ব্রিটিশ শো’তে বিশ্বকে আমন্ত্রণ

২০১২ লন্ডন অলিম্পিক

উৎপল শুভ্র

২১ জুলাই ২০২১

ব্রিটিশ শো’তে বিশ্বকে আমন্ত্রণ

লন্ডন অলিম্পিকের উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে ফুটে উঠেছিল ব্রিটেনের বর্ণাঢ্য ইতিহাস। নাচ ছিল, গান ছিল, হয়েছিল রঙের উৎসব, উৎসবকে পরিপূর্ণতা দেওয়ার অপরিহার্য অনুষঙ্গ আতশবাজির ছটায় রঙিন হয়ে উঠেছিল আকাশ। সবার শেষে রানি যখন লন্ডন অলিম্পিকের আনুষ্ঠানিক উদ্বোধন ঘোষণা করলেন, বাংলাদেশে তখন উঁকি দিচ্ছে শনিবারের ভোর।

প্রথম প্রকাশ: ২৭ জুলাই ২০১২। প্রথম আলো

স্টেডিয়ামে ঢুকতেই স্বাগত জানাল কয়েক শ বছর আগের ইংল্যান্ড। মাঠ যেন বিস্তীর্ণ এক সবুজ প্রান্তর। সেখানে কোথাও চড়ে বেড়াচ্ছে ভেড়া, কোথাও বা হেলেদুলে হাঁটছে একদল রাজহাঁস। পাশে লাঠি হাতে পায়চারি করছেন দু-তিনজন বৃদ্ধা। গরু-ছাগল-ঘোড়া-মুরগি সবই খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে সেই প্রান্তরে। ফসল কাঁধে নিয়ে হেঁটে যাচ্ছে মানুষ। কোথাও চলছে বনভোজন। কোথাও ক্রিকেট, কোথাও বা ব্যাডমিন্টন। মাঠের চারপাশে সুতায় বাঁধা কৃত্রিম মেঘদল নিয়ে অলস পায়ে মাঠ প্রদক্ষিণ করে যাচ্ছেন কয়েকজন। সবার পোশাক-আশাক যেন টাইম মেশিনে করে ফিরিয়ে নিয়ে যাচ্ছে কয়েক শ বছর আগে।

শান্ত সমাহিত প্রাচীন ব্রিটিশ জীবনের এই ছবিটা পরের সাড়ে তিন ঘণ্টায় বারবার রূপ বদলাল। ফুটে উঠল ব্রিটেনের বর্ণাঢ্য ইতিহাস। নাচ থাকল, গান থাকল, হলো রঙের উৎসব, উৎসবকে পরিপূর্ণতা দেওয়ার অপরিহার্য অনুষঙ্গ আতশবাজির ছটায় রঙিন হয়ে উঠল আকাশ। রানি যখন লন্ডন অলিম্পিকের আনুষ্ঠানিক উদ্বোধন ঘোষণা করলেন, বাংলাদেশে তখন উঁকি দিচ্ছে শনিবারের ভোর।

তা সব মিলিয়ে কেমন হলো লন্ডন অলিম্পিকের উদ্বোধনী অনুষ্ঠান? ইংল্যান্ডের গণমাধ্যমে তো ধন্য-ধন্য রব। উদ্বোধনী অনুষ্ঠানের রূপকার ড্যানি বয়েল নতুন বছরে নাইটহুড পেয়ে যাবেন কি না, এমন আলোচনাও হচ্ছে। এই ভূখণ্ডে প্রায় সবকিছু নিয়েই বাজি হয়। এ নিয়েও হচ্ছে। ড্যানি বয়েলের নাইটহুড পাওয়ার সম্ভাবনা নিয়ে উইলিয়াম হিলের বাজির দর ৪-১।

ড্যানি বয়েল আগেই বলে দিয়েছিলেন, উদ্বোধনী অনুষ্ঠানটা হবে পুরোপুরিই ‘ব্রিটিশ শো’। সেটিই হলো। একটু বোধ হয় বেশিই হলো। স্বাগতিক দেশের ইতিহাস-ঐতিহ্য সব উদ্বোধনী অনুষ্ঠানেরই বড় একটা অংশ হয়ে থাকে। এখানে আর কিছু বলতে গেলে থাকলই না।

রানি দ্বিতীয় এলিজাবেথ ঘোষণা করলেন অলিম্পিকের উদ্বোধন। ছবি: গেটি ইমেজেস

যুক্তি অবশ্য আছে। শুরুতে মাঠে যে সবুজ প্রান্তরের কথা বলা হলো, উদ্বোধনী অনুষ্ঠানের শুরুতেই সেটি উধাও হয়ে সেখানে ফুটে উঠল শিল্পবিপ্লবের ছবি। মাঠ ফুঁড়ে বিশাল বিশাল সব চিমনি উঠে গেল। এখানে তাঁতকল, ওখানে ইঞ্জিন...বদলে যাওয়া মানুষের জীবনে তৈরি মহা কর্মব্যস্ত একটা আবহ। কৃষিনির্ভর সমাজ থেকে শিল্পে উত্তরণ সম্পর্কে উদ্বোধনী অনুষ্ঠানের জন্য দেওয়া গাইডবুকে যথার্থই বলা হয়েছে, কিছু পরিবর্তন একটা জাতিকে বদলে দেয়, কিছু বা বদলে দেয় পুরো বিশ্বকে।

‘প্যান্ডেমোনিয়াম’ নামে এই পর্বটা না হয় ঠিক আছে। কিন্তু কিছু জিনিস তো খটকা না জাগিয়ে পারে না। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর প্রবর্তিত স্বাস্থ্যব্যবস্থা নিয়ে ব্রিটেনের অনেক গর্ব আছে বোঝা গেল, কিন্তু সেই ন্যাশনাল হেলথ সার্ভিসের ৬০০ নার্সের (সত্যিকার নার্সই) হাসপাতালের বেড-টেড নিয়ে অমন নাচ-গানের মাহাত্ম্য বোঝা বাইরের কারও জন্য একটু মুশকিলই। আলোকিত বেডে অসুস্থ শিশুদের নাচানাচি দেখে মনে হতেই পারে, ব্রিটিশরা বুঝি অসুস্থতাকেও উদযাপন করার মতো ব্যাপার মনে করে।

ইতিহাস-ঐতিহ্য নিয়ে কিছু করতে গেলে সেটি গুরুগম্ভীর হয়ে পড়ার ভয় থাকে। উদ্বোধনী অনুষ্ঠানটা অবশ্য সেই দোষে দুষ্ট নয়। মজাও থাকল প্রচুর। শেক্সপিয়ার যেমন থাকলেন, তেমনি হ্যারি পটারের স্রষ্টা জে কে রাওলিংও। শেক্সপিয়ারের তো আর সশরীরে থাকা সম্ভব নয়। থাকল তাঁর কালজয়ী নাটক দ্য টেমপেস্ট-এর অংশবিশেষ। চমক হয়ে দেখা দিলেন মিস্টার বিন। ঘুমে জড়িয়ে আসা চোখে রোয়ান অ্যাটকিনসন স্বপ্নের অংশ হয়ে গেলেন অলিম্পিক নিয়ে নির্মিত সবচেয়ে বিখ্যাত চলচ্চিত্র চ্যারিয়টস অব ফায়ার-এর। বড় পর্দায় সেটি দেখে হাসির হুল্লোড় উঠল স্টেডিয়ামজুড়ে।

শিল্পবিপ্লবের মতোই বিশ্বকে বদলে দেওয়া ওয়ার্ল্ড ওয়াইড ওয়েবের জনক টিম বার্নার্স-লিও দেখা দিলেন এক ঝলক। মাঠের মাঝখান থেকে অন্তর্জাল ছড়িয়ে পড়ল গ্যালারিজুড়ে। ওই আলোর খেলাটা পুরো অনুষ্ঠান জুড়েই ছিল। গ্যালারিতে দর্শকদের চেয়ারের সঙ্গে লাগানো ছিল একটি ছোট্ট বর্গাকৃতির ‘পিক্সেল’। ৬,৩৭,১৯১টি বাতি লাগানো তাতে। সেটিই সারাক্ষণ নানা রঙের খেলা দেখিয়ে গেল। নির্দেশনামতো সেটি দুলিয়ে দর্শকেরাও অংশ হয়ে গেল উদ্বোধনী অনুষ্ঠানের। ২৭ মিলিয়ন পাউন্ড মোট খরচের ১০ মিলিয়ন পাউন্ডই গেছে ওই ‘পিক্সেল’-এর পেছনে।

সবচেয়ে বড় চমক হয়ে আবির্ভূত হলেন রানি দ্বিতীয় এলিজাবেথ। ব্রিটিশ সিনেমার অমর সৃষ্টি জেমস বন্ডের সঙ্গে অভিনয়ে অভিষেক হলো তাঁর। বড় পর্দায় দেখানো হলো, জেমস বন্ড চরিত্রের সর্বশেষ রূপকার ড্যানিয়েল ক্রেইগ বাকিংহাম প্রাসাদে রানির কক্ষে ঢুকছেন। তারপর অলিম্পিক উদ্বোধন করতে রানি তাঁর সঙ্গে উঠছেন হেলিকপ্টারে। স্টেডিয়ামের ওপর হেলিকপ্টারের আওয়াজ। অলিম্পিকে যোগ দিতে ব্যগ্র রানি বন্ডের আগেই প্যারাস্যুট নিয়ে ঝাঁপ দিলেন! রানি আর বন্ডের হয়ে ঝাঁপ দিয়েছেন আসলে অন্য দুজন। তবে ওই ঝাঁপ আর স্টেডিয়ামে রানির আবির্ভাবের টাইমিংটা হলো নিখুঁত। রানির পরনেও যে ওই একই পোশাক!

অলিম্পিক নিয়ে কিছু থাকল না যে তা নয়। মাঠের ওপর ভেসে আসা পাঁচটি বৃত্ত অলিম্পিক রিং বানিয়ে ধুইয়ে দিল আলোকের ঝরনাধারায়। অলিম্পিক মশালটা কে জ্বালাবেন, উদ্বোধনী অনুষ্ঠানের সবচেয়ে বড় ধাঁধা থাকে এটি। এখানে আরও বেশি ছিল। স্টেডিয়ামে মশালই যে খুঁজে পাওয়া যাচ্ছিল না!

সেই মশাল উঠল মাঠের মাঝখান থেকে। সেটিও চরম নাটকীয়ভাবে। নির্দিষ্ট কেউ মশাল জ্বালালেন না। জ্বালালেন অখ্যাত সাত তরুণ অ্যাথলেট। মার্চপাস্টের সময় ২০৪টি দেশের সঙ্গেই একটি করে তামার পাত ছিল। সেসব গোল করে সাজানো ছিল মাঠের মাঝখানে। ওই সাত তরুণ তাঁদের হাতের মশালটা ওই তামার পাতে ধরিয়ে দিতেই বহ্নিশিখা জ্বলতে জ্বলতে গোল হয়ে মিলে গেল। সেই আগুন বুকে করে আস্তে আস্তে দাঁড়িয়ে গেল মশাল।

স্বাগত লন্ডন ২০১২!

শেয়ার করুনঃ
আপনার মন্তব্য
আরও পড়ুন
×