গাভি যেন জাভিই!

কাশীনাথ ভট্টাচার্য

৭ অক্টোবর ২০২১

গাভি যেন জাভিই!

দুই প্রজন্মের লড়াই: স্পেনের গাভি বনাম ইতালির কিয়েলিনি

টানা ৩৬ ম্যাচ অপরাজিত ইতালির জয়রথ থামিয়ে দেওয়ার কাজটা করল যে স্পেন, সেই স্পেনের ১৭ বছর বয়সী এক খেলোয়াড় বারবার মনে করিয়ে দিলেন জাভির কথা। নামেও কী মিল! গাভি! উয়েফা নেশনস লিগের সেমিফাইনালের স্পেনও যেমন পাসিংয়ের পসরা মেলে ধরে মনে করিয়ে দিল জাভি-ইনিয়েস্তাদের সেই অনিন্দ্য সুন্দর স্পেনকে।

‘গাভি’ নামটা বিশ্ববিখ্যাত। গরীব দেশগুলিতে বাচ্চাদের টিকাকরণ বিষয়ে কাজ করে চলেছে গত বছর একুশ। কোভিড-১৯ অতিমারি রুখতেও কাজ করেছে যেমন, সমালোচিতও হয়েছে কাজের ধরণ, টাকার জোগান এবং সংস্থায় প্রকৃত বিশেষজ্ঞদের অভাবের কারণে। কিন্তু, অস্বীকারও করা যায়নি তাদের প্রচেষ্টা পুরোপুরি, যে কারণে ২০২১ সালে নোবেল শান্তি পুরস্কারের জন্য মনোনয়নও পেয়েছিল।

কিন্তু, এ এক অন্য গাভি-র গল্প। এই গাভির সঙ্গে সব অর্থেই মিল বিখ্যাত জাভির। খেলেন একই জায়গায়, একই রকম নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা, ৯০ মিনিটের খেলায় নিজের ছাপ রেখে যান বারবার। বল-ধরে-খেলা আর সরবরাহ, পরিভাষায় যাকে ডিস্ট্রিবিউশন বললে ফুটবল-পাঠক চট করে ধরতে পারেন কী বলা হচ্ছে। তাঁর জায়গা মাঝমাঠের ডান দিকের সাইড লাইন বরাবর। কিন্তু ঢুকে আসেন ভেতরে প্রায়ই। আক্রমণ শুরু করেন, গুরুত্বপূর্ণ ট্যাকল করেন বিপক্ষের অর্ধে। কিন্তু এই সবের চেয়েও যা অনেক বেশি গুরুত্বপূর্ণ, তাঁর পায়ে বল থাকলে মাঠের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিপক্ষের ডিফেন্সিভ থার্ড-এ সৃজনশীলতার দেখা পাওয়া যায়।

জার্সি দেখেই বুঝতে পারছেন, এটা বার্সেলোনার গাভি

তাঁর বয়স? মাত্রই ১৭ বছর দু-মাস! লা লিগায় মাত্র ২৭৯ মিনিট খেলেছেন। হ্যাঁ, বার্সেলোনায়, অবশ্যই। মনে রাখা যেতে পারে, ১১ বছর বয়সেই যোগ দিয়েছিলেন বার্সেলোনার একাডেমিতে। ছোট চেহারা, পাঁচ ফুট আট ইঞ্চি উচ্চতা। মনে পড়তেই পারে জাভিয়েস্তাকে। তাঁদের কারও উচ্চতাও এমন কিছু ছিল না। জিমচর্চিত শরীরও নয়। কিন্তু ফুটবল মাঠে পাসিং-এ এনেছিলেন যুগান্তর। পাবলো মার্তিন পায়েজ গাভিরার পায়ে সেই দশ বছর আগের বার্সেলোনার ছাপ। যখন পজেশনের পাশাপাশি দ্রুতগতির পাসিং-এ ফুটবলকে অন্য গ্রহের মনে করিয়ে দিতেন মেসি-জাভি-ইনিয়েস্তারা। একটা ম্যাচ দেখেই জাভির সঙ্গে তুলনা নয়। শুধুই মনে করিয়ে দেওয়া, খেলার ধরনে আগমার্কা জাভির ছাপ যে!

লুইস এনরিকে একসময় কোচ ছিলেন বার্সেলোনায়। বড় ফুটবলার ছিলেন। রিয়াল মাদ্রিদ এবং বার্সেলোনায় চুটিয়ে খেলা তার প্রমাণ। কোচ হিসাবে তাঁর আমলেই সর্বশেষ বার্সেলোনা পেয়েছিল ইউরোপ জয়ের স্বাদ, ২০১৫ সালে। পেপ গার্দিওলার বার্সেলোনার পাসিং-এর সঙ্গে এনরিকে যোগ করেছিলেন বাস্তবতা। সব সময়ই বল পায়ে খেলার নীতি না-মানতে চেয়ে। অনেকেই তাঁকে গোঁয়ার বলেছিলেন, এখনও বলা হয়। কিন্তু নিজের সিদ্ধান্তে অটল থাকেন। বার্সেলোনাকে তিন বছরে ৯টি ট্রফি আর মোট ৭৫ শতাংশ জয় আনতে সাহায্য করেছিলেন। তাঁর আমলেই বার্সেলোনার শেষ দাপট, ক্লাব ফুটবলে।

ইতালির জয়রথ থামিয়ে দিয়ে সেমিফাইনালে উঠে যাওয়ার আনন্দে লুই এনরিকের আলিঙ্গনে গাভি

এখন এনরিকে দায়িত্বে আছেন স্পেনের। নতুন করে সাজিয়ে তুলছেন দল। আর এই নতুন স্পেনে তাঁর অন্যতম ভরসা গাভি। হয়ত জাভির ছায়া দেখেছেন বলেই সতেরর টিনএজার-কে শুরু থেকেই মাঠে রেখেছিলেন ইউরো চ্যাম্পিয়নদের বিপক্ষে। ঐতিহাসিক সান সিরোয় সে অভিষেকের মর্যাদা রেখেই মাঠ ছাড়লেন গাভি!

৩৭ ম্যাচ অপরাজিত থাকার পর রবার্তো মানচিনির ইতালি মুখ থুবড়ে পড়ল নিজেদের দেশেই। নেশনস লিগের সেমিফাইনালে হারতে হলো স্পেনের কাছে, ১-২। প্রথমার্ধেই ০-২ পিছিয়ে এবং কিয়েলিনির প্রাথমিক অনুপস্থিতিতে অধিনায়কের আর্মব্যান্ড ছিল যাঁর, বোনুচ্চি, ৪২ মিনিটেই দ্বিতীয় হলুদ কার্ড দেখে মাঠের বাইরে। বোনুচ্চি বেরিয়ে যাওয়ার পরই দ্বিতীয় গোল। ইতালি তবুও দশজনে চেষ্টা করেছিল, ৮৩ মিনিটে ব্যবধান কমিয়েওছিল কিয়েসা-পেলেগ্রিনি সমঝোতায়। কিন্তু, প্রথমার্ধের স্পেন যেন ফিরিয়ে নিয়ে গিয়েছিল সেই ২০০৮-২০১২ পর্বে, যখন স্পেন মানেই বিপক্ষ বল খুঁজতে খুঁজতে হয়রান হয়ে মাথা কুটে মরবে!

প্রমাণ? ইউরোজয়ীদের এই ম্যাচে বল পজেশন মাত্রই ২৫ শতাংশ! দ্বিতীয়ার্ধে দশজনের ইতালিকে পেয়ে যেন খেলাই করছিলেন বুসকেতসরা, ৮২ শতাংশ সময় বল নিজেদের পায়ে রেখে। মনে পড়তে বাধ্য ২০০৮ ইউরো ফাইনালে হেরে যাওয়ার পর জার্মান বুলডোজার বাস্তিয়ান শোয়ানস্টাইগারের কথা। ‘খেলব কী? বল খুঁজতে খুঁজতেই তো ম্যাচ শেষ!’

এই দুই দেশই মাস তিনেক আগে মুখোমুখি হয়েছিল ইউরোর সেমিফাইনালে। নির্ধারিত এবং অতিরিক্ত সময় শেষে ১-১, টাইব্রেকারে জিতে ফাইনালে গিয়েছিল ইতালি। ফুটবলে আগের কোনো হারের প্রতিশোধ সে-অর্থে হয় না। এই ম্যাচটা জিতে যে আর ইউরো ২০২০-র ফাইনালে উঠতে পারবে না স্পেন!

তাই সান সিরোয় এই ম্যাচ জিতে উঠে গেল নেশনস লিগের ফাইনালে, আগামী রবিবার যে ফাইনাল হবে মিলানের এই মাঠেই। প্রতিপক্ষ দেশ জানা যাবে বৃহস্পতিবার রাতে ফ্রান্স-বেলজিয়াম ম্যাচের পর। তবুও যে-নিশ্চয়তা দিয়েই দেওয়া যায়, আন্তর্জাতিক আরও একটি ট্রফির কাছাকাছি পৌঁছে গেল স্পেনের এই নতুন প্রজন্ম, পুরনো দিনের ঝলক ফিরিয়ে এনে।

ইনি স্পেনের গাভি, মাঠে নেমেই যিনি গড়ে ফেলেছেন ইতিহাস

দুটি গোলই ফেরান তোরেসের। ইংল্যান্ডের কাগজ যেমন লিখেই থাকে, হাস্যকরভাবে ফেরানের নামের আগে জুড়ল ‘ম্যানচেস্টার সিটি’-র নাম! ফেরানের উঠে-আসা ভালেন্সিয়ার একাডেমি থেকে, যেখানে ছয় বছর বয়সেই যোগ দিয়েছিলেন। ২০১৭ সালে ভারতে আয়োজিত অনূর্ধ্ব-১৭ বিশ্বকাপে স্পেনকে ফাইনালে তুলতে বিরাট ভূমিকা নিয়েছিলেন ফেরান, কোয়ার্টার এবং সেমিফাইনালে যথাক্রমে ইরান ও মালির বিরুদ্ধে গোল পেয়ে এবং সেই সময়ই পরিচিতি আমাদের সঙ্গে। ভারতে আসার আগেই স্পেনের অনূর্ধ্ব-১৭ দল ইউরো চ্যাম্পিয়ন হয়েছিল। বিশ্বকাপ থেকে ফেরার পর ভ্যালেন্সিয়ার প্রথম দলে সুযোগ এবং গত বছর দেড়েক আছেন সিটিতে। তাই ফেরানের নামের আগে সিটি-র উল্লেখ অপ্রয়োজনীয় তো বটেই, ইংরেজদের বাহাদুরির অনৈতিক প্রয়াসও।

স্পেনে আগে ছিলেন ফার্নান্দো তোরেস। ভবিষ্যতে ফেরানও ফার্নান্দোকে টপকে যাওয়ার সম্ভাবনা দেখাচ্ছেন। ২১ ম্যাচে ১২ গোল এখনই। আর ফেরানের বয়সও সবে একুশ। সবসময় এমন হবে না, ঠিক। তবু, ঠিক সময়ে ঠিক জায়গায় হাজির থাকা এবং গোলের গন্ধ পাওয়ার ব্যাপারে ফার্নান্দোকে মনে করাচ্ছেন বারবার। প্রথম গোল শিন-বোন দিয়ে, দ্বিতীয় গোল হেডে দোনারুমাকে উল্টোদিকে যাওয়ার সময়টুকু না দিয়ে। আদর্শ স্ট্রাইকার!

তবে, দ্বিতীয়ার্ধে মিনিট চারেক মাঠ থেকেই উঠে যেতে হলো ফেরানকে। চোট পেয়েছেন, বোঝা গেল চেয়ারে আইসপ্যাকিং নিয়ে চিকিৎসকদের হাজিরায়। কিন্তু তাঁর পরিবর্তে যিনি নামলেন, সেই ইয়েরেমি পিনাই বা কম কীসে! ডানপ্রান্ত দিয়ে যা দৌড়ালেন অভিষেকে, স্পেনের ফুটবল ভবিষ্যৎ নিয়ে চিন্তার কারণ খুব বেশি নেই। ওইয়ারজাবাল, সারাবিয়া, আলোনসোদের পায়ে সুরক্ষিত সেই ভবিষ্যৎ।

একই সঙ্গে অবশ্যই উল্লোখযোগ্য দুই তথাকথিত বুড়োর পারফরম্যান্সও। বুসকেতস আর কোকে। বুসকেতস, বিশেষ করে। মাঝমাঠে একটা সময় ছিল, যেখানে বল সেখানে বুসকেতস। বহুদিন পর আবারও যেন সেই ভূমিকায়। বোনুচ্চিকে দ্বিতীয় হলুদ কার্ড দেখাতে বাধ্য করা ছেড়েই দিন, বুসকেতস সম্পর্কে পরিভাষায় যে-শব্দটা ব্যবহৃত হতো, ‘ফালক্রাম’, বাংলায় তার প্রতিশব্দ ঠিক কী হওয়া উচিত, জানা নেই। কিন্তু যা নিয়ে সমস্যা নেই, মাঝমাঠে তাঁকে ঘিরেই আবর্তিত স্পেন। কখন দিক পাল্টাতে হবে, কখন কোন প্রান্তে এক অরক্ষিত অবস্থায় বিপক্ষকে সবচেয়ে বেশি বেসামাল করতে পারেন – বুসকেতসকে ভাবতে হলো না একবারও। এই ম্যাচটা হয়ত স্পেন অধিনায়ক বুসকেতসেরও ফিরে-আসার।

গাভিকে আটকাতে জার্সি টানার পথেও হাঁটতে হলো ইতালিয়ানদের

তা হলে ইতালি? ২৫ শতাংশ বল নিয়েও বিপক্ষের গোল শট রাখল বেশিবার। যখনই বলের দখল পেয়েছে, চেষ্টা করেছে দ্রুত প্রতি আক্রমণে যেতে এবং চোখ টেনে নিলেন আরও এক তরুণ তারকা কিয়েসা, আবারও। আর হ্যাঁ, বোনুচ্চি লাল কার্ড দেখে বেরিয়ে যাওয়ার পরও প্রমার্থে তিন মিনিট এবং সংযুক্ত সময়ের খেলা বাকি ছিল। জর্জিও কিয়েলিনি তখন ওয়ার্ম আপ করছিলেন। মাঠে এলেন দ্বিতীয়ার্ধে এবং বোঝালেনও, প্রথমার্ধের ওই বাকি সময়টুকুর জন্য যদি তৎক্ষণাৎ মাঠে আনা হত কিয়েলিনিকে, বলা যায় না, হয়ত, দ্বিতীয় গোল না-ও হতে পারত।

হ্যাঁ, ফেরান-গাভির মিলিত বয়সের সমান হলেও, এখনও রক্ষণে স্তম্ভই থেকে গিয়েছেন কিয়েলিনি!

সম্পর্কিত বিষয়:

শেয়ার করুনঃ
আপনার মন্তব্য
আরও পড়ুন
×