পেলে কেন পেলে

উৎপল শুভ্র

২৩ অক্টোবর ২০২১

পেলে কেন পেলে

প্রথম বিশ্বকাপে ব্রাজিলের উৎসবের মধ্যমণি

গোলসংখ্যা কিছুটা বলে, বিশ্বকাপ জয়ের সংখ্যাও। তারপরও কি তাতেই পুরো বোঝা যায় পেলে-মহিমা? একজন ফুটবলার খেলোয়াড়ি জীবনেই কিভাবে `সর্বকালের সেরা খেলোয়াড়`-এর স্বীকৃতি পেয়ে যান, এই প্রশ্নের উত্তর তো খোঁজার মতোই। কোথায় আলাদা ছিলেন পেলে? কী তাঁর মাহাত্ম্য?

২৮ জুন ২০০৬, মিউনিখ

সকালে ফিফার মিডিয়া চ্যানেলে গিয়ে দেখি, পেলের বিশাল এক ইন্টারভিউ। যাতে তিনি ছুঁয়ে গেছেন এখন পর্যন্ত বিশ্বকাপের ভালো-মন্দ, সেরা পারফরমার, সম্ভাব্য বিজয়ী—এমন সব বিষয়ই। ফুটবল নিয়ে পেলে যা বলেন, তা-ই খবর। যদিও বিশ্বকাপের আগে সম্ভাব্য বিজয়ীর ব্যাপারে যে ভবিষ্যদ্বাণী করেন, খবর না হয়ে সেটি গোপন থাকলেই সম্ভবত তিনি খুশি হতেন! সেসব ভবিষ্যদ্বাণী যে পুরোপুরি মাঠে মারা যায়। মাঝখানে তো একটা রসিকতাই চালু হয়ে গিয়েছিল, সম্ভাব্য বিশ্বকাপজয়ী হিসেবে পেলে তাদের নাম বলে ফেলেন কি না—রীতিমতো আতঙ্কিত হয়ে থাকে শিরোপাপ্রত্যাশী অনেক দল। পেলের ফেবারিট হওয়া মানেই যে ব্যর্থতা নিশ্চিত!

পেলের ইন্টারভিউটা পড়তে পড়তে মনে মনে মেলাচ্ছিলাম, আমি ইন্টারভিউ করার সুযোগ পেলে কী কী প্রশ্ন করতাম! ইন্টারভিউ করার একটা উদ্যোগ নিয়েও ছিলাম। মিউনিখে জাপানের বিপক্ষে ম্যাচ শুরুর আগে ভিআইপি গ্যালারিতে পেলেকে দেখার পরই ঠিক করেছিলাম, হাফ টাইমের সময় সম্রাটের কাছে যাওয়ার একটা চেষ্টা করব। শুনেছি পেলে খুব সজ্জন। অনেকের চোখেই খেলাধুলার ইতিহাসে সবচেয়ে বড় সুপারস্টার, অথচ তারকাসুলভ অহমিকা একেবারেই নেই। সাধারণ মানুষদেরও মানুষ বলেই জ্ঞান করেন। বাংলাদেশ বলে-টলে সেভাবে চাইলে কি আর একটা দিতেন কি না কে জানে! চাওয়ার সুযোগটাই তো পেলাম না। ভিআইপি গ্যালারির সিঁড়ির গোড়াতেই যে আটকে দিল নিরাপত্তারক্ষীরা। সাংবাদিক পরিচয় দেওয়ায় উল্টো জানানো হলো, সাংবাদিকরাই নিষিদ্ধ তালিকার এক নম্বরে। পেলে বা ম্যারাডোনা মাঠে এলে সাংবাদিকরা তাঁদের ওপর এমনভাবেই হামলে পড়ে যে, ফিফা কর্মকর্তা 'ভিআইপি গ্যালারিতে নিষিদ্ধ' তালিকায় প্রথমেই সাংবাদিকদের রাখতে নির্দেশ দিয়ে গেছেন নিরাপত্তারক্ষীদের। কিছুক্ষণের মধ্যেই আরও বেশ কজন সাংবাদিককে একই উদ্যোগ নিয়ে একই জবাব পেতে দেখার পর বুঝে ফেললাম, এখানে দাঁড়িয়ে থাকা পণ্ডশ্রম ছাড়া আর কিছুই নয়। চর্মচক্ষে ফুটবল ঈশ্বরকে দেখার ইচ্ছে তো পূরণ হয়েছেই—কী আর করা, তাতেই খুশি থাকি!

খেলোয়াড় হিসেবে যত বড় ছিলেন, বিশ্লেষক হিসেবে যে তা নন, এর একটা ব্যাখ্যাই আমি খুঁজে পাই। যিনি যত সহজাত খেলোয়াড়, খেলার টেকনিক্যাল বিশ্লেষণে তিনি তত অসমর্থ। ক্রিকেটের গ্যারি সোবার্সও তো এর বড় উদাহরণ। মনে আছে, একবার ভারত-ওয়েস্ট ইন্ডিজ একটা ওয়ানডেতে সোবার্স কমেন্ট্রি করছেন। ওপেনিংয়ে শচীন টেন্ডুলকার ও অজয় জাদেজার বড় একটা পার্টনারশিপ দেখতে দেখতে সোবার্স বলে বসলেন— এই দুই ব্যাটসম্যানের মধ্যে খুব বড় কোনো পার্থক্য তিনি দেখতে পাচ্ছেন না! কোথায় টেন্ডুলকার, আর কোথায় জাদেজা— আমি বেশ কিছুক্ষণ স্তম্ভিত হয়ে বসে ছিলাম। শুধু ব্যাটসম্যান হিসেবেই সোবার্স সর্বকালের সেরাদের ছোট্ট দলে থাকেন। এর সঙ্গে ইচ্ছেমতো পেস-স্পিন বোলিং করার ক্ষমতা, যেকোনো পজিশনে দুর্দান্ত ফিল্ডিং—সোবার্স ছিলেন সত্যিকার এক ন্যাচারাল। কত হয়েছে এমন—আগের রাতের পার্টি থেকে ভোররাতে হোটেলে ফিরে পরদিন মাঠে নেমে ঠিকই অতিমানবীয় পারফরম্যান্স। সোবার্সের আত্মজীবনীতেই আছে এসবের বর্ণনা। অনায়াসেই সব করতে পারতেন বলেই হয়তো 'কীভাবে কী, কেন কী বোঝার দরকারই পড়ত না।

পেলেরও তো প্রায় একই ঘটনা। ফুটবল মাঠে এমন সব অত্যাশ্চর্য কীর্তি করেছেন, পরে যেসব ভিডিওতে দেখে পেলে নিজেই অবাক হয়ে বলেছেন, সেকেন্ডের ভগ্নাংশের মধ্যে আমি সিদ্ধান্তটা কেমন করে নিয়েছিলাম! পেলের খেলায় সিদ্ধান্ত নেওয়ার ব্যাপারটি ছিল খুব গুরুত্বপূর্ণ। কোনো কিছুই যে সরলভাবে করতেন না! বিচিত্র উদ্ভাবনীক্ষমতা এবং মাঠে তা প্রয়োগের সাহসের কারণেই তো পেলে পেলে হয়েছিলেন। সেসব আগে থেকেই ভেবেচিন্তে নেওয়া সিদ্ধান্ত নয়, তাৎক্ষণিকভাবে মাঠে নেওয়া। ১৯৭০ বিশ্বকাপজয়ী ব্রাজিলিয়ান অধিনায়ক কার্লোস আলবার্তো তো এক লাইনেই মূর্ত করে তুলেছিলেন পেলে-মহিমা—'পেলে মানেই হলো ইম্প্রোভাইজেশন'।

পেলে। ছবি: পপারফটো

মজার ব্যাপার হলো, পেলের উদ্ভাবনীশক্তির সবচেয়ে বড় উদাহরণ হয়ে আছে যে দুটি ঘটনা, তার কোনোটি থেকেই গোল হয়নি। ১৯৭০ বিশ্বকাপে চেকোস্লোভাকিয়ার বিপক্ষে ম্যাচে মাঝবৃত্তে বল পেয়ে হঠাৎ দেখলেন, প্রতিপক্ষ গোলরক্ষক ভিক্টর গোললাইন ছেড়ে একটু সামনে এগিয়ে এসেছেন। ৬৫ গজ দূর থেকে পেলে যে শটটি নিলেন, সেটি যে অল্পের জন্য গোল হলো না, তার হয়তো একটিই কারণ। মানুষ যে তাহলে তাকে আসলেই অতিমানবীয় কিছু ভেবে নিত! পেলের চিন্তার দ্রুততা, অসম্ভবকে সম্ভব মনে করার দুঃসাহস মাঠের বাকি খেলোয়াড়দের বিমূঢ় করে দিয়েছিল।

অন্যটিও ওই ১৯৭০ বিশ্বকাপেই এবং সেটি আরও অভিনব। উরুগুয়ের বিপক্ষে কোয়ার্টার ফাইনালে পেলের ওই কাজটিকে 'বিচিত্র চিন্তার দুঃসাহস', 'অসম্ভবের প্রতি আনন্দময় অভিযান', 'মানুষের সৃজনশীলতার অন্যতম শ্রেষ্ঠ প্রকাশ’–এত সব বলেও বিশেষজ্ঞরা তৃপ্তি পাননি। কী করেছিলেন পেলে? বাঁ দিক থেকে একটা আড়াআড়ি থ্রু বল ধরতে গেলে তাঁর দুদিকের গতিপথই আটকে দেন উরুগুইয়ান গোলরক্ষক মাজেরকুয়েজ। বল, পেলে ও গোলরক্ষক একই সরলরেখায়। এবার পেলে কী করতে পারেন! যা করলেন, তা কারও কল্পনাতেও ছিল না। ডামি খেলে বলটা ছেড়ে দিলেন। বল যেদিকে যাচ্ছিল, সেদিকেই যেতে লাগল। আর পেলেও যেদিকে যাচ্ছিলেন, সেদিকেই যেতে লাগলেন। গোলরক্ষকের ভারসাম্য হারিয়ে ফেলার দশা হলো। আর পেলে সঙ্গে সঙ্গে গোলরক্ষকের পেছনে টার্ন নিয়ে দৌড়ে গিয়ে বলটা ধরলেন, একজন ডিফেন্ডার প্রথম পোস্টে চলে এসেছেন দেখে কোমরের অবিশ্বাস্য মোচড়ে বল ঘুরিয়ে দিলেন দ্বিতীয় পোস্টের দিকে। এক ইঞ্চির জন্য পোস্টের পাশ দিয়ে বল চলে যায় বাইরে। অনেকে বলেন, গড়িয়ে গড়িয়ে ঢুকে যায় ইতিহাসে। মাজেরকুয়েজ পরে বলেছিলেন, এটা ছিল তাঁর খেলোয়াড়ি জীবনের সবচেয়ে অস্বাভাবিক পরিস্থিতি। কিছুক্ষণের জন্য সংজ্ঞা হারিয়ে ফেলার দশাও হয়েছিল বলে জানান তিনি।

মাজেরকুয়েজের কথাটা পেলের জন্য বড় প্রশস্তি। এমন প্রশস্তি কতই না হয়েছে। ববি চার্লটন একবার বলেছিলেন, ফুটবলের হয়তো সৃষ্টিই হয়েছিল এই জাদুকরী খেলোয়াড়ের জন্য। আরও ভালো বলেছিলেন ১৯৭০ বিশ্বকাপ ফাইনালে ব্রাজিলের প্রতিপক্ষ ইতালির ডিফেন্ডার তারসিজিও বার্গোমিচ, “আমি নিজেকে বলছিলাম, 'সে ও তো আমার মতো রক্ত-মাংসেরই মানুষ'। আমি ভুল বুঝেছিলাম।"

ঠেকানো দায়! ছবি: পপারফটো

সেই বিশ্বকাপের সময়ই আইটিভি ওয়ার্ল্ড কাপ প্যানেলের দুই আলোচকের কথোপকথনের একটা অংশ তো ক্লাসিক হয়ে আছে।

ম্যালকম অ্যালিসন: তুমি কীভাবে পেলে বানান করো? প্যাট ক্রেনাল্ড 'সহজ। জি-ও-ডি।'

পেলেকে নিয়ে তার বাবার কথাটা তো আরও ক্লাসিক। 'আমার জীবনের সেরা গোলটি সেলেস্তের সঙ্গে ওয়ান-টু খেলে করা। আমরা তার নাম দিয়েছি এডসন আরান্তেস দো নাসিমেন্তো: পেলে সেলেস্তে কে? পেলের মা!

তবে পেলে সম্পর্কে এত পড়েছি, আমার চিরকালীন প্রিয় হয়ে আছে কলকাতার কবি প্রসূন বন্দ্যোপাধ্যায়ের ফুটবল-বিষয়ক অসাধারণ বই 'ফুটবল ঘরানা: বিপ্লব ও বিবর্তন-এ পেলে-বিষয়ক কয়েকটি লাইন। পড়তে পড়তে প্রায় মুখস্থই হয়ে গেছে। আপনিও পড়তে চান? আমার ধারণা আপনাকেও মুগ্ধ হতে হবে। তাহলে পড়েই ফেলুন:

পেলে। এ রকম যদি কোনো একটি প্রতিযোগিতা হয় যে একটি নাম যা সর্বাধিক সংখ্যায় জীবিত মানুষের জানা আছে, আমি নিশ্চিত, পেলের নাম আসবে এক নম্বরে। তার সম্ভাব্য প্রতিযোগী হতে পারেন যিশুখ্রিষ্ট, হজরত মুহাম্মদ, গৌতম বুদ্ধ, আলেকজান্ডার, নেপোলিয়ান, হিটলার, ম্যারাডোনা ও গর্বাচভ।

পেলের মতো একজন 'ঈশ্বর প্রেরিত’ দূত না এলে ফুটবল-ধর্ম এত প্রচার পেত কি না, আমার সন্দেহ আছে। সারা পৃথিবীকে খেলাটির প্রতি এই মায়াবন্ধনে বাঁধতে পারত কি না সে সন্দেহও আছে। একজন মানুষ যে জীবনে যদি ফুটবল খেলা নাও দেখে থাকে পেলে তাকে দাঁড় করিয়ে দিয়েছেন। স্তম্ভিত করে দিয়েছেন। তার কল্পনাকে দিয়েছেন খোরাক ও নিজে সেই কল্পনাকে ছাপিয়ে চলে গেছেন। কেন পেলেই পেলে, অন্য কেউ পেলে নয়? বহু খেলোয়াড় দারুণ বল রিসিভ করেন,দারুণ শট মারেন, দুর্ধর্ষ ড্রিবল করেন, অপূর্ব পাস দেন। এর বেশি পেলে কী করেছেন? হ্যা পেলে এর বেশি করেছেন যেটা, তা হলো 'আশ্চর্যভাবে করেছেন যা ই করুন না কেন। আমরা পেলের কি দেখে মুগ্ধ হই যা আর অন্য কারও মধ্যে পাওয়া যায় না? তা হলো, চিন্তাভাবনার অদ্ভুতত্ব, আশ্চর্যতা, অসম্ভবতা, দুনিয়াছাড়া বৈচিত্র্য। প্রতিটি চেষ্টাতেই পেলে যে সফল হয়েছেন তা তো নয়, কিন্তু তার প্রতি কাজেই লেগে থাকত একটি বিচিত্র চিন্তাশীল মস্তিষ্কের ছায়া। আর তার এই ভাবনার অভাবনীয় গতিপথই মানুষকে পাগল করে তুলত। একটি বিশেষ অবস্থায় বিপক্ষ, সপক্ষ, দর্শক, সারা পৃথিবীর মানুষ যা ভাবছেন সেই সম্ভাবনার সংখ্যা যদি এক কোটিও হয়, পেলে সব সময়ে এক কোটি এক নম্বরটা ভেবেছেন, তার প্রত্যেকটি কাজের মধ্যে সেই ছাপ রয়ে গেছে। ডায়াগাম অংশে আমি এ রকম একটি সম্পূর্ণ অসম্ভব চিন্তনের ছবি গ্রন্থিত করেছি। গোল হয়নি, কিন্তু ইতিহাস হয়েছিল।

পেলের মাহাত্ম্য বর্ণনায় অনেকেই বলেন দু পায়ে মারাত্মক শট, দু পায়েই দারুণ কন্ট্রোল, অসাধারণ অ্যাথলেটিক শরীর। সবই ঠিক, কিন্তু ওগুলো কিছুই না, ওগুলো 'স্টক' প্রশংসা, এ দিয়ে পেলেকে আরেকজন বড় খেলোয়াড়ের থেকে আলাদা করা যায় না। বিপক্ষ ডিফেন্ডার যখন দেখত বলটা পেলের শরীরের এমন অসুবিধাজনক স্থানে চলে গেছে এবার ট্যাকলে যাওয়া যায়, তখনো সে শূন্যে পা চালাত, কারণ পেলে বলটা সেই অসুবিধাজনক জায়গা দিয়েই সরিয়ে নিয়েছেন, কাফ মাসলের কাছাকাছি বলেও পেলে ইচ্ছেমতো ছোঁয়া দিতে পারতেন, শরীরের যেকোনো জায়গা দিয়ে নিয়ন্ত্রণে রাখতে পারতেন ওই ছটফটে, পালিয়ে যেতে চাওয়া চামড়ার গোলকটিকে। ববি মুর বলেছিলেন—পেলেকে ট্যাকল করতে কোনো অসুবিধে নেই তো! মনে হবে লোকটা হোঁচট খেয়ে ব্যালেন্স হারিয়ে ফেলেছে, এই পড়ে যাবে বুঝি! এমনকি আপনি নিজের পায়ে বলের স্পর্শও পাবেন, মনে হবে ট্যাকল করে বলটা আপনি কেড়ে নিতে পেরেছেন, কিন্তু তখনই আপনার ভুল ভাঙবে যখন পর মুহূর্তে আপনি দেখবেন যে আপনি কোথাও নেই, তিনি বল নিয়ে অনেক দূর চলে গেছেন শুধু যাওয়ার পথে আপনার হাঁটতেই ওয়াল খেলে আপনাকে বিট করে গেছেন। এবং এগুলো যে গল্প নয়, তা পরের প্রজন্মকে আমরা কী করে বোঝাব!!

না, যে যতই বড় হোক, যত সফলই হোক এভাবে কেউ ফুটবল খেলেনি কখনো,কেউ খেলবে বলেও মন মানতে চায় না। এই তো কলকাতায় মোহনবাগানের বিরুদ্ধে খেলা নয়, তাকে চর্মচক্ষে দেখতে পাওয়াটাই আমি আমার জীবনের সবচেয়ে বড় একটি প্রাপ্তি বলে মনে করি, মনে করি তার আসল ফুটবল দেখতে চাওয়ার মতো কোনো যোগ্যতাই আমার নেই, তাও, যতই বয়স হোক তিনি পেলে, ফুটবলের ঈশ্বর, দরিদ্র ক্ষুধার্ত ভক্তদের কিছুই কি দেবেন না! দিলেন, ছোট্ট একটু। পাঁচ টাকার ছাত্রদের টিকিটে রণজি স্টেডিয়ামে বসেছিলেন বলে ভালো করে দেখতে পেয়েছিলাম। একদম আমাদের তলায়। মোহনবাগান বক্সের মধ্যে মাঝামাঝি তার ডান পায়ে বল, সামনে দুজন ডিফেন্ডার, সেদিন একবারও তিনি ড্রিবল করেননি, এবারও কি করবেন না? এসব সিচুয়েশন তো তার কাছে জলভাত! আশায় আমাদের বুকটা ছলাৎ করে ওঠে। কিন্তু তিনি যেটা করলেন, ওই যে বললাম ভাবনার দুনিয়াছাড়া ধরন, ড্রিবল-বিল করলেন না, ক্ষমা করো ভগবান, ছোট মনে কী সব ভাবছিলাম তার ডান দিকে চিনাগ্নিয়া আর বাঁ দিকে কে একজন যেন, চিনাগ্লিয়া একটু ফাঁকায়, বলটা দিতে পারলেই গোল, কিন্তু পেলে তার সামনের ডিফেন্ডারটির জন্য বলটা কিছুতেই চিনাগ্নিয়ার দিকে বার করতে পারছিলেন না। শেষে মন বদলে পায়ের ইনস্টেপ দিয়ে বাঁ দিকের খেলোয়াড়টির দিকে তাকিয়ে তাকেই বলটা ঠেলে দিলেন। কিন্তু ওমা! বলটা পুরো উল্টোদিকে চিনাগ্নিয়ার কাছে গেল কী করে! চিনাগ্লিয়া পর্যন্ত হতভম্ব হয়ে গোলটা মিস করলেন। পরে বোঝা গেল বলটাকে স্পিন মতো করিয়ে নিজেরই বাঁ পা-টাকে ওয়াল করে খেলেছেন, বলটা তাই বাঁ পা-টায় ধাক্কা লেগে পুরো উল্টো দিকে চলে গেছে অথচ সবাই তার ডান পায়ের ফলোথ্রুর দিকেই তাকিয়ে ছিল। জিনিসটা বোঝার পর আমি চোখ বুজিয়ে কিছুক্ষণ থরথর করে কেঁপেছিলাম। ভগবান বোধ হয় এভাবেই ভক্তকে দেখা দেন!

গোলের আনন্দে? ছবি: পপারফটো

কী অবস্থার মধ্যে খেলেছেন পেলে! খেলোয়াড়ি মানসিকতার সবচেয়ে গভীর অবক্ষয়ের কালে তাকে খেলতে হয়েছে, নেতিবাচকতার চূড়ান্ত বিস্ফোরণের সময়ের মধ্যে দিয়ে তাকে যেতে হয়েছে। কঠিনতম, নীতিহীন ম্যানমার্কিং, হিংস্রতম মারধরের মধ্যে দাঁড়িয়ে তাকে ফোটাতে হয়েছে ফুটবল শিল্পের সুন্দরতম ফুলগুলো। চারজন-পাঁচজন করে তার ওপর ঝাঁপিয়ে পড়েছে, বল ছুঁতে দেব না, মেরে শেষ করে দাও গেলে অসহায়ভাবে যন্ত্রণায় ককিয়েছেন, রেফারিরা থেকেছেন উদাসীন। আজ ফুটবল অনেক ভদ্র ও সংগঠিত হয়েছে। ষাটের দশকের অন্ধকার অপসারিত। আজ যদি সম্রাট খেলতেন—হয়তো ফুটবলকে তার দেওয়ার ছিল আরো বেশি! সময় নিতে পারেনি! আজ হলে আরও দিতেন।
..................

প্রসূন বন্দোপাধ্যায়ের এই লেখার পর নতুন করে আর কিছু যোগ করার মানে হয় না।

(লেখকের 'বিশ্ব যখন ফুটবলময়' বই থেকে)

শেয়ার করুনঃ
আপনার মন্তব্য
আরও পড়ুন
×