পোর্তোকে ইউরোপ-সেরা বানিয়ে বৃহত্তর জগতে পা

টম ওরভিল্লি

২৪ সেপ্টেম্বর ২০২১

পোর্তোকে ইউরোপ-সেরা বানিয়ে বৃহত্তর জগতে পা

শুরুটা হয়েছিল ২০০০ সালে। ২০২১ সালে এসে ম্যানেজার হিসেবে এক হাজারতম ম্যাচে ডাগ আউটে দাঁড়িয়েছেন জোসে মরিনহো। তাঁর আগে যা করতে পেরেছেন মাত্র তিনজন। উত্থান-পতনে ভরা মরিনহোর এই হাজার ম্যাচের পেছনের গল্পটা দারুণভাবে তুলে এনেছে `দ্য অ্যাথলেটিক`। উৎপলশুভ্রডটকম-এর পাঠকদের জন্য সেটির অনূদিত রূপ। দ্বিতীয় পর্ব এখানে।

সব ধরনের প্রতিযোগিতা মিলিয়ে মরিনহোর অধীনে খেলেছেন ৩৮৩ জন ফুটবলার। এদের মাঝে যেমন রয়েছেন জন সুইফট ও আন্দ্রে ভিলাস-বোয়াসের মতো মাত্র এক মিনিট খেলা ফুটবলার; তেমনি রয়েছেন রিকার্ডো কারভালহো এবং পাওলো ফেরেরার মতো তারকাও, যাঁরা খেলেছেন ১০ এবং ছয় মৌসুম।

কোচ জোসে মরিনহোর শুরুটা বেনফিকায়। সেখানে কোনো বড় তারকা না থাকলেও কয়েকজন তরুণ সম্ভাবনাময় ফুটবলার ঠিকই নজরে পড়েছিলেন মরিনহোর। গোলপোস্টে প্রয়াত রবার্ট এনকে, ডিফেন্স সামলানোর দায়িত্বে স্প্যানিয়ার্ড কার্লোস মার্কেনা আর আক্রমণভাগে ছিলেন প্রাক্তন সেল্টিক ও নটিংহাম ফরেস্ট স্ট্রাইকার পিয়ের ফন হুইডঙ্ক।বেনফিকায় মরিনহো। ছবি: গেটি ইমেজেস

তবে মিডফিল্ডার মানিকেই সম্ভবত মরিনহোর সবচেয়ে প্রিয়পাত্র ছিলেন। পর্তুগিজ এই ফুটবলার মরিনহোর অধীনে খেলেছেন আড়াই মৌসুম-- ২০০২-০৪ সালে পোর্তো এবং ২০০৫-০৬ মৌসুমের দ্বিতীয়ার্ধে ধারে চেলসির হয়ে।

বেনফিকা-অধ্যায় শেষে ২০০১ সালে লেইরিয়ায় শুরু নতুন অধ্যায়। সেখানে ডিফেন্ডার নুনো ভ্যালেন্তে, মিডফিল্ডার টিয়াগো (এই টিয়াগো মেন্দেজ নন) এবং ব্রাজিলিয়ান স্ট্রাইকার দার্লেই মরিনহোর নজরে আসেন আলাদা ভাবে। পরবর্তী সময়ে মরিনহো তাঁদের পোর্তোতেও নিয়ে আসেন।

বেনফিকা ও লেইরিয়ায় শিরোপা জিততে পারেননি জোসে। শুরু হয় পোর্তোকে নিয়ে নতুন যাত্রা। মরিনহো ওই সময়ের পর্তুগালের কিছু সেরা প্রতিভাকে একত্র করেন তাঁর দলে। রাইট ব্যাকে পাওলো ফেরেইরা ও মিডফিল্ডে ডেকো ছিলেন মরিনহোর নির্ভরতার প্রতীক। আক্রমণভাগে দার্লেইর সঙ্গে ছিলেন প্রতিভাবান তরুণ ফুটবলার হেল্ডার পস্তিগা। মরিনহোর প্রথম শিরোপা জয়েও বড় ভূমিকা ছিল এঁদের। তারপর থেকে তাঁর ইতিহাস গড়ার পালা চলছেই। একের পর এক সাফল্য এসে ধরা দিয়েছে মরিনহোর হাতে।

বেনফিকা-পোর্তোর মাঝে লেইরিয়ার দায়িত্ব নিয়েছিলেন মরিনহো৷ ছবি: গেটি ইমেজেস

মরিনহো সবচেয়ে বড় সাফল্য পান ২০০৩-২০০৪ মৌসুমে। সে মৌসুমে লিগ, পর্তুগিজ সুপার কাপ জয়ের পাশাপাশি চ্যাম্পিয়নস লিগও জিতেছিল পোর্তো। ফাইনালে তাদের প্রতিপক্ষ ছিল ফ্রেঞ্চ জায়ান্ট মোনাকো। দেশমের সেই মোনাকো বেশ তারকা সমৃদ্ধই ছিল। প্যাট্রিক এভরা, লুডোভিক গিলি, ফার্নান্দো মুরিয়েন্তেস, এমানুয়েল আদেবায়োরের মতো তারকায় ভরপুর ছিল ফ্রেঞ্চ দলটি।

কিন্তু তাতে কী-বা আসে যায়! ফাইনালে ওঠার পথে পোর্তো হারিয়ে এসেছিল রিয়াল মাদ্রিদ ও চেলসির মতো জায়ান্টদের, তাই তাদের সঙ্গী ছিল উত্তুঙ্গ আত্মবিশ্বাস। অথচ এই স্কোয়াডেও ছিল অনেক নতুন মুখ। যাদের মধ্যে অন্যতম দক্ষিণ আফ্রিকার বেনি ম্যাকার্থি, সার্জিও কনসেইকাও (পোর্তোর বর্তমান ম্যানেজার) এবং হোসে বোসিংওয়া। ক্লাবের সাফল্যে বড় ভূমিকা ছিল দক্ষিণ আফ্রিকান ফরোয়ার্ড ম্যাকার্থির। ২০০৩-০৪ মৌসুমে গোল করেছিলেন ২৪টি। সব মিলিয়ে, মরিনহোর অধীনে মাত্র ৫৮ ম্যাচেই ৩৮ গোল করেন ম্যাকার্থি।

পোর্তোর এই সাফল্যই বৃহত্তর ফুটবল দুনিয়ার দুয়ার খুলে দেয় মরিনহোর সামনে। মরিনহোর পরবর্তী গন্তব্য ছিল চেলসি। রাশান বিলিওনিয়ার রোমান আব্রামোভিচ দেদারসে টাকা ঢালতে শুরু করেন তারকা খেলোয়াড়দের পেছনে। রেনেঁ থেকে কেনেন গোলকিপার পিওতর চেককে। আগে থেকেই দলে ছিলেন জন টেরি, তার সাথে যোগ দেন পোর্তোর রিকার্দো কারভালহো। ডিফেন্সিভ মিডফিল্ডার হিসেবে ছিলেন ক্লদ ম্যাকেলেলে। আর দুই ইংলিশ মিডফিল্ডার ফ্র্যাঙ্ক লাম্পার্ড ও জো কোলকে দেওয়া হয়েছিল সেন্ট্রাল মিড নিয়ন্ত্রণের দায়িত্ব। রাইট উইংয়ে আগের সিজনেই দলে আসা ড্যামিয়েন ডাফকে রাখা হয়, আর লেফট উইঙ্গার হিসেবে পিএসভি থেকে উড়িয়ে আনা হয় আরিয়ান রোবেনকে।যখন পোর্তোর দায়িত্বে। ছবি: গেটি ইমেজেস

এবার দরকার একজন স্ট্রাইকার। ক্লাব রেকর্ড ভেঙে মার্শেই থেকে চেলসিতে এলেন দিদিয়ের দ্রগবা। প্রতিটি পজিশনেই প্রতিপক্ষকে ধরাশায়ী করার মতো দল তৈরি। সাথে ছিল স্পেশাল ওয়ানের ট্যাকটিকস। আর কি চাই! ইতিহাস তৈরির গল্পের শুরু তো এভাবেই হয়!

ওই মৌসুমে প্রিমিয়ার লিগের তখনকার রেকর্ড ৯৫ পয়েন্ট নিয়ে চ্যাম্পিয়ন হয় চেলসি, পুরো সিজনে হারে মাত্র একটি ম্যাচ। লিগে গোল খায় মাত্র ১৫টি। মরিনহো চেলসিতে ছিলেন মাত্র তিন মৌসুম, তাতেই জিতে নেন ছয়টি ট্রফি। সবচেয়ে বড় ব্যাপার হলো, তাঁর আমলেই প্রিমিয়ার লিগের এলিট ক্লাব হিসেবে উঠে আসে চেলসির নাম।

ইংল্যান্ড জয় শেষে এবার ইতালি জয়ের পালা। মরিনহো যান ইন্টার মিলানে। ইন্টার মিলান সব সময়েই কিছু না কিছু জিতেছে, সেটা লিগ হোক বা কাপ। তবে একটা শিরোপা জয়ের স্বপ্ন কোনোভাবেই পূরণ করতে পারছিলেন না ইন্টার মিলান সভাপতি। চ্যাম্পিয়নস লিগ!চেলসির ঘরে। ছবি: গেটি ইমেজেস

চ্যাম্পিয়নস লিগ জিততেই ইন্টার সভাপতি নিয়ে আসেন স্পেশাল ওয়ানকে। আর তিনি সাফল্যের ধারা বজায় রাখলেন ইন্টারে এসেও।

মরিনহোর ইন্টার মূলত ৪-১-২-১-২ ছকে খেলত। গোলপোস্ট সামলানোর দায়িত্ব ছিল দুর্দান্তভাবে খেলার গতিবিধি বুঝতে পারা ব্রাজিলের হুলিও সিজারের হাতে। সামনে ডিফেন্ডার হিসেবে আর্জেন্টিনার ওয়াল্টার স্যামুয়েল ও নতুন আসা লুসিও। রাইটব্যাকে আরেক ব্রাজিলিয়ান মাইকন, আর বাঁ দিকে দলের কিংবদন্তি অধিনায়ক আর্জেন্টাইন ডিফেন্ডার হাভিয়ের জানেত্তি।

দুই সেন্টারব্যাকের সামনে ডিফেন্সিভ মিডফিল্ডার হিসেবে ছিলেন আর্জেন্টিনার এস্তেবান কাম্বিয়াসো। দুই স্ট্রাইকার হিসেবে খেলতেন দিয়েগো মিলিতো ও স্যামুয়েল ইতো। তবে দলের প্রয়োজনে মিলিতোকে একক স্ট্রাইকার হিসেবে রেখে প্রায় সময়েই ডান বা বাঁ উইংয়ে খেলতেন ইতো, ফুলব্যাকদের নিরাপত্তা দিতেন।

মরিনহোর এই দলটাকে রক্ষণাত্মক বলা হলেও আসলে কিন্তু তা ছিল না। দলের প্রত্যেক ফুটবলার আক্রমণাত্মক-রক্ষণাত্মক ফুটবল ভুলে মরিনহোর দর্শনেই খেলতেন। ফলাফল তো রেকর্ড বইয়েই দেখা যাচ্ছে। যে স্বপ্ন নিয়ে ইন্টার সভাপতি জোসেকে এনেছিলেন, সে স্বপ্ন অক্ষরে অক্ষরে পূরণ হয়েছে। ইন্টার জিতেছিল ট্রেবল।ইন্টারের হয়ে চ্যাম্পিয়নস লিগ জয়ের পর

মিলান জয়ের পর স্পেশাল ওয়ানের পরবর্তী পরীক্ষা ছিল মাদ্রিদে। যে দলে মরিনহোর আগের দলগুলোর চেয়ে সম্ভাবনাময় ফুটবলার ও তারকা, দুটিই বেশি ছিল।

সে সময়ে রিয়ালে যোগ দেন মেসুত ওজিল, আনহেল ডি মারিয়া, সামি খেদিরার মতো সম্ভাবনাময় ফুটবলার। সাথে ছিলেন চেলসি থেকে আসা রিকার্দো কারভালহোর মতো পুরোনো শিষ্যও।

চ্যাম্পিয়নস লিগ জিততে না পারলেও ম্যাচ প্রতি ২.৬৭ গোল করেছিলেন মরিনহো শিষ্যরা, গড় হিসেবে যা মরিনহোর পোর্তোর চেয়েও ভালো। তবে রিয়াল মাদ্রিদের সেই তারকাসমৃদ্ধ দল নিয়ে এমন পরিসংখ্যান মোটেই বিস্ময়কর ছিল না।

২০১৩-১৪ মৌসুমে চেলসিতে প্রত্যাবর্তন ঘটান মরিনহো। মরিনহো সেখানে পেয়ে যান চেক, জন টেরির মতো পুরোনো শিষ্যদের। পাশাপাশি বর্তমান সময়ের সেরা কেভিন ডি ব্রুইনা, মোহাম্মদ সালাহ, রোমেলো লুকাকুর মতো ফুটবলাররা তখন আলো ছড়ানোর আভাস দিচ্ছেন মাত্র। যদিও তিনজনের কেউই মরিনহোর ট্যাকটিকসে থিতু হতে পারেননি। তিনজনে সর্বসাকুল্যে খেলেছেন মাত্র ৬৭৪ মিনিট।

২০১৪-১৫ মৌসুমে চেলসিতে ছিল অনেকটা নতুন মুখের ছড়াছড়ি। এ সময়ে চেলসিতে দ্রগবা ফিরে আসলেও ক্লাব কিংবদন্তি ল্যাম্পার্ড যুক্তরাষ্ট্রের মেজর সকার লিগের (এমএলএস) দল নিউইয়র্ক সিটিতে, আর অ্যাশলি কোল ইতালির রোমায় যোগ দিয়েছিলেন। কিন্তু তারপরও নতুন পুরোনো ফুটবলারদের দারুণ সমন্বয় ও স্পেশাল ওয়ানের স্পেশাল ট্যাকটিকসে লিগ শিরোপা ওঠে চেলসির ঘরে।

এ সাফল্যের কারণে চেলসি বোর্ড মরিনহোর এঙ্গে চার বছরের চুক্তি করে। তবে পরের মৌসুমের শুরুটা ভালো করতে না পারায় ২০১৫-এর ডিসেম্বরে ক্লাব ছেড়ে দেন মরিনহো।

পাড়ি জমান ম্যানচেস্টার ইউনাইটেডে।

চলবে...

'দ্য অ্যাথলেটিক' থেকে ভাষান্তর: শাওন শেখ শুভ

শেয়ার করুনঃ
আপনার মন্তব্য
আরও পড়ুন
×