হ্যারি কেন: অমরত্বের পথে আরেক ধাপ?

১১ জুলাই ২০২১

হ্যারি কেন: অমরত্বের পথে আরেক ধাপ?

গ্রুপ পর্বের ম্যাচে ছিলেন নিজের ছায়া হয়ে, দলের মুখ্য স্ট্রাইকার হয়েও গোল পাননি কোনো। তবে নক আউট পর্বে আসতেই দেখা দিলেন আপন মহিমায়, করে ফেলেছেন ৪ গোল। কিংবদন্তি ইংলিশ স্ট্রাইকার অ্যালান শিয়ারারের কথা মানলে, ফাইনালেও ইংল্যান্ডের মূল ভরসা তিনিই।

গোলের পর গোল করছে, আর এটাই পরিণত হ্যারি কেন। জার্মানির বিরুদ্ধে হ্যারির গোলটা শুধু ওর নিজের জন্য নয়, ইংল্যান্ডের জন্যই ইতিহাস তৈরির সুযোগ করে দিয়েছে। তবে খালি চোখে যতটা সোজাসাপ্টা দেখাল, ব্যাপারটা আসলে ততটা সরল নয়। গোল করার প্রতি হ্যারি একেবারেই মোহগ্রস্থ। জার্মানির বিপক্ষে ম্যাচের পরবর্তী দুই ম্যাচে ও যা করল, তাতে মনে হচ্ছে, ও শুধু ফর্মেই ফেরেনি, ফর্মটাকেই নিজের করে নিয়েছে।

আমার এখনো বিশ্বাস হচ্ছে না যে, আমরা ইউরোপিয়ান চ্যাম্পিয়ানশিপের ফাইনালে। ডেনমার্কের বিরুদ্ধে খেলাটা আমি ওয়েম্বলিতে গ্যারি লিনেকার আর ইয়ুর্গেন ক্লিন্সম্যানের পাশে বসে দেখছিলাম। সত্যি বলতে সেদিন এত বেশি চিৎকার আর হইচই করেছিলাম যে, আমার ভাঙা গলা এখনো ঠিক হয়নি। আমরা তিনজনেই বিমোহিত হয়ে গিয়েছিলাম হ্যারির কথা বলতে গিয়ে। একেবারে ক্লাসিক সেন্টার ফরোয়ার্ড যাকে বলে, ও ঠিক তা-ই ছিল সেদিন।

আসলে গোটা দলটাই সেদিন অসাধারণ ছিল। রক্ষণে হ্যারি ম্যাগুয়ার আর জন স্টোনস যেন ছিল পাথরের দেয়াল। রাহিম স্টার্লিংয়ের কথা আলাদা করে বলতেই হবে। ওর সাথে কেনের বোঝাপড়া ছিল অন্যরকম। অথচ দেখুন, হপ্তা দুই আগেই এদের নিয়ে কত সমালোচনা? কী হাস্যকর, তাই না!

ডেনমার্কের বিপক্ষে কেনের গোলটা অসাধারণ কিছু ছিল না। তবে হলপ করে বলছি  হ্যারি এটা নিয়ে বিন্দুমাত্র বিচলিত নয়। এই গোলটাসহ টুর্নামেন্টে তার গোলসংখ্যা ৪; বিশ্বকাপ এবং সব ইউরো মিলে ১০। দুই আসর মিলে আমার গোল ৯ আর গ্যারি লিনেকারের সর্বোচ্চ ১০। আমি তো বটেই, গ্যারিও নিশ্চয়ই চাইছে, এই রেকর্ডটা এককভাবে হ্যারির নামে হয়ে যাক আজ।

নিশ্চিত থাকুন এই সংখ্যাগুলো হ্যারিরও মুখস্ত। শুধু এই ১০টি নয়, ক্যারিয়ারের প্রতিটি গোল কবে, কোথায়, কার বিপক্ষে...খুঁটিনাটি সব সে মনে রাখে; নিজের গোল নিয়ে সে এতটাই মোহগ্রস্থ। আর যতই সে মুখ দিয়ে বলুক 'গোল্ডেন বুট নিয়ে ভাবছি না', আমি তো এটা একদমই বিশ্বাস করছি না। গোল্ডেন বুটের স্বপ্ন সে অনেক আগে থেকেই দেখছে।

শিয়ারারের সঙ্গে হ্যারি কেন। ছবি: গেটি ইমেজেস

একই সাথে ট্রফি আর গোল্ডেন বুট? বিরল একটা ঘটনা। শুধু ১৯৭০ বিশ্বকাপে জার্ড মুলারের নামটাই বলা যাবে। কেন যদি এই বিরল কৃতিত্বের স্বপ্ন দেখতে চায় অবশ্যই ওকে দোষ দেয়া যাবে না। দু’টো গোলই তো লাগে! আমি ওর পক্ষে বাজি ধরতে রাজি আছি।

এই কথাটা আমি মনে-প্রাণে বিশ্বাস করি, একজন সেন্টার ফরোয়ার্ডের জীবন জোয়ার-ভাটার মতো। ক্রোয়েশিয়া আর স্কটল্যান্ডের বিপক্ষে যে শ্লথ, দিকাহারা হ্যারি কেনকে আপনারা দেখেছেন, সেই একই কেন এখন যেন জীবনের সেরা ফর্মে ছুটছে। তাকে নিয়ে সব সমালোচনা বন্ধ করে দিয়েছে একটা মাত্র সূত্র প্রয়োগে: গোলের পর গোল করা।

সব স্ট্রাইকার বা সেন্টার ফরোয়ার্ড গোলশিকারি হয় না। কিন্তু কেন একজন জাত গোলশিকারি। আমিও ছিলাম। গোল করাটাই আমাদের জীবন। আমাদের উপর সবসময় চাপ থাকে। আপনিই দলের সেরা খেলোয়াড়, যখন গোলের জন্য দল মরিয়া তখন আপনার দিকেই সবাই তাকিয়ে থাকে। এটা অনন্ত চাপ। তবে আমি এই চাপটা উপভোগ করতাম। দলের প্রয়োজনের মুহূর্তে গোল করে নায়ক বনে যাওয়াটা দুর্দান্ত একটা অভিজ্ঞতা। সারা শরীরে কেমন যেন একটা অ্যাড্রেনালিনের স্রোত বয়ে যায়।

ছবির উল্টো দিকটাও অবশ্য আছে। যখন আপনি গোল করতে পারবেন না, তখন কোন কিছুই ভাল লাগবে না। আপনার দিনটা বিষণ্ণ মনে হবে, রাতে দুঃস্বপ্ন দেখবেন, সারা সপ্তাহ বিশ্রী একটা অনুভূতি আচ্ছন্ন করে রাখবে আপনাকে। যখন আপনি গোল পাচ্ছেন না তখন সবকিছু নিষ্ঠুর মনে হবে। এমনকি আপনি গোল না করার পরও যদি দল জেতে, দেখবেন আপনার উৎসবটা নিষ্প্রাণ হবে। খেলার মাঠ থেকে জিতে বের হয়ে আসাটাই সবচেয়ে বড় কথা। কিন্তু স্ট্রাইকাররা সব সময় নিজে গোল করে জেতাতে চায়। নিজের গোল নিয়ে তারা মোহগ্রস্থ হয়ে থাকে।

এবারের ইউরোর গোড়ার দিকের ম্যাচগুলোতে ইংল্যান্ড অপরাজিত থাকলেও আপনি নিশ্চয়ই খেয়াল করেছেন, হ্যারিকে প্রাণবন্ত লাগছিল না। তাকে কিছুটা দিশেহারা, উদভ্রান্ত লাগছিল। কিন্তু এখন পুরো বিপরীত অবস্থা। ডেনমার্কের বিপক্ষে মাঠে ওর গতিবিধি দারুণ বুদ্ধিদীপ্ত লাগছিল; যখন, যেখানে, যেভাবে থাকার কথা, ঠিক সেভাবেই ওকে পাওয়া যাচ্ছিল। প্রথম গোলটার সূচনাতে বুকায়ো সাকাকে সে যে পাসটা দিয়েছিল, সেটা তো এখনো চোখে লেগে আছে।

তার ক্যারিয়ারটা কিন্তু শুরুতে ফুলেল ছিল না। তাকে ধারে লেটন, মিলওয়াল, নরইউচ আর লেস্টার সিটিতে পাঠানো হয়েছে; এমন অনেক কিছুই করতে সে বাধ্য হয়েছে, যেটা তার মোটেই পছন্দসই ছিল না। কিন্তু প্রকৃত লড়াকুর মতো সে সব কিছু মোকাবিলা করে আজ এখানে এসেছে।

ডেনমার্কের বিপক্ষে ম্যাচে হ্যারি কৌশলে বেশ কিছু ফ্রি-কিক আদায় করে নিয়েছে এবং তার সাথে কিছু মূল্যবান সময়ক্ষেপণ (লিড নেওয়ার পর) করেছে। একজন কুশলী সেন্টার ফরোয়ার্ডের কাছে দল কিন্তু এই জিনিসটাও আশা করে। ইংল্যান্ডের পরের ম্যাচের দল ইতালি অনেকদিন ধরেই এই কাজটা নিয়মিত করে আসছে। ব্যাপারটা দারুণ যখন আপনি এগিয়ে থাকা দলে আছেন। কিন্তু আপনি যখন পিছিয়ে পরা দলে আছেন, তখন এটা আপনাকে মানসিকভাবে আরও পিছিয়ে দেবে।

আরও এক ম্যাচে এমন হাসিমুখে মাঠ ছাড়তে চাইবেন কেনরা। ছবি: গেটি ইমেজেস​​​​​​

ফাউল আদায় করে নেওয়া মানেই কিন্তু ভেবে বসবেন না ইচ্ছা করে ডাইভ দেয়া বা প্রতারণা করা। আপনাকে বুদ্ধি খাটিয়ে প্রতিপক্ষকে ফাউল করতে উদ্বুদ্ধ করতে হয়, ঠিক এমন সময়ে বলের সামনে পা রাখতে হয় যখন মরিয়া প্রতিপক্ষের ফাউল না করে উপায় থাকে না। আপনি জানেন আপনি ব্যাথা পেতে যাচ্ছেন, তারপরও দলের কথা ভেবে আপনাকে স্বেচ্ছায় পা বাড়িয়ে ফাউলের শিকার হয়ে প্রতিপক্ষের আক্রমণের ধারাটা নষ্ট করে দিতে হবে। এতে আপনার দলের রক্ষণভাগ একটু দম ফেলার সুযোগ পেল, আবার হয়তো ভাল একটা ফ্রি-কিক নিয়ে একটা সুযোগও তৈরি করে ফেললেন।

এই হলো হ্যারি কেন, যখন ফর্মে আছে তখন খুব স্পেশাল একজন ফুটবলার। এবং এরকম স্পেশাল একজন খেলোয়ারের পেছনে ক্লাবগুলো সার বেঁধে দাঁড়াবে, এটাই তো স্বাভাবিক। সাথে এটাও মনে রাখতে হবে, রোববার জিতলে সেটা হবে কেনের ক্যারিয়ারে জেতা প্রথম কোনো বড় ট্রফি। জীবনের প্রথম বড় ট্রফি জাতীয় দলের হয়ে জেতার পর কি তার ট্রফি-ক্ষুধা কমে যাবে? আমি তা মনে করি না। আমার মনে হয় টটেনহ্যাম ছাড়ার সিদ্ধান্ত সে এরই মধ্যে নিয়ে ফেলেছে।

ডেনমার্কের বিপক্ষে সেমিতে জেতার পর আমরা আনন্দে উন্মাতাল হয়ে উঠেছিলাম। হব নাই বা কেন, আমার জীবদ্দশায় তো কোন দিন ইংল্যান্ডকে আমি এরকম আসরের ফাইনালে উঠতে দেখিনি। ফাইনালে নামার আগে কিভাবে প্রস্তুতি নিতে হয়, আমরা কেউই জানি না। ‘কি করবে ইংল্যান্ড? কি হবে?' ভেবে আমরা আসলেই পাগুলে আচরণ করছি।

ড্যানিশরা মোটেও সহজ প্রতিপক্ষ ছিল না। পুরো মৌসুমে এই প্রথম আমরা শুরুতে গোল খেয়ে পিছিয়ে পরেছিলাম। এ রকম বড় আসরে শুরুতেই গোল খেয়ে বসা মানে আপনি চাপ অনুভব করতে বাধ্য। শান্ত থাকাটা কখনোই ইংল্যান্ড দলের সমার্থক ছিল না। কিন্তু ম্যাচটা পেছন থেকে এসে জিততে আমাদের সেটাই করতে হতো এবং ছেলেরা দুর্দান্তভাবে করে দেখিয়েছে।

গ্যারেথ সাউদগেটের জন্য আরেকটা কঠিন কাজ ছিল লিড নেওয়ার পর জ্যাক গ্রিলিশকে মাঠ থেকে উঠিয়ে নেয়া। একদিকে যেমন জ্যাক এটা পছন্দ করে না (কারণ এটা কিছুটা বিব্রতকর), অন্য দিকে ফ্যানদের কাছে সে বিপুল জনপ্রিয়। খেলার ফলাফল ভিন্ন হলে গ্যারেথকে এটার জন্য প্রচুর সমালোচনা শুনতে হতো। কিন্তু রক্ষণ কৌশলে জ্যাকের উপর গ্যারেথের ভরসা কম বলে তাকে এই কঠিন সিদ্ধান্ত নিতে হয়েছে। এখানে গ্যারেথের প্রশংসা করতেই হয়।

আরেকটি ব্যাপারে গ্যারেথের প্রশংসা না করলেই নয়। এই যে আজ কেনকে নিয়ে আমরা এত আশাবাদী হতে পারছি, সেটা কিন্তু গ্যারেথ সাউথগেটের জন্যই। গ্রুপের প্রথম ২ ম্যাচ গোলহীন থাকায় যখন হ্যারিকে নিয়ে সমালোচনা হচ্ছিল, তখন ঢাল হয়ে দাঁড়িয়েছিল গ্যারেথই, 'কোন সন্দেহ নেই ও (কেন) আমাদের সেরা খেলোয়াড়, দলের হয়ে ও যা করেছে তাতে দলে ওর গুরুত্ব অপরিসীম।'

আর মাত্র একটা ম্যাচ, সঙ্গে দু’টো গোল। ব্যস, অমরত্বের পথে হ্যারি কেনের আরেক পা।

*'দ্য অ্যাথলেটিক' থেকে ভাষান্তর করেছেন আজহারুল ইসলাম।

সম্পর্কিত বিষয়:

শেয়ার করুনঃ
আপনার মন্তব্য
আরও পড়ুন
×