ব্রোঞ্জ জিতেই খুশি ‘সোনার মেয়ে’

২০১২ লন্ডন অলিম্পিক

উৎপল শুভ্র

২১ জুলাই ২০২১

ব্রোঞ্জ জিতেই খুশি ‘সোনার মেয়ে’

‘গো বেকি গো’ চিৎকারে কানে তালা লেগে যাওয়ার জোগাড়। তবে বেকি মানে রেবেকা নিজেকে উজাড় করে দিয়েও ব্রোঞ্জের বেশি পেলেন না। স্বাগতিক দর্শকেরা হতাশ। রেবেকা অ্যাডলিংটনের ভাবভঙ্গি অবশ্য সংশয় জাগাচ্ছিল। পুল থেকে উঠে কোচকে যেভাবে আলিঙ্গন করলেন, তাতে মনে হতেই পারত, তিনিই বোধহয় সোনা জিতেছেন!

প্রথম প্রকাশ: ৩১ জুলাই ২০১২। প্রথম আলো

সোনা ধরে রাখার লড়াইয়ে নেমে ব্রোঞ্জ জিতলে কেউ খুশি হতে পারে! 

রেবেকা অ্যাডলিংটন শুধু খুশি নন—‘খুবই খুবই খুশি’! ‘ভেরি ভেরি হ্যাপি’র বাংলা তো তা-ই হয়!

গত পরশু মেয়েদের ৪০০ মিটার ফ্রি-স্টাইল সাঁতারের সময় দর্শকদের চিৎকারে অলিম্পিকের অ্যাকুয়াটিক সেন্টার ভেঙে পড়ার উপক্রম। ‘গো বেকি গো’ চিৎকারে কানে তালা লেগে যাওয়ার জোগাড়। তবে বেকি মানে রেবেকা নিজেকে উজাড় করে দিয়েও ব্রোঞ্জের বেশি পেলেন না। স্বাগতিক দর্শকেরা হতাশ। রেবেকা অ্যাডলিংটনের ভাবভঙ্গি অবশ্য সংশয় জাগাচ্ছিল। পুল থেকে উঠে কোচকে যেভাবে আলিঙ্গন করলেন, তাতে মনে হতেই পারত, তিনিই বোধহয় সোনা জিতেছেন!

রহস্যটা পরিষ্কার হলো সংবাদ সম্মেলনে। যখন সোনালি চুলের ব্রিটিশ সাঁতারু অবলীলায় বলে দিলেন, ‘আমি তো পদকের আশাই করিনি। হ্যাঁ, লোকে তা করেছে। সমস্যা হলো, আমি কী প্রত্যাশা করতে পারি, সেটিও লোকে ঠিক করে দেয়। তবে আমি খুবই খুবই খুশি। আমি আমার সেরাটা দিয়েছি।’

লোকেরই বা কী দোষ! বেইজিং অলিম্পিকের পর থেকেই যে ব্রিটিশদের কাছে রেবেকা অ্যাডলিংটন ‘সোনার মেয়ে’। সেবার ৪০০ মিটার ফ্রি-স্টাইলে ব্রিটিশ ট্রায়ালেই বাদ পড়ে যাওয়ার অবস্থা হয়েছিল। বেইজিংয়ে ফাইনালে ওঠাটাকেই তাই মনে করা হচ্ছিল বড় অর্জন। অথচ ৫০ মিটার বাকি থাকতেও চারজনের পেছনে থাকা রেবেকা কী এক অলৌকিকতায় ভর করে সবাইকে ছাড়িয়ে গেলেন! পাঁচ দিন পর জিতলেন ৮০০ মিটার ফ্রি-স্টাইলও। 

ব্রিটেনের ইতিহাসে সফলতম মহিলা সাঁতারুকে নিয়ে এরপর কী মাতামাতিই না হয়েছে! পত্রপত্রিকার প্রথম পৃষ্ঠাজুড়ে তো ছিলেনই। নটিংহামের কাছে তাঁর নিজের শহর ম্যানসফিল্ডে খোলা বাসে প্যারেড হয়েছে, রেবেকার ডিজাইনার জুতোর শখের কথা জানতে পেরে শহরের মেয়র সোনার জুতো উপহার দিয়েছেন তাঁকে। পরের অলিম্পিক নিজেদের দেশে, রেবেকার কাছ থেকে আবারও দুটি সোনা যেন ‘দাবি’-ই হয়ে দাঁড়িয়েছিল ব্রিটিশদের। সেই প্রত্যাশার চাপে রেবেকার চিড়েচ্যাপ্টা হয়ে যাওয়ার মতো অবস্থা। ‘বেইজিংয়ের পর যার সঙ্গেই দেখা হয়েছে, সবার একটাই কথা, তোমাকে কিন্তু লন্ডনে সোনা জিততে হবে। যেন সোনা জেতাটা খুব সহজ ব্যাপার। অলিম্পিকে কোনো পদক জেতাই সহজ নয়’—বলার ভঙ্গিতে বেশি অভিযোগ প্রকাশ পেয়ে যাচ্ছে বুঝতে পেরে যোগ করলেন, ‘আমি বুঝি, সবাই আমাকে সমর্থন করতেই অমন বলেছে। কিন্তু চাপটা অসহনীয় হয়ে দাঁড়িয়েছিল।’

ব্রোঞ্জ জিতেই হাসি রেবেকার মুখে। ছবি: গেটি ইমেজেস

৪০০ মিটার ফ্রি-স্টাইলের আগে তাঁর নাম ঘোষণা করতেই তুমুল চিৎকার। সেই অনুভূতিটা বলে বোঝাতে কষ্ট হলো রেবেকার, ‘আমার টিমমেটরা সবাই জানে, সাঁতারের আগে আমি সব সময়ই খুব নার্ভাস থাকি। কিন্তু আজকের মতো অবস্থা হয়নি কখনো। মুখ তুলে দর্শকদের দিকে তাকাতেও ভয় লাগছিল। মনে হচ্ছিল, আমি অজ্ঞান হয়ে যাব।’ পারলেন না কি এ কারণেই? ‘পারলেন না’ কথাটাই পছন্দ নয় রেবেকার, ‘আমি তো বলেছিই, একটা যে পদক পেয়েছি তাতেই আমি খুশি। তবে আজকের মতো অভিজ্ঞতা জীবনে হয়নি। এই আবেগের একটা ধকল তো গেছেই আমার ওপর দিয়ে।’ 

প্রথম দিন নিষ্ফলা কাটার পর গত পরশু দ্বিতীয় দিনে পদক তালিকায় নাম উঠল স্বাগতিক ব্রিটেনের। রেবেকা অ্যাডলিংটনের ব্রোঞ্জটা ব্রিটেনের দ্বিতীয় পদক। এর আগেই মেয়েদের রোড রেসে রুপা জিতে বন্ধ্যাত্ব ঘুচিয়েছেন সাইক্লিস্ট লিসি আর্মিস্টিড। এক সাংবাদিকের প্রশ্নের জবাবে নারীশক্তির জয়গান গাওয়ার সুযোগটা নিয়ে নিলেন রেবেকা। হাসি দিয়ে বললেন, ‘পুরুষেরা অনেক কর্তৃত্ব করেছে। এবার নারীদের এগিয়ে আসার পালা। আমি চাই, আরও মেয়ে খেলাধুলায় আসুক। নারীত্ব বজায় রেখেও যে ক্রীড়াবিদ হওয়া যায়, আশা করি, মেয়েরা তা বুঝতে পারবে।’

নিজের নারীত্ব নিয়ে গর্বিত। সেটি প্রকাশে কোনো সংকোচও নেই। সংবাদ সম্মেলন শুরু হওয়ার আগে মঞ্চের পাশে দাঁড়িয়ে চুল আঁচড়ে নিলেন। নীল চোখ, সোনালি চুল, স্বর্ণাভ গায়ের রং—‘সোনার মেয়ে’ কথাটা তাঁর সঙ্গে দিব্যি মানিয়ে যায়। আবারও সেটি প্রমাণের সুযোগও শেষ হয়ে যায়নি। ৮০০ মিটার ফ্রি-স্টাইল এখনো আছে। ‘ওটাই আমার প্রিয় ইভেন্ট’—রেবেকা অ্যাডলিংটনের কথায় এবার একটু প্রতিশ্রুতির সুর।

দর্শকদের উন্মাদনার সঙ্গে প্রথম পরিচয়টা যে হয়ে গেছে।

শেয়ার করুনঃ
আপনার মন্তব্য
আরও পড়ুন
×