ফুটবলের পাগলপারা এক রাত

ইউরো ২০২০

উৎপল শুভ্র

২৯ জুন ২০২১

ফুটবলের পাগলপারা এক রাত

ইউরোতে পাগলপারা এক ফুটবল-রাতের শেষ দৃশ্য। টাইব্রেকারের শেষ শট ঠেকিয়ে দিয়ে নায়ক ইয়ান সোমারকে অভিনন্দন জানাতে ছুটছে সুইজারল্যান্ড দল। ছবি: উয়েফা

শুধু স্পেন-ক্রোয়েশিয়া প্রথম ম্যাচটার কারণেই এই রাতটা মনে থাকত, আধঘণ্টা পর শুরু ফ্রান্স-সুইজারল্যান্ড পরের ম্যাচ যে নাটকীয়তায় এটিকেও ছাড়িয়ে যাবে, কে জানত! ইউরো ২০২০-এ সোমবারের পাগলপারা ফুটবল-রাতটাকে কখনো কখনো তাই অতিপ্রাকৃত বলেও মনে হচ্ছে!

অবিশ্বাস্য! অভাবনীয়! অচিন্তনীয়! অত্যাশ্চর্য! অকল্পনীয়!

আর কী কী যথাশব্দ আছে, বলুন তো! এত সব বলেও যে ফুটবলের এই মহানাটকীয় রাতকে ঠিক বোঝানো যাচ্ছে না।

জীবনে এত খেলা নিয়ে এত এত লেখা লিখেছি, তার দু’একটার বর্ণনা এভাবেই শুরু করেছিলাম বলে মনে পড়ে। ইউরো ২০২০-এর সোমবার রাতের পর মনে হচ্ছে, শব্দগুলোর অপপ্রয়োগ হয়েছে, এর সবই আসলে এই রাতের জন্য তুলে রাখা উচিত ছিল।

দুই ম্যাচে ১৪ গোলের পাগল করা এক রাত...যাতে অসাধারণ গোল আছে, পেনাল্টি আছে, পেনাল্টি মিস আছে, কাম ব্যাকের অপূর্ব গল্প আছে, টাইব্রেকার আছে, সেই টাইব্রেকারে তর্কযোগ্যভাবে এই রাতে মাঠে নামা চার দল মিলিয়েই সবচেয়ে বড় তারকার পেনাল্টি মিসে ম্যাচের মীমাংসা আছে...বলতে থাকলে ’আছে’র তালিকা হয়তো অন্তহীন চলতেই থাকবে!

শেষে কী আছে? শেষে আছে খেলার চিরন্তন সেই প্রাণভোমরা। আপসেট!

শেষ ষোলো দলের দ্বিতীয় রাউন্ড শুরুর আগে কোন ম্যাচটা সবচেয়ে একতরফা হতে পারে–এই জরিপ করলে যেটি সম্ভবত সবচেয়ে বেশি ভোট পেত বলে অনুমান করি, কে জানত, সেই ফ্রান্স-সুইজারল্যান্ড ম্যাচই এমন এক ক্ল্যাসিক উপহার দেবে!

১৯৯৬ সালের আগে যারা কখনো ইউরোতে কোয়ালিফাই-ই করতে পারেনি, এর আগে চারবার অংশ নিয়ে একবারই শুধু পেরোতে পেরেছে গ্রুপ পর্ব, কে ভেবেছিল, সেই সুইজারল্যান্ডই বিদায় করে দেবে বিশ্ব চ্যাম্পিয়ন ফ্রান্সকে!

কেউ যা ভাবেনি, তা হয়েছে বলেই শুধু এই রাতটা বিশেষ হয়ে নেই। যুগে যুগে আপসেট তো কম দেখেনি ফুটবল। বিশ্বকাপে ডিফেন্ডিং চ্যাম্পিয়নরা হেরে বসেছে বিশ্বকাপে নবাগত দলের কাছে, ফুটবল পরাশক্তিকে বিদায়ের পথ দেখিয়ে দিয়েছে ফুটবল ঐতিহ্যে দীনহীন কোনো দল...এমন ঘটনা তো কতই আছে। কিন্তু ইউরোর এই রাত তো শুধু আপসেটের জন্যই মনে অক্ষয় হয়ে থাকবে না। হয়ে থাকবে ফুটবল তার সব রূপ-রস-রোমাঞ্চ নিয়ে দেখা দিয়েছিল বলে। 

টাইব্রেকারে কিলিয়ান এমবাপ্পের পেনাল্টি মিসেই সমাপ্তি ফুটবলের অবিশ্বাস্য এক রাতের। ছবি: উয়েফা

আপসেটটা এখানে শুধুই কেকের ওপরের ক্রিম। 'কেক' তো চার ঘণ্টা ধরে পাগল করে দেওয়া ফুটবল। আপসেটে সমাপ্তি যেটিকে আরেকটু স্মরণীয় করে রাখার কাজটাই শুধু করেছে। আপসেট না হলেও কিছুই আসত যেত না। আপনিই বলুন না, টাইব্রেকারে ফ্রান্স জিতলেও কি এই রাত আপনি ভুলে যেতে পারতেন?

এ এমনই এক রাত যে, যা নিয়ে লিখতে বসে সব কিছু কেমন গুলিয়ে যেতে চাইছে। ফ্রান্স-সুইজারল্যান্ড ম্যাচে ঢুকে যেতে চাইছে স্পেন-ক্রোয়েশিয়া, স্পেন-ক্রোয়েশিয়ায় ফ্রান্স-সুইজারল্যান্ড। রাত ১০টায় শুরু স্পেন-ক্রোয়েশিয়া প্রথম ম্যাচের পরই তো এক্সাইটিং থেকে শুরু করে 'ড্রামা-থ্রিলার' সব ব্যবহার করা হয়ে গিয়েছিল। সেই ম্যাচের রেশ নিয়েই তো আধঘণ্টা পর শুরু ফ্রান্স-সুইজার‍ল্যান্ড দেখতে বসা। এদিনের মতো নাটকের এখানেই সমাপ্তি ধরে নিয়েই তো! কোথায় ফ্রান্স, আর কোথায় সুইজারল্যান্ড! এই ম্যাচ না দেখলেই বা কি!

সেই কবে, ১৯৫৪ বিশ্বকাপে একবার কোয়ার্টার ফাইনাল খেলেছিল সুইজারল্যান্ড। এরপর প্রাকৃতিক সৌন্দর্য, শান্তিপ্রিয়তা, নিরপেক্ষতা প্রসঙ্গে অনেকবারই উচ্চারিত হয়েছে দেশটির নাম, ফুটবল প্রসঙ্গে কখনোই নয়। যেখানে ফ্রান্স শুধু ফু্টবলের বনেদি শক্তিই নয়; এমবাপ্পে-গ্রিজম্যানদের এই দল প্লাতিনির ফ্রান্স, জিদানের ফ্রান্সকেও ছাড়িয়ে যাচ্ছে কি না, শুরু হয়ে গেছে সেই আলোচনা। ফুটবল ঐতিহ্য, সাফল্য, খেলার নান্দনিকতার তুলনায় এ যেন উপকথার সেই 'ডেভিড বনাম গোলিয়াথ' লড়াই। এবং উপকথার সমাপ্তির মতোই এখানে গুলতিসর্বস্ব ডেভিডেরই জয়! সেই জয়ও এমন রোমাঞ্চকর এমন ম্যাচে, যেটি তারস্বরে ইউরোর ইতিহাসের সেরা ম্যাচের তালিকায় স্থান পাওয়ার দাবি তুলছে এবং সেই দাবি মেনেও নিতে হচ্ছে!

এক্সট্রা টাইমের খেলায় মিল নেই, মিল নেই সমাপ্তিতেও, কিন্তু সোমবারের রাতটাকে ফুটবল-পূর্ণিমা বানিয়ে দেওয়া ম্যাচ দুটির নির্ধারিত ৯০ মিনিটে আশ্চর্য কিছু মিল তো খুঁজে পাওয়াই যায়। যেকোনো খেলাতেই দর্শকমনে চিরস্থায়ী ছাপ রেখে আবশ্যকীয় পূর্ব শর্তগুলোর মধ্যে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ সম্ভবত কাম ব্যাকের গল্প। সবাই যখন 'সব শেষ' বলে ধরে নিয়েছে, তখনই কারও ছাই থেকে ফিনিক্স পাখির মতো জেগে ওঠা। এই রাতের দুই ম্যাচই তো লিখেছে এই গল্প। যেভাবে লিখেছে, তাতেও কী আশ্চর্য মিল!

পরের ম্যাচের নাটক ছাড়িয়ে গেছে এটিকেও, তবে ক্রোয়েশিয়ার বিপক্ষে স্পেনের জয়েও একেবারে কম নাটকীয়তা ছিল না। ছবি: উয়েফা।

দুই ম্যাচেই ১-০ গোলে এগিয়ে যাওয়া দল এক সময় পিছিয়ে পড়েছে ৩-১ গোলে। দুই ম্যাচেই পিছিয়ে পড়া দল আবারও ফিরে এসেছে ম্যাচের অন্তিম সময়ে। কাকতালীয়ভাবে ক্রোয়েশিয়ার মতো সুইজারল্যান্ডের সমতাসূচক গোলও ম্যাচের ৯২তম মিনিটে! অতিরিক্ত সময়ে গিয়েই না গল্পটা বাঁক নিয়েছে দুই দিকে। স্পেন দুই গোল করে টাইব্রেকার নামের স্নায়ুক্ষয়ী পরীক্ষায় নামা থেকে মুক্তি খুঁজে নিয়েছে। ফ্রান্স আর তা পারেনি।

অথচ নির্ধারিত সময়ের শেষ বাঁশি বাজার মিনিট পনের আগেও শুরুর সুইস আধিপত্য ছিন্ন করে ফ্রান্স যেমন ফুটবল খেলছিল, টাইব্রেকার দূরে থাক, এই ম্যাচে বাড়তি ৩০ মিনিট যোগ হওয়াটাও তখন কল্পনাতীত। মাঠে তখন ফরাসি সৌরভ ছড়াচ্ছে, ১৮ মিনিটের জাদুকরী ফুটবলের ওই সময়টায় মনে হচ্ছে, জিদানের দল যা করেছে, এ ম্যাচে নিস্প্রভ হয়ে থাকা এমবাপ্পের নামাঙ্কিত এই দলও হয়তো তা করেই ছাড়বে। বিশ্বকাপের পর ইউরোর শিরোপা..।

খেলা দেখে থাকলে একবার ওই সময়টার কথা মনে করে দেখুন না! ১০৩ সেকেন্ডের মধ্যে করিম বেনজেমার দুই গোলেই ম্যাচের মোটামুটি মীমাংসা হয়ে গেছে বলে মনে হচ্ছিল না আপনারও? সামান্য যা সংশয় ছিল, ৩৫ গজ দূর থেকে পল পগবার অসাধারণ এক গোলে সেটিও উধাও হয়ে গেছে বলে মনে হয়নি? 

কিন্তু এটা তো আর দশটা ফুটবল-রাত নয়। নয় বলেই অদম্য সুইসরা আবার ঠিকই ফিরে আসে। মনে করিয়ে দেয়, ফ্রান্সকে সম্ভাব্য বিজয়ী মনে হওয়ার আগেই তাদের সামনে সুযোগ এসেছিল ম্যাচটাকে নিজেদের করে নেওয়ার। ১-০-তে এগিয়ে থাকা অবস্থায় পেনাল্টি। যে পেনাল্টি ঠেকিয়ে দিয়ে ফ্রান্সকে খেলায় রেখেছেন গোলকিপার হুগো লরিস।

সুইজারল্যান্ডের ফুটবল ইতিহাসে অমরত্ব নিশ্চিত করে ফেলা ইয়ান সোমারের সেই সেভ। ছবি: উয়েফা

শেষে গিয়েও নায়ক এক গোলকিপারই। তবে তাঁর নাম হুগো লরিস নয়, ইয়ান সোমার। টাইব্রেকারের প্রথম নয় পেনাল্টিতে বল জালে জড়ানোর পর দশম শটটিকে জালভ্রষ্ট করে সুইস ফুটবল ইতিহাসে অমরত্ব নিশ্চিত করে ফেললেন বুন্দেসলিগায় খেলা সুইজারল্যান্ড গোলকিপার। সেই শটটিও কার? ২০১৮ বিশ্বকাপ বীরত্বে মেসি-রোনালদো-নেইমারের নাম বলার পর একটু বিরতি দিয়েই উচ্চারিত হয় যাঁর নাম। কিলিয়ান এমবাপ্পে!

এক গোলকিপারের বীর হয়ে যাওয়ার মাধ্যমে পাগলপারা যে ফুটবল-রাতের সমাপ্তি, তার শুরুতেও যে আরেক গোলকিপার, তা মনে আছে তো? ঘটনার ঘনঘটায় একটু আবছা হয়ে গিয়ে থাকতে পারে, কিন্তু একটু মনে করিয়ে দেওয়া মাত্রই আপনার চোখে ওই দৃশ্য ভেসে উঠতে বাধ্য।

আন্তর্জাতিক ফুটবল এমন কিছু আগে দেখেছে বলে মনে হয় না, আর দেখবে বলেও না। জাল থেকে বল আনতে যাওয়ার সময় কেমন লাগছিল স্প্যানিশ গোলকিপার উনাই সিমোনের? ছবি: উয়েফা

স্পেন-ক্রোয়েশিয়া ম্যাচের ২০ মিনিটে ৪৯ গজ দূর থেকে পেদ্রির ওই ব্যাক পাস, আনমনা স্প্যানিশ গোলকিপার উনাই সিমোনের পায়ে ছোঁয়া লাগিয়ে বলের স্পেনের গোল পোস্টে ঢুকে যাওয়া..সব ভেসে উঠছে না চোখের সামনে? আন্তর্জাতিক ফুটবলে এমন দৃশ্য অতীতে দেখা গেছে বলে বিশ্বাস হতে চায় না, ভবিষ্যতেও আর দেখা যাবে বলে মনে হয় না।        

টিভিতে লাইভ দেখার সময় অবিশ্বাস্য মনে হওয়া সেই দৃশ্যটা এখন কিন্তু অন্য অর্থ নিয়ে দেখা দিচ্ছে।

অভাবনীয় সব ঘটনায় রঙিন এক ফুটবল-রাতের পূর্বাভাস!

সম্পর্কিত বিষয়:

শেয়ার করুনঃ
আপনার মন্তব্য
আরও পড়ুন
×