অলিম্পিকে যাওয়ার আগে

২০০৪ অলিম্পিক

উৎপল শুভ্র

১৪ জুলাই ২০২১

অলিম্পিকে যাওয়ার আগে

জীবনের প্রথম অলিম্পিক যদি একজন অ্যাথলেটের কাছে রোমাঞ্চের নাম হয়ে থাকে, সাংবাদিকের কাছেও কি তা-ই নয়! তবে ২০০৪ সালে এথেন্সে জীবনের প্রথম অলিম্পিক কাভার করতে যাওয়ার আগে রোমাঞ্চের সঙ্গে আরেকটা অনুভূতিও কাজ করছিল মনে। বিশ্বের বৃহত্তম ক্রীড়াযজ্ঞ...পারব তো!

প্রথম প্রকাশ: ১২ আগস্ট ২০০৪। প্রথম আলো।

মরিস গ্রিনের বাহুতে একটি উল্কি আঁকা আছে। উল্কিটি একটি শব্দসংক্ষেপ। GOAT. পুরোটা হলো GREATEST OF ALL TIME. কেউ যদি বুঝতে না পারে, সেই সংশয় থেকেই কি না গ্রিন প্রায়ই ব্যাখ্যা করে বুঝিয়ে দেন, ‘আমি সর্বকালের সেরা স্প্রিন্টার। কী করিনি আমি? সর্বকালের সেরা হতে হলে আর কী করতে হবে?’

অলিম্পিকের আগেও এসব বলে যাচ্ছেন গ্রিন এবং তা বলে নিজের ওপর চাপটা আরও বাড়িয়ে ফেলছেন বলে অনেকের ধারণা।

যেকোনো খেলায়, যেকোনো প্রতিযোগিতাতেই ঘুরেফিরে আসে এই ‘চাপ’ শব্দটা। ইয়ান থর্পের ক্ষেত্রেও আসছে। অস্ট্রেলিয়ান অলিম্পিক ট্রায়ালে ব্যক্তিগত সম্পত্তি করে নেওয়া ৪০০ মিটার ফ্রিস্টাইল শুরু হওয়ার আগেই পুলে পড়ে গিয়ে ডিসকোয়ালিফায়েড হয়েছিলেন। যে ইভেন্টে তাঁর অলিম্পিক সোনা জয়টাকে নিছকই আনুষ্ঠানিকতা বলে ভাবা হয়, সেই ইভেন্ট থেকেই থর্প বাদ পড়ে যাওয়ায় অস্ট্রেলিয়া জুড়ে তুমুল হই-চই চলল কিছুদিন। শেষ পর্যন্ত বন্ধু ও সতীর্থ ক্রেইগ ইভান্স সরে দাঁড়ানোয় থর্প সুযোগ পাচ্ছেন ৪০০ মিটার ফ্রিস্টাইলে নামার। মাঝের ওই ঘটনা তাঁর ওপর চাপটা অনেক গুণ বাড়িয়ে দিয়েছে বলে সবাই একমত।

অলিম্পিক নিয়ে নানা লেখায় অ্যাথলেটদের ওপর যতবার এই চাপের প্রসঙ্গ পড়ছি, ততবারই মনে হচ্ছে, ‘এ আর এমন কী! গ্রিন আর থর্পের ওপর চাপ? আমার মতো চাপ তো আর ওদের ওপর নেই!’

কথাটা হাস্যকর মনে হতেই পারে। লেখার সময়ও সেই ঝুঁকির কথাটা মাথায় ছিল। তারপরও লিখে ফেললাম, কারণ সত্যিটা স্বীকার করে ফেলাই ভালো। এথেন্স অলিম্পিক কাভার করতে যাচ্ছি, সাংবাদিক জীবনের প্রথম অলিম্পিক। যাওয়ার দিনটা যতই এগিয়ে আসছে, ততই মনে হচ্ছে, এ তো জেনেশুনে আগুনে ঝাঁপ দেওয়া ছাড়া আর কিছুই নয়!

অলিম্পিক বিশ্বের বৃহত্তম ক্রীড়াযজ্ঞ। অনেক সাংবাদিকের মুখেই শুনেছি, অন্তত একটা অলিম্পিক কাভার করার অভিজ্ঞতা না থাকলে ক্রীড়া সাংবাদিকের জীবন কখনোই পরিপূর্ণ নয়। নিজেও এ কথায় বিশ্বাসী বলেই অতি আগ্রহে এথেন্সের টিকিট নিশ্চিত করেছিলাম। এখন মনে হচ্ছে কাজটা বোকামিই হয়ে গেল কি না। এত বড় ক্রীড়া আসর, এত খেলা, এত ইভেন্ট, এত তারকাকোনটা ছেড়ে কোনটা দেখব। শুধু দেখার ব্যাপার হলে তো ভালোই হতো। আসল সমস্যা কোনটা ছেড়ে কোনটা লিখব।

সমস্যা আছে আরেকটা। সেটি বোধ হয় শুধু বাংলাদেশের ক্রীড়া সাংবাদিকদেরই সমস্যা। এ দেশের পাঠকদের আগ্রহের তালিকায় অলিম্পিক খেলাগুলোর নাম অনেক নিচের দিকে। সেই আগ্রহের সঙ্গে তাল মেলাতে গিয়ে সারা বছর ফুটবল-ক্রিকেট নিয়ে মাতামাতির নিচে অ্যাথলেটিকস, সাঁতার বা অলিম্পিকের অন্য ইভেন্টগুলো এমনই চাপা পড়ে থাকে যে, এথেন্স রওনা হওয়ার আগে রীতিমতো ছাত্রজীবনে ফিরে যেতে হলো। দুটি অলিম্পিকের মাঝখানে চার বছরের বিরতি। সিডনি অলিম্পিকে ১০০ মিটার স্প্রিন্ট কে জিতেছিলেন, সেটিই তো চলে গেছে বিস্মৃতির অতলে। যে ১০০ মিটার স্প্রিন্ট সবার মনোযোগের কেন্দ্রবিন্দু হয়ে থাকে, সেটিরই যদি এই অবস্থা হয়, তাহলে বাকিগুলোর কথা তো অনুমান করতেই পারছেন! এথেন্স অলিম্পিক তাই বড় এক পরীক্ষা বলেই মনে হচ্ছে এখন।

ভয় আছে, টেনশন আছে, তবে সেগুলোই সব নয়। এ সবের উল্টো পিঠে আছে রোমাঞ্চ। মরিস গ্রিন, ইয়ান থর্প, গেইল ডেভার্সকে কাছ থেকে দেখার রোমাঞ্চ। ১৯৯৩ সালে ভারত-ইংল্যান্ড কলকাতা টেস্ট কাভার করার স্মৃতি মনে পড়ছে। ক্রিকেটের আন্তর্জাতিক তারকার এখন বাংলাদেশে এমন ডাল-ভাত হয়ে গেছে যে, এখন সেই স্মৃতি অনেকটা অবাস্তব বলেই মনে হয়। টেস্ট শুরুর আগের দিন সকাল ৯টায় ইডেন গার্ডেনে ঢুকলাম। সকালে এক দল প্র্যাকটিস করল, বিকেলে আরেক দল। ৯টা থেকে ৫টা পর্যন্ত সামান্য একটু হাঁটাহাঁটি বাদ দিলে আমি ঠায় দাঁড়িয়ে। ম্যাগাজিনের পাতা থেকে, টিভির পর্দা থেকে নেমে এসে গ্রাহাম গুচ, রবিন স্মিথ, শচীন টেন্ডুলকার, কপিল দেবরা সামনে জীবন্ত ঘুরে বেড়াচ্ছেন, সেই রোমাঞ্চের কাছে শারীরিক ক্লান্তি পাত্তাই পেল না। ঘোরের মধ্যে ছিলাম বলে এতটা সময় যে দাঁড়িয়ে, সেটিও বুঝতে পারিনি। রাতে বিছানায় যাওয়ার পর যখন পা ব্যথা শুরু হলো, বুঝতে পারলাম তখন।

এরপর আন্তর্জাতিক ক্রিকেট কাভার করতে করতে এক সময় আকাশের তারা বলে মনে হতো, অনেক দিনই তাঁরা নেমে এসেছেন আমাদের মতোই রক্ত-মাংসের মানুষের কাতারে। তবে গ্রিন-থর্পরা এখনো দূর আকাশের তারা হয়েই আছেন।

সেই তারাদের কাছ থেকে দেখার রোমাঞ্চটাই যা একটু ঢেকে রাখছে ভয়টাকে। তারপরও পাঠকদের আগেই জানিয়ে রাখি, অভিষেকে কোনো খেলোয়াড় যেমন একটু বিশেষ ছাড় পান, সেই ছাড় দিয়েই পড়তে হবে এথেন্স থেকে পাঠানো রিপোর্টগুলো। সাংবাদিক হিসেবে আমারও তো এটি অলিম্পিক-অভিষেক!

সম্পর্কিত বিষয়:

শেয়ার করুনঃ
আপনার মন্তব্য
আরও পড়ুন
×