এটাই কি তাহলে শেষ ছবি হয়ে থাকল, ক্রিস্টিয়ানো?

উৎপল শুভ্র

২৮ জুন ২০২১

এটাই কি তাহলে শেষ ছবি হয়ে থাকল, ক্রিস্টিয়ানো?

শেষ বাঁশি বাজার পর ক্রিস্টিয়ানো রোনালদো। বেলজিয়ামের কাছে হেরে ইউরো ২০২০ থেকে বিদায় নেওয়ার পর

আগের চারটি ইউরো আবেগের নানা রঙের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিয়েছে তাঁকে। রেকর্ডে রেকর্ডে ইউরোর সমার্থক হয়ে ওঠা ক্রিস্টিয়ানো রোনালদোর এবার কিনা দ্বিতীয় রাউন্ডেই বিদায় নেওয়ার অভিজ্ঞতার সঙ্গেও পরিচয় হয়ে গেল। ইউরোতে রোনালদোর শেষ ছবি হিসেবে কোনটাকে মনে রাখবেন আপনি?

শেষ বাঁশি বাজতেই হতাশায় আকাশের দিকে মুখ তুলে তাকানোটাকে মনে হলো যেন নীরব আর্তনাদ। উবু হতে হতে অধিনায়কের আর্মব্যান্ডটা খুলে মাঠে ছুঁড়ে ফেলাটাকে দল ভালো খেলার পরও হেরে যাওয়ার প্রতিবাদ। এরপর সেই আর্মব্যান্ডের পাশেই পা ছড়িয়ে বসে পড়াটাকে কী বলবেন...নিয়তির কাছে অসহায় আত্মসমর্পণ?

পা ছড়িয়ে মাথা নিচু করে বসে আছেন তো আছেনই। কতক্ষণ কাটল এভাবে? এক ঘণ্টা-দুই ঘণ্টা...অনন্তকাল?

আসলে তো এক মিনিটও হয়তো নয়। লোহার মতো ভারি শরীরটাকে টেনে তুলে যখন উঠে দাঁড়ালেন, দূরে বেলজিয়ান উদযাপন কি মনে করিয়ে দিল পাঁচ বছর আগের স্টাডে ডি ফ্রান্সের সেই রাত? ২৫ মিনিটে চোখে জল নিয়ে মাঠ থেকে বেরিয়ে যাওয়ার পর ডাগআউটের সেই স্নায়ুক্ষয়ী মুহূর্তগুলো..এরপর সব পাওয়ার সেই অনির্বচনীয় আনন্দে মেতে ওঠা। ইউরো ২০১৬-এর শেষ রাতে পর্তুগিজ উৎসবের রংটা তো অনেকটা এমনই ছিল! 

শূন্য দৃষ্টিতে একবার দূরে তাকিয়ে একটু এগোতেই সামনে বেলজিয়ান গোলকিপার থিবো কোর্তোয়া। মেলাতে হয় বলেই যেন হাত মেলালেন। অস্ফুটে কি বললেনও কিছু? জবাবে কোর্তোয়াও? নিশ্চয়ই প্রথাগত 'কনগ্রাচুলেশনস্-হার্ড লাক' জাতীয় কিছুই হবে। ইতালিয়ান সিরি 'আ'র সেতুতে বাঁধা বলেই হয়তো রোমেলু লুকাকুর বিদায়ী আনুষ্ঠানিকতাটা আলিঙ্গনে গড়াল। ক্ষীণ একটা হাসির রেখাও কি দেখা গেল মুখে!

তারপর, তারপর ধীর পায়ে মাঠ থেকে বেরিয়ে গেলেন ক্রিস্টিয়ানো রোনালদো। বড় কোনো টুর্নামেন্ট থেকেই কি শেষবারের মতো?

২০২২ বিশ্বকাপ এখনো প্রায় ১৭ মাস দূরে। কে জানে, তিনি রোনালদো বলেই কাতারেও পর্তুগালের জার্সি গায়ে ক্রিস্টিয়ানো রোনালদোর আবছা একটা মূর্তি চোখে ভাসে। তবে চার বছর পরের ইউরোর কথা ভাবতে গেলে আবছা হতে হতে তা এক সময় মিলিয়েই যায়। কী বলছেন, ফিটনেস নিয়ে সিআরসেভেনের যে অবসেশন, তাতে ৪০ বছর বয়সকে তুড়ি মেরে নেমেও পড়তে পারেন পরের ইউরোতে?

না, পারবেন বলে মনে হয় না। দিনের পর দিন, বছরের পর বছর অতিমানবীয় সব কীর্তি আর অবিশ্বাস্য ধারাবাহিকতায় যতই ভুল বুঝিয়ে আসুন না কেন, শেষ পর্যন্ত ক্রিস্টিয়ানো রোনালদো আর লিওনেল মেসিরাও তো রক্ত-মাংসের মানুষই। জাগতিক কিছু নিয়ম তো তাঁদের ক্ষেত্রেই প্রযোজ্য হতে বাধ্য।

তাহলে কি এটাই ইউরোতে আপনার শেষ ছবি হয়ে থাকল, ক্রিস্টিয়ানো? আর্মব্যান্ড ছুঁড়ে ফেলে হতাশায় মাঠে বসে পড়ার ওই দৃশ্যটা? 

এটাই কি তাহলে ইউরোতে আপনার শেষ ছবি হয়ে থাকল, ক্রিস্টিয়ানো?

আগের চারটি ইউরো আবেগের নানা রঙের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিয়েছে তাঁকে। প্রথমটিতেই ফাইনাল, পরেরটিতে কোয়ার্টার ফাইনাল, এরপর সেমিফাইনাল হয়ে আবারও ফাইনাল..প্রথম ফাইনালে হেরে কেঁদেছিলেন, আর শেষটি যেন রবীন্দ্রসঙ্গীতের লাইন: কান্না-হাসির দোল দোলানো পৌষ-ফাগুনের পালা! একই ম্যাচে স্বপ্নভঙ্গের কান্না, স্বপ্নপূরণের হাসিও! 

রেকর্ডে রেকর্ডে ইউরোর সমার্থক হয়ে ওঠার কারণে যে নামটি ট্রফিতে খোদাই করে রাখার দাবি তোলাটাও বাড়াবাড়ি মনে হয় না, সেই ক্রিস্টিয়ানো রোনালদোকে শেষবেলায় এসে কিনা দ্বিতীয় রাউন্ড থেকেই বিদায় নেওয়ার অজানা অভিজ্ঞতার সঙ্গেও পরিচয় করিয়ে দিল ইউরো!

অথচ এবারের ইউরো শুরু থেকেই তাঁর দুহাত ভরিয়ে দিচ্ছিল। প্রথম ম্যাচেই সর্বোচ্চ গোলের রেকর্ডে মিশেল প্লাতিনির অংশীদারত্ব মুছে দিয়েছেন। পরের দুই ম্যাচে আরও তিন গোল করে রেকর্ডটাকে নিয়ে গেছেন ১৪ গোলে। ১৪তম গোলটিতেই রেকর্ড আর রোনালদো বিষয়ক আলোচনা ছাড়িয়ে গেছে ইউরোর সীমানা। বিস্মৃতপ্রায় আলী দাইয়িকে আবার আলোতে নিয়ে এসেছেন। ছেলেদের আন্তর্জাতিক ফুটবলে সবচেয়ে বেশি গোলের রেকর্ডে রোনালদোর ভাগ বসানোর দিনই আলী দাইয়ি সম্ভবত মেনে নিয়েছিলেন, পরের ম্যাচটাতেই এই রেকর্ডে আর তাঁর নাম থাকবে না। ইউরোর প্রথম ম্যাচেই প্লাতিনির ক্ষেত্রে যা করেছেন, নকআউট পর্বের প্রথম ম্যাচেই তাঁকেও তেমন 'প্লাতিনি' বানিয়ে দেবেন রোনালদো।

কল্পচোখে রোনালদোও হয়তো এমন কিছুই দেখছিলেন। আন্তর্জাতিক ফুটবলে সবচেয়ে বেশি গোলের রেকর্ডটি শুধুই তাঁর, বেলজিয়ামের সঙ্গে জিতে কোয়ার্টার ফাইনাল। জুভেন্টাসে খেলার সুবাদে যে কোয়ার্টার ফাইনাল প্রতিপক্ষের সব খেলোয়াড়ই তাঁর চেনা। কিন্তু জীবনের মতো ফুটবলও কি আর এমন পান্ডুলিপি মেনে চলে!

চলে না বলেই বড় ম্যাচে জ্বলে ওঠাটাকে খাওয়া-ঘুমানোর মতোই সহজাত এক ব্যাপার মনে করিয়ে আসা রোনালদো হয়ে থাকেন নিজের ছায়া। গোলে শট বলতে থাকে কোর্তোয়ার তেমন কোনো পরীক্ষাই না নেওয়া এক ফ্রি কিক। আরেকটা ফ্রি কিক আছড়ে পড়ে বেলজিয়ান দেয়ালে। ফুটবল পান্ডুলিপি মেনে চলে না বলেই ৩২ বছর পর বেলজিয়ামের কাছে হেরে যায় পর্তুগাল। ১৯৮৯ সালের সেপ্টেম্বরে বিশ্বকাপ বাছাই পর্বে ৩-০ গোলে যে পরাজয়ের সময় রোনালদো মাদেইরার রাস্তায় খেলে বেড়ানো চার বছরের বালক। 

গত ৩২ বছরের বেলজিয়াম আর এই বেলজিয়াম এক নয়, জানি। এই বেলজিয়াম ফুটবল-দেবতার কাছ থেকে একসঙ্গে এক ঝাঁক প্রতিভার বর পাওয়া বেলজিয়াম। বড় কোনো শিরোপা না জিতেও যারা ফিফা র‍্যাঙ্কিংয়ে এক নম্বর হয়ে যায়। তা যেমন প্রশ্ন তোলে, আবার কৃতিত্বটাকে কি আরও বড়ও করে তোলে না? বুঝিয়ে দেয় না, কতটা ধারাবাহিক হলে বড় টুর্নামেন্ট না জিতেও এক নম্বর হওয়া যায়!

এই বেলজিয়ামের কাছে হেরে যাওয়ায় তাই কোনো গ্লানি নেই। কিন্তু মাঠের খেলায় কোথায় সেই ফিফা র‍্যাঙ্কিংয়ের এক নম্বর দল? ফুটবলকে 'দাবা' মনে করানো দুই দলেরই সাবধানী অ্যাপ্রোচের মধ্যেও তো প্রায় পুরো ম্যাচজুড়েই বিশ্বের এক নম্বরের চেয়ে ইউরোর ডিফেন্ডিং চ্যাম্পিয়নরাই তো ছিল শ্রেয়তর। গোলে শট বলুন, বা গোলের সুযোগ তৈরি করা...সব হিসাবেই এই দাবির প্রতিফলন। ভাগ্যকে তাই দুষতেই পারেন রোনালদো। 

যাঁর রক্তের প্রতিটি কণিকায় নেচে বেড়ায় জিগীষা, এই পরাজয় তো তাঁকে রক্তাক্ত করবেই। বারবার হয়তো ফিরে ফিরে দেখছেন দুঃস্বপ্নের ওই ৯০ মিনিট। চোখে ভেসে উঠছে রুবেন ডিয়াজের সেই ঝাঁজালো হেড, যা এক ফুট এদিক-ওদিক গেলেই কোর্তোয়ার হয়তো কিছুই করার থাকে না। চোখে ভাসছে রাফায়েল গুয়েরেইরোর শট পোস্টে লেগে ফিরে আসার ওই দৃশ্যটা। রাগ হচ্ছে জোটার ওপর, তাঁর বানিয়ে দেওয়া বলে যিনি গোল করবেন দূরে থাক, তা পোস্টেও রাখতে পারেন না।

ক্রিস্টিয়ানো রোনালদোর নিশ্চয়ই চোখে ভাসছে থরগান হ্যাজার্ডের এই গোল

সবচেয়ে বেশি ভাসছে হয়তো তাঁর 'শেষ' ইউরোটাকে এমন শোকগাথা বানিয়ে দেওয়া থরগান হ্যাজার্ডের জাদুকরী সেই শট। যে শটে যেন প্রাণপ্রতিষ্ঠা হলো বলে। তা পেয়ে গেল ইচ্ছামতো যেদিকে খুশি বাঁক নেওয়ার স্বাধীনতা। খ্যাপা আনন্দে মাতা সেই বলের জালে যাওয়া ঠেকানোর সাধ্য কি পর্তুগিজ গোলকিপারের!

ওই গোলটার পরই একটা প্রশ্ন জাগছিল মনে। ম্যাচের আগে বেলজিয়ামের কোচ রবার্তো মার্তিনেজ যে বলেছিলেন, 'প্রথম গোলটাই ম্যাচের সুর বেঁধে দেবে' তা কি ফুটবলীয় প্রজ্ঞা থেকে, নাকি ইউরোতে পর্তুগালের ইতিহাস জেনে? ২০০৪ থেকে ইউরোতে প্রথমে গোল খেয়ে মাত্র একবারই জিততে পেরেছে পর্তুগাল। ২০১২ ইউরোর গ্রুপ ম্যাচে হল্যান্ডের বিপক্ষে সেই ফিরে আসার গল্পও তো রোনালদোরই লেখা।

এবারের মতো সেই ইউরোতেও পর্তুগাল গ্রুপ অব ডেথে। হল্যান্ডের কথা তো জেনেই গেছেন, গ্রুপের বাকি দুই দল জার্মানি ও ডেনমার্ক। জার্মানির কাছে পর্তুগাল হেরেছে, হেরেছে হল্যান্ডও। ডেনমার্কের বিপক্ষে জয় ডাচদের চেয়ে পর্তুগালকে এগিয়ে রাখলেও গ্রুপের শেষ ম্যাচটা হয়ে দাঁড়িয়েছে জীবন-মরণ লড়াই। হেরে গেলে প্রথম রাউন্ড থেকেই বাদ পড়ার শঙ্কা। ১১ মিনিটেই গোল খেয়ে বসার পর যে শঙ্কা আরও জাপটে ধরেছে পর্তুগালকে। এরপর যা হয়েছিল, তা গ্রুপ ম্যাচ বলেই হয়তো সেভাবে আলোচনায় আসে না। নইলে ইউরোতে রোনালদোর সেরা পারফরম্যান্সের কথা বললে এই ম্যাচটি অবশ্যই আসবে। দুটি গোল তো করেছিলেনই, আরও দুটি হতে হতে হয়নি গোলপোস্ট বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছিল বলে।

২০১২ ইউরোর পর্তুগালের তুলনায় এই ইউরোর পর্তুগালের আক্রমণভাগে প্রতিভার ছড়াছড়ি। তারপরও বেলজিয়াম-বাধা পেরোতে ইউক্রেনের মেটালিস্ট স্টেডিয়ামের সেই রোনালদোকেই লাগত। কিন্তু ২৭ বছরের সেই রোনালদোকে মুহূর্তের জন্যও ফিরিয়ে আনার বদলে এই ম্যাচ বরং বারবারই বুঝিয়ে দিল, এই রোনালদোর বয়স ৩৬। বয়সকে নিছকই একটা সংখ্যা বলে প্রমাণ করে যাচ্ছেন ঠিকই, কিন্তু কখনো কখনো কি সেটির অলঙ্ঘনীয় হয়ে ওঠাটাই কি স্বাভাবিক নয়!

আর্মব্যান্ড ছুঁড়ে ফেলে পা ছড়িয়ে বসে থাকা ক্রিস্টিয়ানো রোনালদোই তাই হয়ে থাকেন ইউরোর শেষ ছবি। নাকি হতাশায় আকাশের দিকে তাকানো ওই মুখটা?     

সম্পর্কিত বিষয়:

শেয়ার করুনঃ
আপনার মন্তব্য
আরও পড়ুন
×