মেসিকে পেয়ে পিএসজির অন্য লাভ-২

অ্যাডাম ক্রাফটন

৬ সেপ্টেম্বর ২০২১

মেসিকে পেয়ে পিএসজির অন্য লাভ-২

লিওনেল মেসির মতো খেলোয়াড়েরা শুধু মাঠেই খেলেন না, মাঠের বাইরে ক্লাবের বাণিজ্যেও হয়ে দাঁড়ান বড় প্রভাবক। মেসিকে পেয়ে পিএসজি আর লিগ ওয়ানের লাভটা কোথায় কোথায় হবে, তা বিশ্লেষণের চেষ্টা করেছে `দ্য অ্যাথলেটিক`। উৎপলশুভ্রডটকম-এর পাঠকদের জন্য এরই অনূদিত রূপ। তিন পর্বের ধারাবাহিকের দ্বিতীয় পর্ব এখানে।

মোনাকো এবং বার্সেলোনার সাবেক এক বাণিজ্যিক কর্মকর্তার মতে, 'ক্রীড়া বাণিজ্যের জগতে ক্রিস্টিয়ানো রোনালদোকে তুলনা করা যেতে পারে বিগ ব্যাং-এর সাথে। তবে মেসিকে দলে টেনে পিএসজি সেটিকে ছাড়িয়ে যেতে পারে।' ক্রীড়া বাণিজ্যের খুব বড় একটা নিয়ামক হলো, সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে কোনো তারকা বা ক্লাবের অনুসারী কত বেশি। মেসিকে সই করানোর পর দুই সপ্তাহে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে পিএসজির অনুসারী প্রায় দুই কোটি বৃদ্ধি পেয়েছে। বিশেষ করে চীনে পিএসজির বিশাল একটা সমর্থক-গোষ্ঠী তৈরি হয়েছে। ২০১৮ সালে সাংহাইতে পিএসজি একটা ফ্যান পার্ক তৈরি করেছিল, যার লক্ষ্যই ছিল তরুণ চীনাদের মধ্যে থেকে ‘আগামীর নেইমার’ খুঁজে বের করা। তাছাড়া চীনের ইলেক্ট্রনিক সামগ্রী নির্মাতা প্রতিষ্ঠান হাইসেন্সের সাথে পিএসজির চুক্তি আরও পাকাপোক্ত হয়েছে।

তবে শুধু ক্লাব নয়, চীনা বাজারে পিএসজির এই বিপণনকে চীন-কাতার বাণিজ্যিক সম্পর্কের এক গুরুত্বপূর্ণ অনুষঙ্গও মনে করা হচ্ছে। গত জুলাই মাসে কাতারে কর্তব্যরত চীনা রাষ্ট্রদূত কাতারকে চীনের সবচেয়ে ঘনিষ্ঠ বাণিজ্য সহযোগী বলে ঘোষণা করেছেন। চীনা দৈনিক দ্য গ্লোবাল টাইমসের মতে, পিএসজির সাথে মেসির চুক্তি টুইটারের চীনা সংস্করণ সিনা উইবোতে কোটিবারের উপরে আলোচিত হয়েছে।                

এখন এখানে দুটি বিষয় জড়িত আছে। এক. সোশ্যাল মিডিয়ায় ফ্যান-ফলোয়ার বাড়া মানেই কি সরাসরি বিক্রিবাট্টা বাড়া? দুই. মেসির ক্যারিয়ার শেষের দিকে, দুই বা তিন বছর পর মেসি যখন অবসর নেবেন, তখন কি পিএসজি একটা বিশাল সংখ্যক ফ্যান-ফলোয়ার হারিয়ে ফেলবে?

প্রথম প্রশ্নের উত্তর পেতে পারেন এই তথ্যে, ২০১১ সালে যখন কাতারি বিনিয়োগকারীরা পিএসজির মালিকানা কিনে নেয়, তখন তাদের অন্যতম উদ্দেশ্য ছিল প্যারিস সেন্ট-জার্মেই ব্র্যান্ডকে আন্তর্জাতিক প্রচারের আলোয় নিয়ে আসা। ২০১১ সালের জরিপ অনুযায়ী পিএসজির সমর্থক-গোষ্ঠীর মাত্র ৫ শতাংশ ছিলেন ফ্রান্সের বাইরের। কিন্তু সাম্প্রতিক জরিপ অনুযায়ী, পিএসজির সমর্থক-গোষ্ঠীর প্রায় ৯৫ শতাংশই ফ্রান্সের বাইরের।প্যারিসে মেসি। ছবি: প্যারিস সেন্ট-জার্মেই

পিএসজি আর ম্যানচেস্টার ইউনাইটেড মতো দুই ক্লাবের বাণিজ্যিক বিপণন নিয়ে কাজ করা ব্রেট হার্টমান জানাচ্ছেন, 'একটা বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠান যখন কোনো ক্লাবের সাথে আলোচনায় যায়, তার মূল ভিত্তিই থাকে সোশ্যাল মিডিয়ায় সেই ক্লাবের ফ্যান-ফলোয়ার কেমন। আমি যখন ম্যানচেস্টার ইউনাইটেডের হয়ে কাজ করতাম, তখন আমার মূল কাজ ছিল প্রিমিয়ার লিগের অপর পাঁচ বড় ক্লাবের তুলনায় আমাদের সংখ্যার প্রাধান্যটা তুলে ধরা। কারণ আমি জানতাম, শেষ পর্যন্ত সংখ্যাটাই আসল।'   

প্রায় একই সুরে কথা বলছেন মোনাকো এবং বার্সেলোনার সাবেক সেই বাণিজ্যিক কর্মকর্তাও, 'ইউরোপের শীর্ষ আটটি ক্লাবের স্পন্সর ঘুরে-ফিরে হাতে গোনা কয়েকটি প্রতিষ্ঠানই এবং তাদের বাণিজ্যিক প্রতিযোগিতার ক্ষেত্রটাও প্রায় একই। ভক্তরা হয়তো কে কয়টা উয়েফা চ্যাম্পিয়নস লিগ জিতল, কয়টা ট্রফি জিতল, কারা কত গোল করল...এগুলো দেখে। কিন্তু স্পন্সরদের চোখ থাকে বাণিজ্যিক সম্ভাবনায়; আর সেখানে বার্সেলোনা, রিয়াল মাদ্রিদ, জুভেন্টাস এবং পিএসজি তাদের চোখে প্রায় সমান। তারা ট্রফি নয়, দেখে ক্লাবটির তারকাদীপ্তি কতটুকু, কত মিলিয়ন ফ্যান-ফলোয়ার আছে ক্লাবটির।'       

লিভারপুল ফুটবল ক্লাবের গ্লোবাল সেলসের সাবেক প্রধান রাফায়েলা ভেলেন্তিনো জানাচ্ছেন, 'সোশ্যাল মিডিয়ায় আপনার যখন এক লাখ ফলোয়ার থাকবে, তখন আপনি যেকোনো ব্র্যান্ডের সাথে খুব আত্মবিশ্বাসের সাথে দর কষাকষি করতে পারবেন এই বলে যে, আমাদের সঙ্গে যুক্ত হলে অতি সহজেই তুমি বিশাল সংখ্যক প্রচারণা পেয়ে যাচ্ছ। তবে অধিক প্রচারণা মানেই অধিক মুনাফা, সেটা অবশ্য না-ও হতে পারে।'   

সেই নাটকীয় বৃহস্পতিবার, যেদিন বার্সেলোনা ঘোষণা করল মেসির সাথে চুক্তি করা সম্ভব নয়, সেদিন সন্ধ্যায় মেসি ফোন করেছিলেন মরিসিও পচেত্তিনোকে। শুধু এটুকু জানাতে, পচেত্তিনো চাইলে মেসি পিএসজিতে খেলতে ইচ্ছুক। খবর পেয়েই নাসের আল খেলাইফি হিসাবের খাতা নিয়ে বসিয়ে দেন ক্লাবের হেড অব স্পন্সরশিপ মার্ক আর্মস্ট্রংকে, ক্লাব-মেসি দুই পক্ষই লাভবান হবে এমন একটা খসড়া চুক্তি তৈরি করতে। ব্রেট হার্টম্যানের ভাষায় ব্যাপারটা এমন, 'আপনার সামনে একটা সাদা হোয়াইট বোর্ড দেয়া হলো। বলে দেওয়া হলো, সময় আছে দুই বা তিন বছর, আর আমাদের হাতে আছে লিওনেল মেসি। এবার বলো, কী কী করা সম্ভব? সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের ফ্যান-ফলোয়ার তো আছেই, একেবারে ইউনিক একটা ব্যাপার পিএসজির পক্ষে আছে, যেটা আর কারও নেই। সেটা ‘কাতার বিশ্বকাপ ২০২২’। কাতারি স্পন্সররা বিশ্বকাপের মূল প্রচারণার কাজটা করতে চান প্যারিস শহরকে কেন্দ্র করে, আর সেই শহরেই এখন আছেন লিওনেল মেসি। বাণিজ্য বেসাতির কী অসীম এক সম্ভাবনা!'পিএসজির প্রচারণার বড় হাতিয়ার মেসি

তবে কাঁড়ি কাঁড়ি টাকা বিনিয়োগ করেও যে সমস্যাটার সমাধান পিএসজি করতে পারছে না, সেটা ফ্রেঞ্চ লিগের ব্র্যান্ড ভ্যালু বাড়ানো। সমালোচকদের কাছ থেকে 'কৃষকের লিগ' বলে খোঁটা খাওয়া লিগ ওয়ান এই মৌসুমের শুরুতে পেয়েছে নতুন আরেক দুঃসংবাদ। এতদিন ইউরোপের পঞ্চম সেরা লিগের স্বীকৃতি পেলেও এখন সেই জায়গাটা দখলে করেছে পর্তুগিজ লিগ, ফ্রেঞ্চ লিগ ওয়ান এখন ছয় নম্বরে। মেসি পিএসজিতে নাম লিখিয়েছেন, এই খবর প্রচারের পর লিগ ওয়ান কর্তৃপক্ষ এখন জোর চেষ্টা করছে ফ্রান্সের বাইরে যেসব অঞ্চলে লিগ ওয়ান প্রচারিত হয় না সেসব জায়গায় টিভি-স্বত্ব বিক্রির। যেমন, ভারতীয় নেটওয়ার্ক 'ভায়াকম ১৮' উপমহাদেশে লিগ ওয়ান প্রচারের দায়িত্ব নিতে যাচ্ছে। তাছাড়া ভিয়েতনাম টেলিভিশন (ভিটিভি)-ও তাদের দেশে আগামী তিন মৌসুম লিগ ওয়ান সম্প্রচার করবে। এর আগে কখনো লিগ ওয়ান ভিয়েতনামের কোন টিভিতে সরাসরি দেখানো হয়নি। এমনকি ফ্রান্সের প্রতিবেশী বেলজিয়ামেও এ বছর থেকে লিগ ওয়ান প্রচারের ব্যবস্থা হচ্ছে, যেখানে গত তিন বছর ফরাসি লিগের সরাসরি সম্প্রচার হতো না।

মজার বিষয় হলো, লিগ ওয়ানের হয়ে এই বাণিজ্যিক প্রচার-প্রচারণাটি করছে কাতারের বিইন টেলিভিশন নেটওয়ার্ক, যেটার মালিক নাসের আল খেলাইফি। এসব নতুন নতুন অঞ্চলে লিগ ওয়ান পৌঁছে দেওয়ার চুক্তিতে ফরাসি কর্তৃপক্ষের তেমন কোনো আর্থিক লাভ কিন্তু হবে না। লাভের ধান্দা খেলাইফি সাহেব এখন করছেনও না। তাঁর উদ্দেশ্য হলো, নতুন বাজার, ভক্ত, দর্শক সৃষ্টি করা, যেখান থেকে থেকে দীর্ঘ মেয়াদে মুনাফা অর্জন করা যাবে। মেসি-রোনালদোর কল্যাণে লা লিগা আমেরিকার মতো জায়গায় বড় একটা ফ্যানবেজ তৈরি করতে সক্ষম হয়েছে। ইংলিশ প্রিমিয়ার লিগের বিশাল সমর্থক-গোষ্ঠী আছে সিঙ্গাপুরে। লিগ ওয়ানে এক্ষেত্রে চীনা বাজারকে লক্ষ্য করেছে।   

এই মুহূর্তে ফরাসি লিগ ওয়ানের বাজারমূল্য মৌসুমপ্রতি মাত্র ৭২৫ মিলিয়ন ইউরো, অর্থাৎ দেশে এবং দেশের বাইরে খেলা সম্প্রচার করে লিগ ওয়ানের আয় ৭২৫ মিলিয়ন, যে অর্থটা ক্লাবগুলো ভাগাভাগি করে নেয়। সমস্যা হলো, ইউরোপের শীর্ষ পাঁচ লিগের মধ্যে লিগ ওয়ান বাদে বাকি সব লিগের মৌসুমপ্রতি আয় এক বিলিয়ন পাউন্ডের উপরে। ইংলিশ প্রিমিয়ার লিগের আয় তো প্রায় পাঁচ বিলিয়ন পাউন্ড। বিইন স্পোর্টস তাই চেষ্টা করছে, লিগ ওয়ানের প্রচারের জন্য দক্ষিণ আমেরিকার বাজার ধরতে। কারণ, দক্ষিণ আমেরিকার সেরা দুই ফুটবলার মেসি ও নেইমার এখন ফরাসি লিগের অংশ।

'দ্য অ্যাথলেটিক' থেকে ভাষান্তর: আজহারুল ইসলাম 

চলবে...

সম্পর্কিত বিষয়:

শেয়ার করুনঃ
আপনার মন্তব্য
আরও পড়ুন
×