মেসি-গার্দিওলা: সম্পর্ক অতটা সহজও ছিল না

উৎপলশুভ্রডটকম

২৯ সেপ্টেম্বর ২০২১

মেসি-গার্দিওলা: সম্পর্ক অতটা সহজও ছিল না

ম্যানচেস্টার সিটি-প্যারিস সেন্ট জার্মেই মুখোমুখি হচ্ছে উয়েফা চ্যাম্পিয়নস লিগের গ্রুপ পর্বের ম্যাচে। ম্যাচটা মুখোমুখি দাঁড় করিয়ে দিচ্ছে পেপ গার্দিওলা-লিওনেল মেসিকেও। বার্সেলোনার হয়ে একত্রে যাঁরা জিতেছিলেন ১৪ শিরোপা। কিন্তু ওই শিরোপাজয়ের পথে কি সংঘাতও হয়নি? কথা-কাটাকাটি? তর্ক-বিতর্ক?

ছবিটা তো কল্পনা করে নেওয়া যাচ্ছে খুব সহজেই। দু'দিক থেকে এগিয়ে আসছেন লিওনেল মেসি-পেপ গার্দিওলা, হাসি-হাসি মুখে আলিঙ্গনে বাঁধলেন একে অন্যকে, যাঁর যাঁর ডাগআউটে ফেরত যাওয়ার আগে পরস্পরকে জানালেন শুভকামনা….যে ছবি দেখতে দেখতে বার্সেলোনা সমর্থকরা হারিয়ে যাবেন নস্টালজিয়ায়।

দুজনে একত্রে চারটা মৌসুম কাটিয়েছেন, বার্সেলোনাকে পরিণত করেছিলেন সর্বজয়ী এক দলে, জিতেছেন ১৪টা শিরোপা। 'সেরা হতে পারেন' থেকে মেসি 'সেরা' হয়ে উঠেছেন তাঁর সময়েই।

পরবর্তী সময়ে দুজনের পথ আলাদা হয়ে গেলেও শ্রদ্ধার ঘাটতি দেখা যায়নি কোনোপক্ষেই। প্রশ্ন তো তাই হতেই পারে, দুজনের মধ্যে এমন চমৎকার রসায়নের সূত্র কি? কেমন ছিল দুজনের চার বছরের বার্সেলোনা অধ্যায়? ওই সময়ে একবারের জন্যেও কি মনোমালিন্য হয়নি দুজনের? নাকি কথা-কাটাকাটির বিন্দুবিসর্গ সুযোগ সৃষ্টি না করেই দুজনে এগিয়ে গেছেন যন্ত্রের মতো?

***

২০০৮ সালের জুনে যখন বার্সেলোনার মূল দলের দায়িত্ব নিলেন গার্দিওলা, নিজের প্রথম সংবাদ সম্মেলনেই জানিয়েছিলেন, 'আমরা মেসির ঘাড়ে পুরো দলের বোঝা চাপিয়ে দিতে পারি না। মেসি কিংবা বার্সা--কারও জন্যেই এটা সুফল বয়ে আনবে না।'একসঙ্গে দুজনে জিতেছেন সবই। ছবি: গেটি ইমেজেস

গার্দিওলা মেসিকে বুঝতে পেরেছিলেন খুব ভালো। জাভি-ইনিয়েস্তার মতো খেলোয়াড়দের সঙ্গে ঘণ্টার পর ঘণ্টা আলাপ করলেও মেসি কম কথা বলা মানুষদের পছন্দ করেন বলে তাঁর সঙ্গে সংক্ষেপেই কথা সারতেন গার্দিওলা। মেসির জন্যেই ম্যাচ নিয়ে খুব ভালো প্রস্তুতি নিতে হতো তাঁকে। ট্যাকটিক্যাল নির্দেশনা দেওয়ার ক্ষেত্রেও কিছুটা চাতুর্যের আশ্রয় নিতেন তিনি। সরাসরি মেসিকে গিয়ে 'তোমাকেও প্রেস করতে হবে' নির্দেশ না দিয়ে পুরো ড্রেসিং রুমকে উদ্দেশ্য করে বলতেন, 'মেসি এমনটা করবে। তখন তোমাদের ওটা করতে হবে।'

মাঠে মেসির পারফরম্যান্সের গ্রাফটা ঊর্ধ্বমুখী করতে দায়িত্ব নিয়েই তাঁর খাদ্যাভ্যাসে বেড়ি পরিয়েছিলেন গার্দিওলা। কোক, পিজ্জা, চকোলেট, পপকর্ন...মেসি তখন খেতে পারেননি কোনো কিছুই। বল পায়ে না থাকলে প্রতিপক্ষকে প্রেস করতে হয় বার্সার সব খেলোয়াড়কেই, ওই দায়িত্ব থেকে রেয়াত পাননি মেসিও।

মেসির ঘাড়ে দলের সমস্ত দায়-দায়িত্ব চাপাতে না চাইলেও মেসিকে কেন্দ্র করেই দল সাজিয়েছিলেন গার্দিওলা। মেসিকে খুশি করাতেই প্রাধান্য দিয়েছিলেন তিনি। যার প্রমাণ পাওয়া যাচ্ছে ২০০৮ সালে স্কটল্যান্ডে বার্সেলানোর প্রাক-মৌসুম ক্যাম্পের একটা ঘটনায়। মেসি চাইছিলেন পরের মাস থেকে বেইজিংয়ে বসতে যাওয়া অলিম্পিকে আর্জেন্টিনার হয়ে খেলতে। কিন্তু বার্সা চাইছিল, মেসিকে উইসলা ক্র‍্যাকোর বিপক্ষে উয়েফা চ্যাম্পিয়নস লিগের বাছাইপর্বের জন্য রেখে দিতে। এ নিয়ে দু'পক্ষে কথা চালাচালি হয়েছিল ভালোই, সমঝোতায় তখন এগিয়ে এসেছিলেন গার্দিওলা। লাপোর্তাকে গিয়ে বুঝিয়েছিলেন, মেসিকে এখন ছাড়লে স্বল্পকালীন কিছু ক্ষতি হতে পারে, তবে আখেরে লাভবান বার্সাই হবে।

মেসির জন্য এমন অনেক ছাড়ই গার্দিওলা দিয়েছিলেন। এমনিতে সবাইকে নিয়ন্ত্রণে রাখতে চাওয়া গার্দিওলার সামনেই ড্রেসিংরুমে বসে কোক খেয়েছিলেন মেসি, সেটাও ম্যাচের ঠিক আগে আগে। কখন বিশ্রাম নেবেন, এই ব্যাপারেও নিজের সিদ্ধান্তই চূড়ান্ত বলেই জানিয়ে দিয়েছিলেন কোচকে। আর মেসি তো কখনোই মাঠের বাইরে থাকতে চান না! ২০১১-১২ মৌসুমেই যেমন; রিয়াল সোসিয়েদাদের বিপক্ষে একটা নিয়মরক্ষার ম্যাচে তাঁকে বিশ্রাম দিয়েছিলেন গার্দিওলা, পরদিন আর অনুশীলনেই আসেননি মেসি। গার্দিওলাও আর জলঘোলা করেননি এ নিয়ে। মেসিকে মৌসুমের বাকি ম্যাচগুলোর প্রতিটিতেই মাঠে নামিয়েছিলেন মেসিকে। মেসি ওই মৌসুম শেষ করেছিলেন ৭৩ গোল নিয়ে।

মেসির জন্য বাকি খেলোয়াড়দের ওপর কাঁচি চালাতেও দ্বিধা বোধ করেননি গার্দিওলা। রোনালদিনহো, জলাতান ইব্রাহিমোভিচ, স্যামুয়েল ইতোদের ছেড়ে দিয়ে মেসিকেই দলের কেন্দ্রীয় চরিত্র বানিয়েছিলেন গার্দিওলা। জাভি, ইনিয়েস্তা, ডেভিড ভিয়ারাও জানতেন, মেসির জন্য সেরা জায়গায় বল বাড়ানোটাই তাদের কাজ।

সময়ে সময়ে মেসিরও খুব সম্ভবত নিজের স্পর্শাতীত উপস্থিতি জানান দেওয়ার ইচ্ছে হতো। ২০০৯ সালে যেমন, বার্সায় যোগ দেওয়ার পরপরই সেন্টার-ফরোয়ার্ডের ভূমিকাটা নিজের করে নিয়েছিলেন ইব্রা, গোলও করেছিলেন শুরু থেকেই। ওই সময়ই মেসির ফোন থেকে গার্দিওলার কাছে এক বাক্যের একটা বার্তা গিয়েছিল, যাতে লেখা ছিল, 'যা দেখতে পাচ্ছি, আমি আর দলের জন্য গুরুত্বপূর্ণ নই, সুতরাং…'২০১৫ সালে বায়ার্ন মিউনিখের হয়ে লিওনেল মেসির মুখোমুখি হয়েছিলেন লিওনেল মেসি। ছবি: গেটি ইমেজেস

কথার ভেতরে অভিমানের সুরটা এখনো টের পাওয়া যাচ্ছে পরিষ্কার। আর মেসি তো নিজেও জানতেন, গার্দিওলার প্রকল্পের মূল হর্তাকর্তা তিনিই। তাঁর অধীনে সব কিছু জিতেছিলেন বলে কোচ গার্দিওলার প্রতিও আলাদা একটা শ্রদ্ধাবোধ আছে মেসির। যার আরেকপ্রস্থ প্রমাণ পাওয়া গিয়েছিল গত বছরই, বার্সাকে ব্যুরো ফ্যাক্স পাঠানোর আগেই গার্দিওলাকে বার্তা পাঠিয়েছিলেন মেসি। জানিয়েছিলেন, খেলতে চান তাঁর দলে।

গার্দিওলারও মেসি-মুগ্ধতা যে কমেনি এখনো, তা তো বোঝা গেছে অনেকবারই। বিশ্বাস না হলে ২০১৬ সালের সেপ্টেম্বরের ওই সংবাদ সম্মেলনের উক্তিগুলোই আরেকবার পড়ুন। কেভিন ডি ব্রুইনা তখন এতটাই দারণ খেলছিলেন যে, ডি ব্রুইনা আর মেসি সমপর্যায়ের কি না, তা নিয়ে প্রশ্ন তুলতে শুরু করেছিলেন অনেকে। গার্দিওলা উত্তরটা দিয়েছিলেন খুব সংক্ষেপ, 'ধরুন একটা টেবিল। মেসি ওখানে একাই বসে আছে।'

আর ডি ব্রুইনা?

'পাশেই আরেকটা টেবিল আছে। কেভিন ওখানে বসতে পারে।'

দ্য অ্যাথলেটিক অবলম্বনে রিজওয়ান রেহমান সাদিদ

সম্পর্কিত বিষয়:

শেয়ার করুনঃ
আপনার মন্তব্য
আরও পড়ুন
×