অলিম্পিক এত বড়!

ফিরে দেখা ২০০৪ অলিম্পিক-১

উৎপল শুভ্র

২১ জুলাই ২০২১

অলিম্পিক এত বড়!

শুধু সাংবাদিক হিসেবে নয়, দর্শক হিসেবেও আমার প্রথম অলিম্পিক ২০০৪। সেই অলিম্পিক তার আয়োজনের বিশালত্বে প্রথম দিনই যে বিস্ময়ের ঘোর লাগিয়ে দিয়েছিল যে, সেই ঘোর আর কাটেনি। বরং প্রতিনিয়তই মনে হয়েছে, হাজার হাজার অ্যাথলেট, হাজার হাজার সাংবাদিক... অলিম্পিকে না গেলে নিজের ক্রীড়া-সাংবাদিক-জীবনই অপূর্ণ থেকে যেত।

প্রথম প্রকাশ: ৫ সেপ্টেম্বর ২০০৪। প্রথম আলো

এথেন্সে পা রাখার আগেই অলিম্পিকে সোনাজয়ী এক অ্যাথলেটের সঙ্গে পরিচয়! ‘সোনাজয়ী’ না লিখে অবশ্য ‘সোনা জয় করতে যাওয়া’ লেখা উচিত। শেখ আহমেদ বিন মোহাম্মদ বিন হাশর আল-মাখতুম যে এথেন্স অলিম্পিকে গিয়ে ইতিহাস গড়ে ফেলবেন, সেটি তো তখন তাঁর নিজেরই জানা ছিল না। আমি জানব কীভাবে?

১০ আগস্ট দুবাই থেকে এথেন্সগামী এমিরেটসের বিমানে বেশ কটি দেশের অলিম্পিক দল। এর মধ্যে আফ্রিকান দেশ লেসেথোর অ্যাথলেটিকস দলের কোচকে পেলাম পাশের আসনেই। লেসেথো দলের সঙ্গে ভালোই পরিচয় হয়ে গেল তাতে। সংযুক্ত আরব আমিরাতের দলটিও যে বিমানে আছে, সেটি তখন বুঝতে পারিনি। ওদের সঙ্গে পরিচয় এথেন্স বিমানবন্দরে নামার পর।

বিমানবন্দরে অলিম্পিক পরিবারের জন্য আলাদা ব্যবস্থা। প্রায় বিমানের দরজা থেকেই তীর চিহ্ন দিয়ে আলাদা পথনির্দেশ। কিন্তু আলাদা ব্যবস্থা হলেই বা কী, এথেন্স বিমানবন্দরে কিছুক্ষণের ব্যবধানে যে চার-পাঁচটি ফ্লাইট নেমেছে, তার নব্বই শতাংশ যাত্রীই তো অলিম্পিক পরিবারের সদস্য। অলিম্পিক পরিবারের জন্য নির্ধারিত জায়গাটুকু তাই দেখতে না দেখতেই জনারণ্য।

শেখ আহমেদ বিন মোহাম্মদ বিন হাশর আল-মাখতুম। নামটা যেমন বড়, কীর্তিটাও বড়। যদিও তা এসেছিল একটা চমক হয়েই। ছবি: আলকেট্রন

বিশ্বে এই একটিই ক্রীড়ানুষ্ঠান, সম্ভবত সবকিছু মিলিয়েই একমাত্র অনুষ্ঠান, যেটি যে দেশেই হোক না কেন, অ্যাক্রিডিটেশন পেলে আর ভিসার প্রয়োজন পড়ে না। অ্যাক্রিডিটেশন কার্ডটিই ভিসা। সেটি দেখে ইমিগ্রেশন অফিসার পাসপোর্টে শুধু একটি সিল মেরে দেবেন, আনুষ্ঠানিকতা বলতে এটুকুই। কিন্তু এটুকুর জন্যই লাইনে দাঁড়িয়ে প্রায় এক ঘণ্টার অপেক্ষা। তখনই আল-মাখতুমের সঙ্গে পরিচয়।

সংযুক্ত আরব আমিরাত দলের সদালাপী বাকি সদস্যদের তুলনায় একটু গম্ভীরই মনে হয়েছিল আল-মাখতুমকে। গম্ভীর নয়, আসলে কী মনে হয়েছিল সেটি বলেই ফেলি। মনে হয়েছিল অহংকারী। এতটাই যে, মনে মনে বলেওছিলাম, ‘যাচ্ছিস তো বাংলাদেশের অ্যাথলেটের মতো অংশ নেওয়ার জন্যই অংশ নিতে। অথচ ভাব দেখলে মনে হয়, অলিম্পিকে সোনা জিতে ফেলবি!’

ভাগ্যিস, মনে মনেই বলেছিলাম। বাংলাদেশের আসিফ আহমেদ খানের জন্যই একদিন যেতে হয়েছিল, মূল অলিম্পিক কমপ্লেক্স থেকে অনেক দূরের মার্কোপোলো শুটিং সেন্টারে যাওয়ার সময় হয়নি আর এক দিনও। আল-মাখতুমের সোনা জয়ের খবরটা পেলাম তাই একটু দেরিতে। ভারতের রাজ্যবর্ধন রাঠোর রুপা জিতেছেন বলেই শুটিংয়ের ডাবল ট্র্যাপ দেখতে বসেছিলাম টেলিভিশনের সামনে। তা দেখতে বসেই চমক। যে ডাবল ট্র্যাপে রাঠোরের রুপা, তাতে সোনাজয়ী লোকটাকে এত চেনা চেনা লাগছে কেন? হঠাৎই বিদ্যুৎচমকের মতো মনে হলো, আরে, এ তো সংযুক্ত আরব আমিরাতের ওই অহংকারী লোকটা! আমিরাতের শাসককুলের সঙ্গে আত্মীয়তাকেই ওই অহংকারের একমাত্র উৎস বলে মনে হয়েছিল এথেন্স বিমানবন্দরে। তখনই জানলাম, অহংকার করার মতো আরও অনেক কিছুই আছে আল-মাখতুমের।

এথেন্স অলিম্পিকের স্মৃতিকথা লিখতে বসে আল-মাখতুমকে নিয়েই এতখানি জায়গা শেষ করে ফেলাটা বাহুল্য মনে হয়ে থাকলে মার্জনা করবেন। প্রথম দেখায় যা মনে হয়, বেশির ভাগ সময়ই যে তার সঙ্গে আসল ব্যাপারের আকাশ-পাতাল পার্থক্য থাকে, আল-মাখতুম তারই এমন একটা শিক্ষা যে, অভিজ্ঞতাটা পাঠকদের সঙ্গে ভাগ করে নেওয়ার লোভটা সামলাতে পারলাম না।

অলিম্পিক গেমসের ক্ষেত্রে তা ঘটেনি। শুধু সাংবাদিক হিসেবে নয়, দর্শক হিসেবেও এটিই ছিল আমার প্রথম অলিম্পিক এবং সেই অলিম্পিক তার আয়োজনের বিশালত্বে প্রথম দিনই যে বিস্ময়ের ঘোর লাগিয়ে দিয়েছিল, সেই ঘোর আর কাটেনি। এর আগে কাভার করা বড় স্পোর্টস ইভেন্ট বলতে ক্রিকেটের তিনটি বিশ্বকাপ। ক্রিকেটের বিশ্বকাপের সঙ্গে অলিম্পিকের কোনো তুলনা চলে না জানতাম, কিন্তু সেই জানাটাও বিস্ময়ের তীব্রতাটাকে খুব একটা কমাতে পারেনি। অলিম্পিক বড় জানতাম, তাই বলে এতটা বড়!

হাজার হাজার অ্যাথলেট, হাজার হাজার সাংবাদিক... এ এমনই এক ক্রীড়াযজ্ঞ যে, যেটির অভিজ্ঞতা না হলে এই ক্রীড়া-সাংবাদিক-জীবন অপূর্ণই থেকে যেত। মিডিয়া ভিলেজ দিয়েই শুরু করি। প্রথম চমকটা তো সেখানেই। আইওস আন্দ্রিয়াস নামে যে মিডিয়া ভিলেজে অনেক আগে থেকেই রুম বুক করা ছিল, সেখানে পৌঁছানোর পর আনুষ্ঠানিকতা শেষে চাবি হাতে পেয়ে যখন রুমে যাব বলে উঠতে যাচ্ছি, রিসেপশনের হাস্যমুখ স্বেচ্ছাসেবক তরুণী বললেন, ‘প্লিজ একটু অপেক্ষা করুন। স্বেচ্ছাসেবকদের একজন আপনাকে গাড়ি করে পৌঁছে দেবে।’ এটুকু যেতে আবার গাড়ি! পরে বুঝলাম, এটুকু নয়। একতলা বিল্ডিংই বেশি, কিছু আছে দোতলা। আড়াই হাজার রুমের এই মিডিয়া ভিলেজ এমনই বিশাল এলাকা জুড়ে যে, ভেতরে যাতায়াতের জন্যই শাটল ট্রেনের ব্যবস্থা করতে হয়েছে।

সেই শাটল ট্রেন চলছে ২৪ ঘণ্টাই। সেই ট্রেনের নাম ‘ফান ট্রেন’, যেটি চলার জন্য রেললাইন লাগে না। লোহার চাকার বদলে টায়ার, সেই ট্রেন চলে রাস্তার ওপর দিয়েই। সেই ট্রেনে চড়ে যেতে হয় মিডিয়া ভিলেজের গেটে, সেখান থেকে বাসে এমপিসি। এমপিসি মানে মেইন প্রেস সেন্টার, অলিম্পিকে সাংবাদিকদের মুখে সবচেয়ে বেশিবার উচ্চারিত শব্দ।

পাশাপাশি দুটি বিশাল ভবন। এমপিসিতে সাড়ে পাঁচ হাজার সাংবাদিক আর ফটোগ্রাফারের কাজ করার ব্যবস্থা। আইবিসি, মানে ইন্টারন্যাশনাল ব্রডকাস্টিং সেন্টার ১৬ হাজার টেলিভিশন সাংবাদিক, ধারাভাষ্যকার আর কলাকুশলীদের কর্মস্থল। প্রথম দিন এমপিসিতে মেইন প্রেস ওয়ার্ক রুমে ঢুকেই তো আমি হতবাক। সারি সারি লম্বা ডেস্ক আর তাতে বসে লেখায় ব্যস্ত শয়ে শয়ে সাংবাদিক। সে এক দৃশ্য! আমার বিস্ময় দেখে কলকাতার এক সাংবাদিক-বন্ধু অবশ্য জানালেন, ‘এ আর এমন কি! সিডনিতে আরও বড় ছিল।’

তা থাকুক, আমি তো আর সিডনি অলিম্পিক দেখিনি। এথেন্সে যা দেখলাম, সেটিই আমাকে বিস্মিত করার জন্য যথেষ্ট। পরস্পর সংযুক্ত পাশাপাশি তিনটি ভবন নিয়ে ওই মেইন প্রেস সেন্টার। তা এমনই বিশাল যে, তাতে ১৮ দিন কাজ করার পর শেষ দিনেও পথ হারিয়ে ফেললাম।

শেয়ার করুনঃ
আপনার মন্তব্য
আরও পড়ুন
×