কান্নার ব্রাজিল

রিও ২০১৬ অলিম্পিকের দিন–রাত

উৎপল শুভ্র

২০ জুলাই ২০২১

কান্নার ব্রাজিল

ছবি: গেটি ইমেজেস

শেষের বাঁশি বাজতে শুরু করেছে। যেটি শুনতে পাচ্ছি দুই দিন আগে থেকেই। আগেই আপনাদের জানিয়েছি, কোপাকাবানায় যে অ্যাপার্টমেন্টে থাকছি, সেটির জানালা দিয়ে বিচ ভলিবল অ্যারেনাটা দেখা যায়। সকাল থেকে শুরু হয়ে গভীর রাত পর্যন্ত যেখানে খেলা হতো। সকাল-দুপুর-সন্ধ্যা-রাত লোকজনে গমগম

প্রথম প্রকাশ: ২১ আগস্ট ২০১৬। প্রথম আলো

শেষের বাঁশি বাজতে শুরু করেছে। যেটি শুনতে পাচ্ছি দুই দিন আগে থেকেই। আগেই আপনাদের জানিয়েছি, কোপাকাবানায় যে অ্যাপার্টমেন্টে থাকছি, সেটির জানালা দিয়ে বিচ ভলিবল অ্যারেনাটা দেখা যায়। সকাল থেকে শুরু হয়ে গভীর রাত পর্যন্ত যেখানে খেলা হতো। সকাল-দুপুর-সন্ধ্যা-রাত লোকজনে গমগম করত কোপাকাবানা। এই সৈকতে মানুষ সব সময়ই থাকে। তবে বিচ ভলিবল শেষ হয়ে যাওয়ার পর সেই উৎসবের আমেজটা যেন হারিয়ে গেছে। বিশ্বমানবের মিলনমেলা যে শেষ হতে চলেছে, সেই বার্তাটাও আগাম দিয়ে ফেলছে।

বিচ ভলিবলে শেষটা অবশ্য ব্রাজিলিয়ানদের মনমতোই হয়েছে। পুরুষদের সোনা জিতেছে ব্রাজিলই। সেই উল্লাস ঘরে বসেই শুনতে পেয়েছি। নিজের চোখেই দেখতে চেয়েছিলাম। ট্যাক্সিতে প্রায় এক ঘণ্টা দূরত্বের অ্যাথলেটিকস স্টেডিয়াম থেকে ফেরার পর আর শরীরে কুলায়নি। ব্রাজিলিয়ান জুটির প্রতিক্রিয়াটা জানলাম পরে। যেটি খুব ইন্টারেস্টিং। কোপাকাবানাকে তাঁরা বলেছেন ‘বিচ ভলিবলের মারাকানা’। বিচ ভলিবলের ‘স্পিরিটুয়াল হোম’ বলা হয় এই কোপাকাবানাকে, তাতে নিজেদের দর্শকের সামনে সোনা জেতার এই অনুভূতির আসলেই কোনো তুলনা হয় না।

আগের রাতের হতাশায় একটু সান্ত্বনার প্রলেপও পড়েছে তাতে। ব্রাজিলিয়ান মেয়েরা যে হেরে গেছেন ফাইনালে। হেরে কেঁদেছেন—এটা না বললেও চলে। ব্রাজিলিয়ানরা কান্নার ওস্তাদ। দুই বছর আগে বিশ্বকাপ ফুটবলে এর প্রমাণ নিশ্চয়ই পেয়েছেন। জিতে কেঁদেছেন ব্রাজিলিয়ান ফুটবলাররা, হেরেও কেঁদেছেন। খেলোয়াড়েরাই যদি কাঁদে, দর্শক কি আর পিছিয়ে থাকতে পারে নাকি! তাঁরাও কেঁদেছেন।

এই অলিম্পিকে কান্নার সবচেয়ে বড় প্রদর্শনী হয়েছে দিন পাঁচেক আগে। মেয়েদের ফুটবলের সেমিফাইনালে সুইডেনের কাছে টাইব্রেকারে হেরে মারাকানায় কেঁদেছেন মার্তারা। এর ঘণ্টা সাতেক পর মারাকানার পাশেই ‘ছোট মারাকানা’ মানে মারাকানাজিনহোতে যে কান্নাকাটি হলো, সেটির তুলনায় অবশ্য মার্তাদের কান্না কিছুই নয়। ভলিবলের কোয়ার্টার ফাইনালে চীনের কাছে হারার পর ব্রাজিলিয়ান মেয়েদের কান্না আর থামেই না। কোর্টে খেলোয়াড়েরা কাঁদছেন, গ্যালারিতে দর্শক। এসবে অবাক হওয়ার কিছু ছিল না। অবাক হতে হলো, টেলিভিশন ধারাভাষ্যকারকেও কাঁদতে দেখে। ব্রাজিল মহিলা দলের সাবেক কোনো খেলোয়াড়ই হয়তো হবেন। কথা বলছেন আর কাঁদছেন!

ফুটবলের তুলনায় ভলিবলে কান্নাকাটি বেশি হওয়ার কারণও আছে। ফুটবলে কখনো অলিম্পিকে সোনা জেতেনি ব্রাজিল। ভলিবলে ব্রাজিলিয়ান মেয়েরা যেখানে আগের দুবারের চ্যাম্পিয়ন। আর উন্মাদনার দিক থেকে ব্রাজিলিয়ানদের কাছে ভলিবল যে ফুটবলের খুব কাছাকাছিই, এটাও তো আগেই লিখেছি। ফুটবলের মতো ভলিবলেও ফাইনালে উঠেছে ব্রাজিলিয়ান ছেলেরা। দুটির সেমিফাইনালই একই রকম একপেশে হয়েছে। ৬-০টা হয়তো একটু বেশি হয়ে গেছে, তবে ফুটবলে হন্ডুরাসের বিপক্ষে ব্রাজিলের বড় জয় প্রত্যাশিতই ছিল। তবে ভলিবলে যেটা হয়েছে, তা একটু অপ্রত্যাশিতই। গতবারের চ্যাম্পিয়ন রাশিয়াকে সরাসরি ৩-০ সেটে হারিয়ে দিয়েছে ব্রাজিল। মধুর একটা প্রতিশোধও নেওয়া হয়েছে তাতে। চার বছর আগে লন্ডন অলিম্পিকে এই রাশিয়ার বিপক্ষেই ২-০ সেটে এগিয়ে যাওয়ার পর তৃতীয় সেটে ম্যাচ পয়েন্ট পেয়েও শেষ পর্যন্ত অবিশ্বাস্যভাবে ৩-২ সেটে হেরেছিল ব্রাজিল।

নিজের কান্না চেপেই সতীর্থকে সান্ত্বনা দিতে হয়েছিল মার্তাকে। ছবি: গেটি ইমেজেস

এই লেখা যখন লিখছি, ফুটবলের ফাইনাল শুরু হতে ঘণ্টা পাঁচেক বাকি। ভলিবলের ফাইনাল হবে পরদিন মানে আজ। এই দুটি জিততে পারলে ব্রাজিল এই অলিম্পিকে না-পাওয়ার বাকি সব দুঃখ ভুলে যাবে। 

স্বাগতিকদের পারফরম্যান্স নিয়ে সব সময়ই বাড়তি একটা আগ্রহ থাকে অলিম্পিকে। নিজেদের দেশে সেরা পারফরম্যান্স করাটা একরকম নিয়মও। ব্রাজিলের আগের সেরা কী ছিল, ঠিক জানি না। তবে অলিম্পিকে স্বাগতিকদের পারফরম্যান্স নিয়ে বসলে এই অলিম্পিকের ব্রাজিল বোধ হয় একটু পিছিয়েই থাকবে। শেষ দুই দিনে আরও বেশ কিছু ইভেন্ট আছে। এর আগ পর্যন্ত পদক তালিকায় ব্রাজিলকে দেখলে মনে হতে পারে, এরা পাঁচের নামতা পড়ে এই অলিম্পিকে নেমেছে। ৫টি সোনা, ৫টি রুপা, ৫টি ব্রোঞ্জ। মোট পদক ১৫টি, পদক তালিকায় অবস্থানও ১৫ নম্বরে!

ফুটবল-ভলিবল নিয়ে মাতামাতি থাকতে পারে, তবে ব্রাজিলিয়ানরা সার্বিকভাবে যে খুব খেলাপ্রিয় জাতি, সেটি বলা যাচ্ছে না। নইলে কি আর উসাইন বোল্টের ২০০ মিটারের সময়ও গ্যালারির এক-তৃতীয়াংশেরও বেশি খালি পড়ে থাকে! গত পরশু রাতে অলিম্পিকে বোল্টের শেষ ইভেন্ট ৪×১০০ মিটার রিলের সময়ও গ্যালারির একই অবস্থা। এখানেই ব্রিটিশরা বিপুল ব্যবধানে হারিয়ে দিচ্ছে ব্রাজিলিয়ানদের। লন্ডন অলিম্পিকে অ্যাথলেটিকস ফাইনাল তো বটেই, সকালে হিটের সময়ও কানায় কানায় ভরা থেকেছে গ্যালারি। স্বাগতিক হওয়ার সুবিধা কাজে লাগিয়ে লন্ডনে ইতিহাসের সেরা সাফল্য পেয়েছিল গ্রেট ব্রিটেন। এটি কোনো বিস্ময় নয়। বিস্ময় হলো, এবার সেটিকেও ছাড়িয়ে যাওয়ার সম্ভাবনা জাগানো। লন্ডনে মোট ৬৫টি পদক জিতেছিল, এবার শেষ দুই দিন বাকি থাকতেই জিতে ফেলেছে ৬০টি। আর ৬টি পদক পেলে স্বাগতিক কোনো দেশের পরের অলিম্পিকে আরও ভালো করার নতুন ইতিহাস হয়ে যাবে।

অলিম্পিকের চূড়ান্ত পদক তালিকাটাও একটু অন্য রকম দেখাবে। যেখানে ১৯৮৪ সালে অলিম্পিকে প্রথমবার অংশ নেওয়ার দিন থেকেই যুক্তরাষ্ট্রের প্রতিদ্বন্দ্বী হয়ে আছে চীন। যারা এবার তিন নম্বরে। চীনাদের ‘সোনার খনি’ টেবিল টেনিস, ডাইভিং আর জিমন্যাস্টিকস শেষ। গ্রেট ব্রিটেনের কাছে এবার বোধ হয় তাদের হার মানতেই হচ্ছে।

শেয়ার করুনঃ
আপনার মন্তব্য
আরও পড়ুন
×