মেসি-বার্সার বিচ্ছেদ: যে প্রশ্নের উত্তরগুলো আপনি খুঁজছেন...

মেসি-বার্সার বিচ্ছেদ: যে প্রশ্নের উত্তরগুলো আপনি খুঁজছেন...

বিনা মেঘে বজ্রপাত বোধ হয় একেই বলে! যেদিন লিওনেল মেসির সঙ্গে বার্সেলোনার নতুন চুক্তি হবে বলেই খবর ভেসে বেড়াচ্ছিল চতুর্দিকে, সেদিনই এলো বার্সেলোনার সঙ্গে মেসির বিচ্ছেদের সংবাদ। জাগল হাজারটা প্রশ্নও। কেন মেসি থাকতে পারলেন না, মেসি কী বলছেন, এরপর কোথায় যাবেন, বার্সায় থাকার একদমই কী কোনো সুযোগ নেই....উৎপলশুভ্রডটকম-এর পাঠকদের জন্য থাকল এমন সব প্রশ্নের উত্তরই।

সন্ধ্যা পর্যন্ত সত্য জেনে আসা খবরটাই ঘণ্টাখানেক ব্যবধানে মোড় নিল ১৮০ ডিগ্রি। গুঞ্জনের প্রথম ধ্বনিটা উঠল মার্কার এক সংবাদে। জানানো হলো, লিওনেল মেসির বার্সেলোনায় থাকা ভীষণ দুরূহ। এরপরে সত্য-মিথ্যায় মোড়ানো নানান খবর শুনতে শুনতে বার্সা জানিয়ে দিল সেই অমোঘ বাণী, মেসি সত্যিই আর বার্সায় থাকছেন না।

সঙ্গে নতুন করে জন্ম হলো বেশ কিছু প্রশ্নের। উত্তরগুলো এক-এক করেই জানা যাক:

কেন থাকতে পারলেন না?

মেসির সঙ্গে চুক্তি নবায়নের চেষ্টা বার্সা করে আসছে গত বছর থেকেই। ক্লাবের স্পোর্টিং প্রকল্পে এক মৌসুম আগেও ভীষণ নাখোশ মেসি আস্থা খুঁজে পেয়েছিলেন হুয়ান লাপোর্তা বার্সা সভাপতি পদে ফেরত আসতেই। লাপোর্তাও সব সময়ই জানিয়েছেন, বার্সাই মেসির ঘর, আর মেসি ঘরেই থাকছেন।

তবে ঝামেলা বাঁধছিল এক জায়গাতেই, বার্সার আর্থিক দুর্দশা। বার্সার বিদায়ী সভাপতি জোসেপ বার্তোমেউর সময় কোনো পরিকল্পনা ছাড়া কেনা হয়েছিল একগাদা ফুটবলার, সঙ্গে যোগ হয়েছে করোনা মহামারীর ধাক্কা। এতেও সমস্যা হতো না, যদি উয়েফার আর্থিক বিধিনিষেধের শর্তগুলোই লা লিগা কর্তৃপক্ষ অক্ষরে অক্ষরে মেনে চলত। কিন্তু ২০১৩ সাল থেকে খেলোয়াড় কেনা-বেচায় স্প্যানিশ লিগগের কর্তারা বেড়ি পরিয়েছে আরও শক্তরকমে। তাদের শর্ত অনুযায়ী, প্রতি মৌসুমেই ক্লাবের আয়-ব্যয়ের হিসাবে ভারসাম্য থাকতে হবে, খেলোয়াড়দের বেতন-ভাতাও পরিশোধ করতে হবে ওই সাম্য বজায় রেখেই, নতুবা সই করা যাবে না নতুন খেলোয়াড়।

লাপোর্তা বারেবারেই জানিয়েছেন, মেসির চুক্তিটা ফেঁসে আছে এই শর্তেই। স্যামুয়েল উমতিতির মতো একাদশের বাইরের খেলোয়াড়দেরও বছরে ১২ মিলিয়ন ইউরো বেতন দিতে হয় বার্সাকে। দ্য অ্যাথলেটিক জানাচ্ছে, ২০১৯-২০ মৌসুমে খেলোয়াড়দের বেতন দিতে গিয়ে ব্লগরানা ক্লাবটাকে খরচ করতে হয়েছে ৬৭১ মিলিয়ন ইউরো। তখন সমস্যা না হলেও ক্লাবের আয় যেহেতু কমে এসেছে এখন, তাই শুরু হতে যাওয়া ২০২১-২২ মৌসুমে বার্সাকে খেলোয়াড়দের বেতনাদি বাবদ খরচ নামিয়ে আনতে হবে ১৬০ মিলিয়ন ইউরোর আশেপাশে। আগের চুক্তিতে যা পেতেন, তার চেয়ে অর্ধেক বেতনে বার্সায় থেকে যেতে সম্মত হলেও মেসিকে বার্সা রাখতে পারল না এ কারণেই। এরপরও তো ভারসাম্য আসছে না।

বার্সা অবশ্য চেষ্টা করেছিল সর্বোচ্চ। আতোয়াঁন গ্রিজমানকে দলবদলের বাজারে তুলতে চেয়েছিল, চেয়েছিল উমতিতি-পিয়ানিচদের ক্লাব ছাড়া করে বেতনের একটা দফারফা করতে। কিন্তু লাভ হয়নি কিছুতেই।

বার্সার তাই জানাতে হলো, 'লিওনেল মেসির সঙ্গে সব ধরনের ব্যক্তিগত চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়ে গেলেও লা লিগা কর্তৃপক্ষর নিয়ম-কানুনের কারণে মেসিকে রাখা গেল না'।

বার্সার সমস্যা ফুরোচ্ছে না এখানেই। মেম্ফিস ডিপাই, সার্জিও আগুয়েরো, এরিক গার্সিয়াদের মতো নতুন স্বাক্ষরিত খেলোয়াড়দের নাম নিবন্ধনেও জটিলতায় পড়তে হতে পারে তাদের।

সিভিসি ফার্মের কারবারটা কী?

মেসিকে বার্সেলোনায় রাখার একটা উপায় লা লিগা নিজেই করেছিল। অবশ্য নিজেদের স্বার্থেই। লা লিগা কর্তৃপক্ষ সিভিসি ইনভেস্টমেন্ট বলে একটা ফার্মের সঙ্গে চুক্তি করেছে, যারা ১০ শতাংশ লাভ স্প্যানিশ ফুটবল লিগের দলগুলোতে ২,৭০০ মিলিয়ন ইউরো বিনিয়োগ করবে। সব দল অবশ্য সমান অর্থ পাবে না, অর্থের ভাগ-বাটোয়ারা হবে টিভি-স্বত্বের ওপর ভিত্তি করে। সে হিসাবে বার্সেলোনার পাওয়ার কথা ছিল প্রায় ২৮৪ মিলিয়ন ইউরো। যা বার্সেলোনাকে বেতন-ভাতা পরিশোধের জন্য প্রায় ৪২ মিলিয়ন ইউরোর ব্যবস্থা করে দিত। বর্তমানের আর্থিক দৈন্যের কথা ভাবলে এই প্রস্তাব লুফে না নেওয়ার কোনো কারণই নেই।

কিন্তু সমস্যা বাঁধাচ্ছে এই চুক্তিরই আরও দুটো শর্ত। যা জানা যাচ্ছে, লা লিগা কর্তৃপক্ষ আগামী ৫০ বছরের জন্য তাদের লভ্যাংশ থেকে পাওয়া অর্থের ১০ শতাংশ দিতে সম্মত হয়েছে সিভিসি ফার্মকে, যার মধ্যে আছে ক্লাবগুলোর টিভি-স্বত্বের আয়ও। অথচ, ক্লাবগুলোর জন্য আয়ের সবচেয়ে বড় উৎস এটাই এবং অঙ্কটা প্রতিনিয়ত বাড়ছে। হিসাব করে দেখা যাচ্ছে, চুক্তিতে সম্মত হলে বার্সা কিংবা রিয়ালের মতো ক্লাবের কাছ থেকে টিভি-স্বত্ব বাবদ ১-২ বিলিয়ন হাতিয়ে নেবে সিভিসি ইনভেস্টমেন্ট।

আর দ্বিতীয়ত, এই চুক্তির ফলে লা লিগার সকল ব্যবসাতেই ১০ শতাংশের মালিকানা পাবে সিভিসি৷ যার মানেটা দাঁড়াচ্ছে, এখন অর্থসাহায্য নিলে ক্লাবগুলোতে অন্তত ৫০ বছরের জন্য আটকে যেতে হবে স্প্যানিশ ফুটবল লিগার জালে। ফলে ফ্লোরেন্তিনো পেরেজের নেতৃত্বে বার্সেলোনা আর রিয়াল মাদ্রিদ যে ইউরোপিয়ান সুপার লিগের স্বপ্ন দেখছে, ফেঁসে যাবে সেই পরিকল্পনাও।

রিয়াল মাদ্রিদ তাই আনুষ্ঠানিক বিবৃতি দিয়েই সিভিসি ইনভেস্টমেন্টের ওই প্রস্তাবকে উড়িয়ে দিয়েছে। মেসি নাকি সুপার লিগের মধ্যে দ্বিতীয় অপশন বেছে নিয়ে বার্সাও বুঝিয়ে দিয়েছে, তারা কী চাইছে।

মেসি কী বলছেন?

মিয়ামি-ইবিজা ঘুরে ফুরফুরে মেসি বার্সায় নেমেছিলেন এর বুধবারই। কথা ছিল, বৃহস্পতিবারই বার্সার সঙ্গে নতুন করে ৫ বছরের চুক্তির আনুষ্ঠানিকতা সেরে নেমে পড়বেন নতুন মিশনে। কিন্তু সবকিছু চূড়ান্ত হওয়া সত্ত্বেও শেষ মুহূর্তে তাল কেটে যাওয়ায় মেসি মানসিকভাবে একদম বিধ্বস্ত হয়ে পড়েছেন বলেই খবর। এখনই জনসম্মুখে কিছু বলছেন না, লাপোর্তার সততাতেই আস্থা রাখছেন, সমর্থকদের 'আলবিদা' না বলে বিদায়ও নেবেন না-- তবে আপাতত পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণেই সময় দিতে চাইছেন তিনি।

এরপর মেসি কোথায়?

মেসির দলবদল ঘিরে ঘুরেফিরে এসেছে দুটো ক্লাবের নামই-- প্যারিস সেন্ট জার্মেই আর ম্যানচেস্টার সিটি। এসেছে এবারও। তবে ম্যান সিটির চেয়ে পিএসজিই এবার মেসিকে নিজেদের ডেরায় ভেড়ানোর দৌড়ে এগিয়ে বলে অনুমান। বার্সার সঙ্গে মেসির বিচ্ছেদের খবর ফাঁস হওয়ার ঘণ্টাখানেকের মধ্যেই অ্যাস্টন ভিলা থেকে জ্যাক গ্রিলিশকে শত মিলিয়ন পাউন্ডে নিজেদের দলে টানার খবর জানিয়েছে সিটি কর্তৃপক্ষ, তাঁকে দেওয়া হয়েছে সিটির দশ নম্বর জার্সিও। এরপরও কি মেসির পেছনে ছুটবে সিটিজেনরা?

পিএসজিকেই তাই মানা হচ্ছে মেসির সম্ভাব্য দাবিদার। দলবদলের খবরাখবরের সবচেয়ে বিশ্বস্ত সংবাদদাতা ফ্যাব্রিজিও রোমানো জানিয়েছেন, পিএসজি ইতোমধ্যেই সরাসরি যোগাযোগও করেছে মেসির সঙ্গে। সার্জিও রামোস, জিয়ানলুইজি ডোনারুমা, জর্জিনিও ওয়াইনালদুম… এই মৌসুমে ফরাসি ক্লাবের 'ফ্রি এজেন্ট' ভাগ্যটাও তো এখন পর্যন্ত বেশ সুপ্রসন্নই।

দৌড়ে আছে বার্সাও!

মেসি থেকে যেতে পারেন বার্সাতেও, যদিও সুযোগটা একদমই ক্ষীণ। কোনো কোনো সূত্র বলছে, মেসির বিদায়ী বিজ্ঞপ্তিতে 'লা লিগার শর্তের কারণেই ছাড়তে হলো ওকে' জানিয়ে বার্সা সভাপতি হুয়ান লাপোর্তা আসলে চাপ তৈরি করতে চেয়েছেন লা লিগা কর্তৃপক্ষর ওপরে। রোনালদো ক্লাব ছেড়েছেন আরও তিন মৌসুম আগেই; মেসিও স্পেন ছাড়লে লা লিগা যে জৌলুশ হারাবে অনেকটাই, তা তো বলাই বাহুল্য। লা লিগা থেকে স্পন্সরদের আগ্রহ হারিয়ে ফেলাটাও অস্বাভাবিক নয়। অনেকের অভিমত, করোনা মহামারীর কারণে ইউরোপের অধিকাংশ লিগ কর্তৃপক্ষই যেখানে আর্থিক নিয়ম-নীতিতে ছাড় দিয়েছে, চাপে ফেলে লা লিগা সভাপতি হাভিয়ের তেবাসকে দিয়েও তেমন কিছু করাতে চাইছেন লাপোর্তা। নাটকের সমাপ্তি অঙ্কে তাই মেসির সঙ্গে বার্সার নতুন চুক্তির দৃশ্যটাও থাকতে পারে।

আর যদি এই মিরাকলটা না ঘটে? তবে আর কী, ২১ বছরে ওই মানুষটার জন্ম দেওয়া ২১০০ কোটি স্মৃতিই বার্সেলোনা ভক্তদের সম্বল হয়ে থাকবে।

সম্পর্কিত বিষয়:

শেয়ার করুনঃ
আপনার মন্তব্য
আরও পড়ুন
×