আলী দাইয়িকে চেনেন?

আলী দাইয়িকে চেনেন?

আলী দাইয়ি। ছবি: গেটি ইমেজেস

আন্তর্জাতিক ফুটবলে ক্রিস্টিয়ানো রোনালদো আর তাঁর গোলসংখ্যা এখন সমান, ১০৯টি। গত দু`দিন ধরে গণমাধ্যম কিংবা সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে তাঁর নামটা উচ্চারিত হচ্ছে বেশ জোরেশোরে। কিন্তু জাতীয় দলের হয়ে সর্বোচ্চ গোলের রেকর্ডটা গত সতের বছর যাঁর অধিকারে, তাঁকে তো ক্রিস্টিয়ানো রোনালদো ছাড়াও স্মরণ করতে হয়।

'কোথায় যেন শুনেছিলাম?'

আলী দাইয়ি নামটা আপনি শুনেছিলেন নিশ্চিত। তবে ঠিক ততটাই মনোযোগে, যতটা শুনলে স্মৃতির অলিগলি হাতড়ে আপনাকে অস্ফুটে উচ্চারণ করতে হয় ওই বাক্যটা, 'ইশ, কোথায় যেন শুনেছিলাম!' স্মার্ট টিভির এই যুগে পেশাদার ফুটবলাররা সপ্তাহান্তেই নেমে আসছেন আপনার ড্রয়িংরুমে, সপ্তাহের মাঝপথে উয়েফা চ্যাম্পিয়নস লিগের রোমাঞ্চ, এখন তো আবার এসেছে ফ্যান্টাসি লিগের কারণে খেলা সংক্রান্ত হালনাগাদ তথ্য আর উদীয়মান ফুটবলারদের ওপরে শ্যেন চক্ষু রাখার হ্যাপা… এত সব ব্যস্ততার ভিড়ে বছর চৌদ্দ আগে অবসর নেওয়া এক ফুটবলারকে এক নামে চেনার সংগ্রাম কে-ই বা করতে যাবে! ১৯৯৮-৯৯ মৌসুমে বায়ার্ন মিউনিখের হয়ে ২৩ ম্যাচ মাঠে নামা ছাড়া নামে-ভারে বড় কোনো ক্লাবে খেলার অভিজ্ঞতাই যাঁর নেই।

তবুও আলী দাইয়ি আপনার স্মৃতির দরজায় ছাপ রেখে গেছেন ঠিকই। আর গত পরশু, এই ইউরোর শেষ গ্রুপ ম্যাচের দিনটা থেকে আলী দাইয়ি নামটা তো বারংবার ভেসে ওঠারই কথা আপনার চোখের সামনে। পর্তুগালের হয়ে নিজের ১৭৮তম ম্যাচে ১০৯ গোল করলেন ক্রিস্টিয়ানো রোনালদো, যে উচ্চতায় এর আগে উঠেছিলেন একজনই। আলী দাইয়ি।

ইরানের জার্সি গায়ে ছুটছেন আলী দাইয়ি। ছবি: গেটি ইমেজেস

জন্মেছিলেন ইরানের আরদাবিলে। ফুটবলের নেশাটা পেয়ে বসেছিল শৈশবেই, বয়স ১৪ পেরোনোর আগেই জন্ম-শহরের ক্লাব এস্তেঘাল আরদাবিলের যুবদলে যোগ দেওয়াটা তো তা-ই প্রমাণ করে। সেই নেশাটা কাটাতে পারেননি আর কখনোই, যে কারণে ম্যাটেরিয়াল ইঞ্জিনিয়ারিংয়ে স্নাতক ডিগ্রি নিলেও পেশা হিসেবে বেছে নিয়েছিলেন ফুটবল খেলাকেই। পেশাদার ক্যারিয়ার শুরু করেছিলেন এস্তেঘাল আরদাবিলের হয়েই, সেখানে সিনিয়র দলের হয়ে দুই মৌসুম কাটিয়ে যোগ দেন তাক্সিরানি ক্লাবে।

তবে রাজধানী শহর তেহরানে না গেলে প্রতিভার দাম পাওয়া যাবে না শুনে এক মৌসুম বাদেই ঠিকানা বানান তেহরানের ব্যাংক তেজারাতকে। নিজের সামর্থ্যের প্রমাণ বয়সভিত্তিক দল থেকে দিলেও মূলত এই ক্লাবে এসেই দিগ্বিদিকে ছড়িয়ে পড়ে আলী দাইয়ির গোল-শিকারি দক্ষতার কথা। ব্যাংক তেজারতের হয়ে চার মৌসুম খেলে ৭৫ ম্যাচে করেছিলেন ৪৯ গোল। ইরানের শীর্ষস্থানীয় ক্লাবগুলোর একটিতে ডাক পাওয়াটা তখন তাই শুধু সময়ের ব্যাপারই ছিল।

আলী দাইয়ি সাড়া দেন পার্সিপোলিসের ডাকে। ১৯৯৪-৯৫ মৌসুমে যোগ দিয়ে প্রথম মৌসুমেই বাজিমাত। লিগে তাঁর দল সেমিফাইনালে বাদ পড়লেও ২৫ ম্যাচে ১৫ গোল নিয়ে আসরের দ্বিতীয় সর্বোচ্চ গোলদাতা হয়েছিলেন দাইয়ি। পরের মৌসুমে আর সেরা চার দলের একটি হয়ে তুষ্ট থাকেনি তাঁর দল, এবার সরাসরি চ্যাম্পিয়ন। ৩০ ম্যাচের লিগের অর্ধেকও অবশ্য খেলতে পারেননি দাইয়ি, তবে যে ১৩ ম্যাচে মাঠে নেমেছিলেন, তাতে ৮ গোল করে ঠিকই বুঝিয়েছিলেন, নামতে পারলে কী করতে পারতেন!

এই আলী দাইয়ি হার্থা বার্লিনের। ছবি: গেটি ইমেজেস

এই 'কী করতে পারেন' পরীক্ষায় নেমেই পাড়ি জমিয়েছিলেন ইউরোপে। তবে প্রথম এশিয়ান হিসেবে উয়েফা চ্যাম্পিয়নস লিগের মঞ্চারোহণ ছাড়া ইউরোপে দাইয়িকে ব্যর্থই বলা চলে। পার্সিপোলিস থেকে কাতারের ক্লাব আল সাদে এক মৌসুম কাটিয়ে ভিড়েছিলেন জার্মান ক্লাব আর্মিনিয়া বিলফিল্ডে। সেখানে ২৫ ম্যাচে ৭ গোল, আর বায়ার্ন মিউনিখ ও হার্থা বার্লিনে ৮২ ম্যাচ খেলে সাকুল্যে ১২ গোল করে ফিরেছিলেন এশিয়ার চেনা ডেরায়।

এবার পাঁচ মৌসুমে ক্লাব বদলেছিলেন চারটি, এই দফায় ১২৬ ম্যাচ খেলে গোল করেছিলেন ৬০টি। ২০০৭ সালে বুটজোড়া তুলে রাখার আগেই নিয়েছিলেন ইরানি ক্লাব সাইপার দায়িত্ব। অবসরের পর ম্যানেজারি করেছেন ইরান জাতীয় দলেরও। খেলোয়াড়ি জীবনের ঘনঘন ক্লাব বদলের বাতিকটা ধরে রেখেছেন এখনো, এরই মধ্যে দায়িত্ব ছেড়েছেন আর ধরেছেন ১০ বার। তবে ২০১৯ সালে সাইপার দায়িত্ব থেকে পদচ্যুত হলে ওই রাস্তায় এগোনোর চেষ্টা করেননি আর। ৩৮০ ম্যাচে আর পার্সিপোলিস-সাইপার মতো দলগুলোর ম্যানেজারি করেও যিনি জয় পেয়েছেন মাত্র ৪২.৩৭ শতাংশ ম্যাচে, তাঁর ওই পথে আর না এগুনোই ভালো।

এখন তাই ফুটবলকে পুরোপুরি ছেড়ে ছুড়ে মন দিয়েছেন ব্যবসায়। তবে তিনি ছাড়লেও ফুটবল তাঁকে ছাড়ে কী করে! যেখানে আন্তর্জাতিক ফুটবলের সবচেয়ে চর্চিত শিরোনামেরই একচ্ছত্র অধিপতি হয়ে ছিলেন তিনি! ক্লাব ফুটবলে ৩০৭ ম্যাচে ১২৬ গোলের পরিসংখ্যানটা বড্ড মলিনই লাগে, তবে দাইয়ি তো নিজের সেরাটা জমিয়ে রাখতেন জাতীয় দলের জন্যই। জাতীয় দলের হয়ে তাঁর ম্যাচপ্রতি ০.৭৩ গোল করার হার তো ঈর্ষা জাগাবে অনেক ফুটবলারের মনেই। অনেকে তাই এ-ও বলেন, ইরানের জন্যে নিজের সেরাটা ঢেলে দেওয়াটা নিশ্চিত ক্লাবের জার্সিতে কিছুটা রয়ে সয়ে খেলতেন এই স্ট্রাইকার।

১৯৯৩ সালের ৬ জুন ইসিও কাপের ম্যাচে অভিষেক হয়েছিল পাকিস্তানের বিপক্ষে। একই মাসের ২৫ জুন প্রথম গোলের দেখা পেয়েছিলেন বিশ্বকাপ বাছাই পর্বের ম্যাচে। তাইওয়ানের বিপক্ষে ম্যাচটি ছিল তাঁর ষষ্ঠ। ইরানের ৬-০ গোলের জয়ে আলী দাইয়ি গোল করেছিলেন একটিই, তবে ওই গোলটাই হয়ে গেছে রেকর্ড বইয়ের পাতায় আঁকিবুঁকি কাটার সূচনা।

যখন ম্যানেজারি করতেন। ছবি: গেটি ইমেজেস

এরপর ইরানের হয়ে ম্যাচ খেলেছেন আরও ১৪৩টি, তাতে বেড়েছে আরও ১০৮ গোল। এর মধ্যে ৯০তম গোলটা খানিকটা বাড়তি মাহাত্ম্য দাবি করে। ওই গোলেই যে মালয়েশিয়ার মোখতার দাহারিকে টপকে আন্তর্জাতিক ফুটবলে সর্বোচ্চ গোলের রেকর্ডটা নিজের করে নিয়েছিলেন এই ইরানি।

২০০৬ বিশ্বকাপ খেলে জাতীয় দলের জার্সি তুলে রাখা দাইয়ির সর্বোচ্চ গোলের রেকর্ড টিকে আছে পনের বছর ধরে। অবশ্য খুব বেশি দিন যে থাকছে না, তা অবশ্যম্ভাবীই। ফ্রান্সের বিপক্ষে জোড়া গোল করে ক্রিস্টিয়ানো রোনালদো ভাগ বসিয়েছেন তাঁর রেকর্ডে। বেলজিয়ামের বিপক্ষে পরবর্তী ম্যাচেই তিনি টপকে যাবেন দাইয়িকে, এই পক্ষেই বাজি ধরার লোক পাওয়া যাবে বেশি। রেকর্ড হাতছাড়া করে দাইয়ির যে মন খারাপ হচ্ছে, এমন কোনো আভাস মিলছে না। টুইটারে ইতোমধ্যেই রোনালদোকে অভিনন্দন-বার্তা পাঠিয়েছেন তিনি।

অবশ্য মন খারাপ কেনই বা হবে! এটাও কি কম কৃতিত্বের, এমন একটা কীর্তি গড়ে গিয়েছিলেন, যা ভাঙতে একজন ক্রিস্টিয়ানো রোনালদো লেগেছে?

শেয়ার করুনঃ
আপনার মন্তব্য
আরও পড়ুন
×