রাকিব কেন ওই ব্যাক পাসটা দিতে গেল, বুঝতেই পারছি না
সাইফুল বারী টিটু
১৪ অক্টোবর ২০২১
সাফ চ্যাম্পিয়নশিপ ফাইনাল যখন হাতছানি দিয়ে ডাকছে, তখনই সর্বনাশ! গোলকিপার লাল কার্ড দেখায় বাংলাদেশ ১০ জনের দল, ৮৮ মিনিটে বিতর্কিত পেনাল্টিতে নেপালের সমতা ফেরানো। যে ম্যাচ দেখার পর থেকে আফসোসে পুড়তে থাকা কোচ সাইফুল বারী টিটু খেলায় ভাগ্যের গুরুত্ব আবার নতুন করে উপলব্ধি করছেন। সঙ্গে খুঁজে বেড়াচ্ছেন একটা প্রশ্নের উত্তরও...রাকিব অমন একটা ব্যাক পাস কেন দিতে গেলেন?
এর চেয়ে বড় দুর্ভাগ্য আর হতে পারে না। সাফ চ্যাম্পিয়নশিপে নেপালের বিপক্ষে ম্যাচে বাংলাদেশের নিশ্চিত জয়টা হারিয়ে গেল দুর্ভাগ্যজনকভাবে। তাতে প্রায় দেড় দশক পর সাফ চ্যাম্পিয়নশিপের ফাইনালে আমাদের খেলার সম্ভাবনাটা মাটি হয়ে গেল। স্রেফ একটা সিদ্ধান্তের কারণে হৃদয় ভাঙল। রাকিবের ওই ব্যাক পাসটার কারণেই সব শেষ হয়ে গেল। নেপাল ১-০তে পিছিয়ে থাকার পর ১-১ গোলে ড্র করে উঠে গেল ফাইনালে। বাংলাদেশের হলো করুণ বিদায়।
এই খেলা দেখে আরও একবার বুঝলাম, সব কিছুর শেষে ভাগ্যের দরকার হয়। ভাগ্যে না থাকলে কিছুই হয় না। ভালো খেলেও অনেক সময় জেতা যায় না। আমরা যেটা প্রত্যাশা করেছিলাম. কোচ অস্কার ব্রুজোন তেমন একটা দলই নামিয়েছিলেন মাঠে। মতিন মিয়ার বদলে সুমন রেজাকে খেলানো দুর্দান্ত একটা সিদ্ধান্ত ছিল। খুব ইতিবাচক বলব। সুমন গোল করা ছাড়াও ডিফেন্স করার সময় নেপালের ফরোয়ার্ড লাইনকে যেভাবে রুখে দিচ্ছিল, সেটা আলাদা করে বলতে হয়। ফাউল হোক বিংবা অন্য উপায়ে নেপালের বিল্ড-আপ ঠেকাচ্ছিল। আক্রমণ জমাট বাঁধতে দিচ্ছিল না। খুব কাজে দিয়েছে ওটা।
ইয়াসিন আরাফাত দুই হলুদ কার্ডের কারণে খেলতে পারেনি বলে একটা ঝুঁকি তো নিতেই হয়েছে। ওর জায়গায় তারেক কাজিকে লেফট-ব্যাকে দিয়ে বাদশাহকে ওখানে আনা হয়েছিল। আমরা আগেই আলাপ করেছিলাম, নেপাল ব্লক করলে সেটা কিভাবে খোলা যায়, তা নিয়ে।ডিফেন্সকে নিরাপদ রেখে তা করার উপায় নিয়ে। কিন্তু সবকিছু বদলে যায় ৯ মিনিটের ওই গোলটায়। সুমন রেজা জালে বল জড়ানোয় বাংলাদেশ আপার হ্যান্ডে চলে যায়। ম্যাচ শুরুর আগে যেটা আসলে নেপালের ছিল। ওদের তো শুধু ড্র করলেই চলে, এই ছিল সমীকরণ। বাংলাদেশের জিততেই হতো।
নেপাল পিছিয়ে পড়লে তখন আমরা আমাদের সিদ্ধান্তগুলো ভালোভাবে নিতে পেরেছি। স্লো বিল্ড-আপ হোক বা যেটাই হোক, সেটা থেকে কাউন্টার অ্যাটাকে সুযোগ তৈরি করতে পেরেছি। প্রথমার্ধে যেটা সুমন রেজা সরাসরি গোলকিপারকে মারল, সেটা ইব্রাহিমকে পাস দিতে পারত। দ্বিতীয়ার্ধে আবার সুমন রেজার শট অল্পের জন্য বাইরে যায়। রাকিবও একটা সুযোগ পেয়েছিল। বলটা পাস করেনি। গোলে মেরে দিল।
সব মিলে অবশ্য বলব, আমাদের পরিকল্পনা এবং বডি ল্যাঙ্গুয়েজ ছিল খুব ভালো। এর পাশাপাশি গোল পেয়ে যাওয়ায় বাংলাদেশ অনেক এগিয়ে যায়। নেপালের তখন বাংলাদেশের ব্লক ভাঙতে লম্বা পাসে খেলতে হয়। শুরুতে পজেশন রেখে রেখে বল পায়ে খেলছিল। এরপর আমরা গোল পেয়ে ব্লক তৈরি করে ফেলায় ওদের ওগুলো আর কাজে আসছিল না। মিডফিল্ডে বাংলাদেশ অনেক ভালো করেছে। যে কারণে ওরা পেরে উঠছিল না।
আলোচনা করেছিলাম সেট পিসে গোল পাওয়া নিয়ে। সেটাই হয়েছে। প্রধমার্ধে লিড নিয়ে নেওয়ার পর দ্বিতীয়ার্ধে আমরা নেপালকে আরো বেশি হতাশায় ডুবিয়ে ফেলতে পেরেছিলাম। প্রধমার্ধে তারা যতটা ডমিনেট করছিল. ততটা দ্বিতীয়ার্ধে আর করতে পারেনি। ওদের লং পাস খেলা এবং বল হারানো আর আমাদের কাউন্টার অ্যাটাকে খেলা ভালো হচ্ছিল। নেপালকে আক্রমণে তাদের অর্ধে রাখা যাচ্ছিল। আমাদের ওপর ওরা যাতে চড়ে না বসতে পারে. সেই পরিকল্পনা ভালো কাজে দিচ্ছিল। এই সময় অস্কারের বদলি খেলোয়াড় নামানোটাও চমৎকার ছিল। ইব্রাহিমের বদলে মতিন মিয়াকে নামানোটা ভালো সিদ্ধান্ত ছিল। সুমন রেজা ও মতিন দুজনই স্ট্রাইকার। কাউন্টারে গোল করার চেষ্টার ব্যাপারটা ছিল।
সবকিছু পক্ষে যাচ্ছিল। দ্বিতীয়ার্ধে নেপালের আক্রমণের পর শেষটায় জিকো অসাধারণ কিছু সেভ করে। একটা সময়ে মনে হচ্ছিল, নেপাল আর পারবে না। ওরা ব্লক ভাঙার জন্য কিছু করতে পারছিল না।
খেলার টার্নিং পয়েন্ট হলো ৭৯ মিনিটের ওই ঘটনাটা। রাকিব মাঝমাঠেরও ১০/১৫ গজ দূর থেকে ব্যাক পাস করে দিল। এই যে একটা সিদ্ধান্ত নেওয়ার সমস্যা, তা যে কেন! শেষ পর্যন্ত ফুটবলের রেজাল্টের দায়দায়িত্ব কোচের ওপরই বর্তায়। কিন্তু এখানে পরিস্থিতিটা দেখুন। আমি বুঝলাম না, রাকিব ওই সিদ্ধান্তটা কেন নিল। এইসব সিদ্ধান্তে কোচের কী করার থাকে? আমার খুবই আফসোস হচ্ছে। আমি ভাবতেই পারছি না, রাকিব ওই কাণ্ডটা করেছে।
এত দূর থেকে কেন সে বলটা গোলকিপার জিকোকে দেওয়ার চেষ্টা করল? জিকো যেটা করেছে, সেটা ঠিকই আছে। ও বড় ডি-এর ওপর উঠে আসে। ওর হাতে না লাগলে তো বলটা গোলেই রূপ নিত। জিকোর কিছু করারও ছিল না। বলটা ওর হাতে লেগে গেছে। বড় 'ডি' এর বাইরে গোলকিপার হাত দিয়ে বল আটকালে লাল কার্ড হবে তা আমরা জানি। ওর কিন্তু এটা লেগে গিয়েছিল। ইচ্ছাকৃত না। আটকাতে যায়নি। আফসোসের জায়গা হলো রাকিবকে নিয়ে। ওপরে এত খেলোয়াড় ছিল তাদের না দিয়ে কেন সে ব্যাক পাস করল। আরেক পাশেও তো বলটা দিতে পারত রাকিব। অঞ্জন বিশতা খুব দ্রুতগতির খেলোয়াড়। রাকিবের দেওয়া বলটায় জোর ছিল না। অঞ্জন ওটা ধরে ফেলছিল। জিকোর উঠে আসা ছাড়া কোনো উপায় ছিল না।
এটাই আসলে ভাগ্য। দিনশেষে কোচের হাত কামড়ানো ছাড়া আর কিছু করার নেই। অসহায়ের মতো দেখা ছাড়া আর কি করতে পারে অস্কার।
এটা এক বড় ধাক্কা। জিকো লাল কার্ড পাওয়ায় দল ১০ জনের হয়ে গেল। খেলার বাকি তখন আরও কিছুটা সময়। এরপর বিপুলকে বসাতে হয়েছে, ফাহাদকে হোল্ডিং মিডফিল্ডার হিসেবে নামাতে হয়েছে। কয়েক মিনিটের মধ্যে খেলার পুরো চিত্রটাই বদলে গেছে। নতুন গোলকিপারকে নামাতে হয়েছে আরেকজনকে রিপ্লেস করে। শেষ ১০ মিনিটে ১০ জনের দলে পরিণত হওয়ায় চাপের একটা পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে আমাদের জন্য।
পেনাল্টিটার ব্যাপারে কথা আছে। ওই খেলোয়াড় অভিনয় করেছে বেশি। ঘটনাকে রঙ চড়িয়ে দেখিয়েছে। সাদ উদ্দিন নেপালি খেলোয়াড়কে ধাক্কা দিয়েছিল কি না, তা বোঝা মুশকিল। তবে নির্ধারিত ৯০ মিনিটের মিনিট কয়েক আগে নেপাল পেনাল্টি পাওয়ায় খেলাটা ঘুরে গেল।
একটা সিদ্ধান্ত কিভাবে দুর্ভাগ্য টেনে আনতে পারে, তাই আমরা দেখলাম। যেভাবে বাংলাদেশ খেলেছে তাতে জয়টা তাদেরই প্রাপ্য ছিল। পুরো ম্যাচ তাদের ছিল। ইব্রাহিমের বলটা বারের ওপর দিয়ে গেছে। সুমন রেজা যে ওয়ান টু ওয়ান পেল গোলকিপারকে সেটা সে দ্বিতীয় বারে প্লেস করতো নিয়ার পোস্টে না মেরে তাহলে তো খেলা আরও বদলে যেতে পারত। তখনই ২-০ হয়ে যেত।
তো এর চেয়ে বড় দুর্ভাগ্যের কিছু আর হতে পারে না। আমি বলব, এই আসরে এটা ছিল বাংলাদেশের সেরা পারফরম্যান্স। পরিকল্পনা অনুযায়ী সেরা খেলা ছিল। কিন্তু সবকিছু শেষ হয়ে যায় এক সিদ্ধান্তে। হায়! এত কাছে এসেও সাফ চ্যাম্পিয়নশিরে ফাইনাল খেলাটা হলো না কেবল কপালে না থাকায়।