন্ত গোল পার্থক্য দ্বিতীয় রাউন্ডে ওঠার নির্ধারক হয়ে উঠলে কে জানে, এটাই পর্তুগালের কাল হয়ে দাঁড়ায় কি না! রোনালদোর বিশ্বকাপ প্রথম রাউন্ডেই শেষ হয়ে যাবে না তো?

বিশ্বকাপ তাতে নিশ্চিত খানিকটা রং হারাবে। পেলে-ম্যারাডোনার মতো মেসি-রোনালদোকে নিয়েও ফুটবল বিশ্ব অনেক দিনই দ্বিধাবিভক্ত। কেউ মেসি বললে নির্ঘাত পাশ থেকে রোনালদো বলে চিৎকার শোনা যাবে। তবে এই বিশ্বকাপে শ্রেষ্ঠত্বের মুকুটটা মাথায় পরে এসেছেন রোনালদোই। বলতে গেলে নিজের সম্পত্তি বানিয়ে ফেলা ফিফা ব্যালন ডি’অরটা মেসির কাছ থেকে কেড়ে নিয়েছেন। গোলের রেকর্ড গড়ে জিতেছেন চ্যাম্পিয়নস লিগ। 

ইরানের কোচ কার্লোস কুইরোজ গত বিশ্বকাপে ছিলেন পর্তুগালের দায়িত্বে। এরও আগে ম্যানচেস্টার ইউনাইটেডে ফার্গু‌সনের সহকারীর ভূমিকায় খুব কাছ থেকে দেখেছেন রোনালদোর রোনালদো হয়ে ওঠা। ব্রাজিলে এসে সেই কুইরোজ ঘোষণা করে দিয়েছেন, ‘এটি হবে রোনালদোর বিশ্বকাপ। যাতে প্রমাণিত হবে, মেসির চেয়ে ও অনেক ভালো।’

১০১৪ বিশ্বকাপের জার্মানির বিপক্ষে পর্তুগালের প্রথম ম্যাচে রোনালদোকে খুঁজেই পাওয়া যায়নি। ছবি: গেটি ইমেজেস

জার্মানির বিপক্ষে রোনালদোকে দেখার পর কুইরোজ না তাঁর কথা ফিরিয়ে নেন! খেলতে পারবেন কি না, এ নিয়েই সংশয় ছিল। শেষ পর্যন্ত খেলেছেন, তবে চিনতে হয়েছে চেহারা আর জার্সি দেখে। সেই হতাশার প্রকাশও ঘটেছে মাঠে। ম্যাচের পরও। ‘জার্মান উপহার’ শুধু চার গোলেই সীমাবদ্ধ থাকেনি। সঙ্গে যোগ হয়েছে লাল কার্ড আর চোট। হতচকিত-ক্ষুব্ধ রোনালদো ম্যাচ শেষে মিক্সড জোনে সাংবাদিকদের সঙ্গে কোনো কথাই বলেননি। ‘মিডিয়ার সঙ্গে কথা বলার জন্য তিনজনকে ঠিক করা হয়েছে। আমি তাদের কেউ নই’ বলে ঝড়ের মতো বেরিয়ে গেছেন।

একটা জায়গায় মেসি-নেইমারের চেয়ে এগিয়ে থেকেই শুরু করেছিলেন বিশ্বকাপ। নেইমারের এটি প্রথম বিশ্বকাপ, রোনালদো-মেসির তৃতীয়। মেসির কাছে বিশ্বকাপ মানে কোয়ার্টার ফাইনালে বিদায়, রোনালদো একটি সেমিফাইনাল খেলেছেন। মেসির গোল ছিল একটি, রোনালদোর দুই। 

নেইমারের তো মাত্র শুরু। হিসাবের খাতায় এখনো কিছুই লেখা হয়নি। তবে মেসির মতো রোনালদোর ক্যারিয়ারেও একমাত্র অতৃপ্তির নাম বিশ্বকাপ। ২৯ বছর ফুটবলারদের ফর্মের তুঙ্গে থাকার বয়স। রোনালদোর জন্য এই বিশ্বকাপ সেই অতৃপ্তি ঘোচানোর সুবর্ণ সুযোগ, শেষ সুযোগও বটে। অথচ জার্মানি ম্যাচের আগে এই প্রশ্নটা করায় তেলেবেগুনে জ্বলে উঠেছেন, ‘আমার মনে হয় না, কাউকে আমার কিছু দেখানোর আছে। আমার পরিসংখ্যান দেখুন, সিভি দেখুন—আমার আর কিছুই প্রমাণ করার নেই।’

বয়সী এই পর্তুগাল দল নিয়ে যে বেশি দূর এগোনো যাবে না, সেটি বুঝেই কি না আগেই বলে রেখেছেন, ‘একজন খেলোয়াড়কে দিয়ে কোনো দল হয় না।’ কথাটায় কোনো ভুল নেই এবং মেসি আর নেইমারের সঙ্গে এখানেই রোনালদোর তফাত। ওই দুজনের ওপর দলের যতই নির্ভরতা থাক, ব্রাজিল-আর্জেন্টিনার আকাশে আরও অনেক তারা আছে। পর্তুগালের আকাশে সূর্য-চাঁদ-তারা সবই রোনালদো। যে কারণে কুইরোজ বলেছেন, ‘রোনালদো খেললে পর্তুগাল ১৪ জনের দল হয়ে যায়।’

মেসির মতো ক্লাব আর জাতীয় দলের পারফরম্যান্সে আকাশ-পাতাল পার্থক্যও কোনোকালেই ছিল না। জার্মানির বিপক্ষে নেমেছিলেন গোলের হাফ সেঞ্চুরি করার স্বপ্ন নিয়ে। ইউসেবিও-ফিগো-পলেতাদের পেছনে ফেলে দেশের পক্ষে সর্বোচ্চ গোলের রেকর্ডটি আগেই করে ফেলেছেন। সেটি বোধ হয় পর্তুগাল বলেই সম্ভব হয়েছে। মেসি-নেইমারের কাজটা যে অনেক বেশি কঠিন। আর্জেন্টিনার পক্ষে সর্বোচ্চ গোল বাতিস্তুতার, ৭৮ ম্যাচে ৫৬। আর ৭৭ গোল করে ব্রাজিলের রেকর্ডটিকে তো প্রায় অবিনশ্বর পর্যায়ে রেখে গেছেন পেলে। 

সাবেলা আসার আগে মেসি প্রসঙ্গে বাতিস্তুতার রেকর্ডের কথা কখনো ওঠেইনি। ৬১ ম্যাচে গোল ছিল যে মাত্র ১৭টি! ‘ক্লাবের হয়ে ভালো, দেশের হয়ে নয়’ কথাটা তো আর এমনি হতো না। সাবেলা-যুগে ২৬ ম্যাচে ২২ গোলে সংখ্যাটা এখন ৩৯।

সাবেলা-যুগে আরও একটা গোল। ছবি: গেটি ইমেজেস

জাতীয় দলের জার্সি গায়ে স্ট্রাইক রেটে সবচেয়ে এগিয়ে নেইমার। ৪৬ ম্যাচে ৩০ গোল করে ফেলেছিলেন, যা করতে মেসি ও রোনালদোর লেগেছিল ৭৪ ও ৮৬ ম্যাচ। বিশ্বকাপে ব্রাজিলের প্রথম ম্যাচের পর হিসাবটা দাঁড়িয়েছে ৫০ ম্যাচে ৩৩ গোল। অর্থাৎ মেসির চেয়ে ২৭ ম্যাচ কম খেলেও গোল কম মাত্র ৬টি।  

বল নিয়ে যেমন, তেমনি চুল নিয়ে খেলতেও বড় ভালোবাসেন নেইমার। বিরক্ত পেলে কি এমনি এমনি একবার বলেছিলেন, ‘খেলবে কী, ও তো হেয়ারস্টাইল নিয়েই বেশি ব্যস্ত।’ খেলোয়াড়দের অনেক কুসংস্কার থাকে। সাফল্য পেলে সেই সাজটাই ধরে রাখা যার মধ্যে সবচেয়ে কমন। নেইমার দেখা যাচ্ছে এসবের ধার ধারেন না। প্রথম ম্যাচে দুই গোল পাওয়ার পরও হেয়ারস্টাইল বদলে ফেলতে একবারও ভাবেননি। দুই পাশে কামিয়ে বাকি চুলে রুপালি রং করেছেন।

চুলে রুপালি রং। তবে চোখে যে স্বপ্নটা খেলছে, সেটির রং সোনালি। বিশ্বকাপ ট্রফিটার রং। নেইমারের মতো মেসিরও নিশ্চয়ই তা-ই। রোনালদো? যতই ডাকাবুকো হন না কেন, সিআর সেভেন সেই স্বপ্ন দেখার সাহস পাচ্ছেন বলে মনে হয় না।

শেয়ার করুনঃ
আপনার মন্তব্য
আরও পড়ুন
×