অলিম্পিক ‘ঘরে’ ফিরছে আজ

২০০৪ অলিম্পিক

উৎপল শুভ্র

২০ জুলাই ২০২১

অলিম্পিক ‘ঘরে’ ফিরছে আজ

অলিম্পিককে মনে হচ্ছে সাংবাদিকদের স্বর্গ, তথ্য পাওয়ার এক অনিঃশেষ ভাণ্ডার। মাউসের এক টিপেই কম্পিউটার থেকে বেরিয়ে আসছে অলিম্পিকের সব বৃত্তান্ত। যা জানতে চান, তা তো অবশ্যই। যা জানতে চান না, তাও। কিন্তু উদ্বোধনী অনুষ্ঠান নিয়ে যেকোনো কৌতূহলের জবাবে শুধুই ভাসা ভাসা তথ্য আর ‘এই তো আর কয়েক ঘণ্টা, জানতেই পারবেন’ বলে আয়োজকদের রহস্যময় হাসি। এথেন্স অলিম্পিকের উদ্বোধনী অনুষ্ঠান ঘিরে ছিল এমনই গোপনীয়তা।

প্রথম প্রকাশ: ১৩ আগস্ট ২০০৪। প্রথম আলো

মাঠ আর মাঠ থাকবে না, তা রূপ নেবে সমুদ্রের। স্বর্গ থেকে নেমে আসবেন গ্রিক পুরাণের দেব-দেবীরা। আলোর ঝরনায় হেসে উঠবে চারপাশ, সঙ্গীতের মূর্ছনায় আন্দোলিত হবে সবাই। আসলে কি তা-ই হবে? কেউ জানে না!

এথেন্স অলিম্পিক কমিটির লোকজন অবশ্যই জানেন। যারা অংশ নেবেন, জানেন তারাও। কিন্তু ২৮তম অলিম্পিক গেমসের উদ্বোধনী অনুষ্ঠানকে ঘিরে এমনই গোপনীয়তার বর্ম যে, আজ রাতে এথেন্সের অলিম্পিক স্টেডিয়ামে কী দেখা যাবে, বাকিরা তা শুধু অনুমানই করতে পারেন। 

এমনিতে অলিম্পিককে মনে হচ্ছে সাংবাদিকদের স্বর্গ, তথ্য পাওয়ার এক অনিঃশেষ ভাণ্ডার। মাউসের এক টিপেই কম্পিউটার থেকে বেরিয়ে আসছে অলিম্পিকের সব বৃত্তান্ত। যা জানতে চান, তা তো অবশ্যই। যা জানতে চান না, তাও। অলিম্পিকের আদি বৃত্তান্ত থেকে শুরু করে সব খেলার ইতিহাস, এই অলিম্পিকের মূল স্পন্দন সাড়ে দশ হাজার অ্যাথলেটের খুঁটিনাটি, সর্বশেষ খবর, এমনকি একটু আগে শেষ হওয়া সংবাদ সম্মেলনেরও বিস্তারিত। কিন্তু উদ্বোধনী অনুষ্ঠান নিয়ে যেকোনো কৌতূহলের জবাবে শুধুই ভাসা ভাসা তথ্য আর ‘এই তো আর কয়েক ঘণ্টা, জানতেই পারবেন’ বলে আয়োজকদের রহস্যময় হাসি। 

দর্শকদের আরও একটু অপেক্ষা করতে হবে, তবে সাংবাদিকদের কৌতূহলের নিবৃত্তি হচ্ছেআজ দুপুরের মধ্যেই। উদ্বোধনী অনুষ্ঠানের ছয় ঘণ্টা আগেই বিস্তারিত জানিয়ে তার ব্যাখ্যা সংবলিত একটি বুকলেট দেওয়া হবে বলে জানিয়ে দেওয়া হলো কাল। রাত সাড়ে ৮টায় (বাংলাদেশ সময় রাত সাড়ে ১১টা) উদ্বোধনী অনুষ্ঠান শুরু আর তার স্থায়িত্ব সাড়ে তিন ঘণ্টা— এই তথ্যটা অবশ্য বেশ কিছুদিন আগেই সাধারণ্যে প্রচার হয়ে গেছে। মাঠ সমুদ্র হোক বা না হোক, স্বর্গ থেকে দেব-দেবীরা এই মর্ত্যধামে অবতরণ করুন না-করুন, একটা ব্যাপার নিয়ে কোনো সংশয় নেই। আজকের উদ্বোধনী অনুষ্ঠান ভালোমতোই বুঝিয়ে দেবে যে, এটি ‘গ্রিসের অলিম্পিক’। 

আয়োজক বলেই আলাদা করে বুঝিয়ে দেওয়ার ব্যাপারটি আসছে। নইলে অলিম্পিক তো আসলে সব সময়ই গ্রিসের। অলিম্পিকে কখনোই বড় কোনো পরাশক্তি নয় (সিডনি অলিম্পিকে গ্রিস জিতেছিল ৪টি সোনা), তবে গ্রিসের মাহাত্ম্য অন্যখানে। যিশুখ্রিষ্টের জন্মেরও ৭৭৬ বছর আগেই যে এমন একটা কিছুর কথা ভেবেছিল তারা, সেই গৌরবের তো আর কোনো অংশীদার নেই। এটি শুধুই গ্রিসের। প্রাচীন অলিম্পিকের জন্ম এখানে, আধুনিক অলিম্পিকের পথ-চলাও। ১০৮ বছর পর আবার এথেন্সে ফিরে আসছে অলিম্পিক। সেই অলিম্পিক কি?

গ্রিস মানে তো দেব-দেবীও। ২০০৪ অলিম্পিকের উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে তাই মর্ত্যে নামিয়ে আনা হয়েছিল তাঁদেরও। ছবি: গেটি ইমেজেস

এথেন্সের প্রথম অলিম্পিকে অংশ নিয়েছিল ১৪টি দেশ, ৪৩টি ইভেন্টে প্রতিযোগীর সংখ্যা ছিল ২৪১ এবং তাদের সবাই ছিল পুরুষ। সেই এথেন্সেই এবার অলিম্পিকের পতাকাতলে সারি বেঁধে দাঁড়াচ্ছে ২০২টি দেশ। খেলার আবরণে এটি তো আসলে বিশ্ব মানবের এক মিলনমেলা। 

বদলে যাওয়া পৃথিবী সেই মিলনমেলায় ছায়া ফেলছে, ফেলবেই। নিরাপত্তা নিয়ে এত কথা আর কোনো অলিম্পিকে হয়নি। অলিম্পিকের প্রাণ অ্যাথলেটিকসের ওপর ডোপিংয়ের কালো ছায়াটা এত বড় হয়ে ওঠেনি এর আগে কোনো দিন। কাল সকালে আইওসি প্রধান জ্যাক রগের সংবাদ সম্মেলন শেষে হিসেব করে দেখলাম, ডোপিং নিয়েই প্রশ্ন হলো সবচেয়ে বেশি। এবারই প্রথম প্রতিযোগিতা শুরুর আগেই অলিম্পিক ভিলেজে যেকোনো অ্যাথলেটকে পরীক্ষা করার রীতি চালু হয়েছে, ধরা পড়া বেশ কজন ‘ডোপপাপী’কে ফেরতও পাঠিয়ে দেওয়া হয়েছে দেশে।   

এ সবই আছে, থাকবেও। তবে সবকিছুর পরও সাম্যবাদের সবচেয়ে বড় বিজ্ঞাপন তো অলিম্পিকই। এই অলিম্পিকে ১৪ বছরের কিশোর ব্রায়ান নিকসন লোমাস (মালয়েশিয়ান ডাইভার) যেমন আছেন, তেমনি আছেন ছয় সন্তানের জননী ৪৭ বছর বয়সী অ্যানেট উডওয়ার্ডও (অস্ট্রেলিয়ান শ্যুটার)। দুবাই থেকে এথেন্সের বিমানে পাশে পেয়েছিলাম লেসেথোর এক ম্যারাথনারকে, ক্ষুন্নিবৃত্তিতে উদয়াস্ত পরিশ্রম করতে হয়, তার মধ্যে একমাত্র শখ অ্যাথলেটিকস। সেই ম্যারাথনার যে অলিম্পিক ভিলেজে থাকছেন, সেখানেই থাকছেন রজার ফেদেরারও, কোনো টুর্নামেন্টে শুধু অংশ নেওয়ার জন্যই যার ব্যাংক অ্যাকাউন্টে লাখ লাখ টাকা জমা পড়ে যায়। অলিম্পিক এভাবেই সবাইকে সমান করে।

প্রতিযোগিতা শুরু হওয়ার পর আলাদা করতেও শুরু করবে। কেউ সোনার পদক গলায় বিজয়মঞ্চে দাঁড়াবে। দূর থেকে সেই দৃশ্য দেখে শুধু অংশগ্রহণেই তৃপ্ত থাকতে হবে অনেককে এবং সেই দলে শুধু বাংলাদেশের অ্যাথলেটরাই থাকবে না। কারও স্বপ্ন পূরণ হবে, স্বপ্নভঙ্গ হবে কারও। কত আনন্দ-বেদনার কাব্য রচিত হবে আগামী কয়েক দিন। শুধু বিশ্বের বৃহত্তম ক্রীড়াযজ্ঞেরই সূচনা নয়, আজকের উদ্বোধনী অনুষ্ঠানের মাধ্যমে পর্দা উঠছে এক মানবীয় নাটকেরও। 
 

সম্পর্কিত বিষয়:

শেয়ার করুনঃ
আপনার মন্তব্য
আরও পড়ুন
×