প্রতি ঘণ্টায় ৩০ হাজার ডিম!

২০০৪ অলিম্পিক

উৎপল শুভ্র

২১ জুলাই ২০২১

প্রতি ঘণ্টায় ৩০ হাজার ডিম!

মার্টিন নাভ্রাতিলোভা বলছেন, অলিম্পিকে না এলে তাঁর জীবনটা অপূর্ণ থেকে যেত। হাভিয়ের স্যাভিওলার চোখে অলিম্পিক এক অন্য জগৎ। নানা বর্ণের, নানা গোত্রের অলিম্পিক তো আসলে কল্পনার চেয়েও বড়!

প্রথম প্রকাশ: ১২ সেপ্টেম্বর ২০০৪। প্রথম আলো

অলিম্পিকের বিশালত্ব নিয়ে এর আগে একটা পর্ব লিখেছি। অলিম্পিক এমনই বিশাল যে, এক পর্বে সেই বিশালত্বের বর্ণনা শেষ হওয়ার কথা নয়। হয়ওনি। লেখাটা ছাপা হওয়ার পর দেখি, অলিম্পিকের বিশালত্ব বোঝাতে পারে, এমন একটা মজার পরিসংখ্যানই বাদ পড়ে গেছে।

যাঁদের নিয়ে অলিম্পিক, সেই অ্যাথলেটদের আবাসস্থল অলিম্পিক ভিলেজে অ্যাথলেট-কর্মকর্তা মিলিয়ে ছিলেন ১৬ হাজার লোক। তাঁদের দেখভাল করার লোক, আইওসির কর্মকর্তা মিলিয়ে সংখ্যাটা আরও বেড়েছে। তাঁদের রসনাতৃপ্তির জন্য অলিম্পিক ভিলেজে প্রতি ঘণ্টায় গড়ে ৬ হাজার ‘মিল’ তৈরি করতে হয়েছে ক্যাটারিং সার্ভিসের লোকজনকে। এ জন্য প্রতি ঘণ্টায় যা প্রয়োজন হয়েছে, তার একটা তালিকা দেওয়া হয়েছিল সাংবাদিকদের। তার কয়েকটি এ রকম :

 ১৫ হাজার লিটার দুধ
 ৩০ হাজার ডিম
 ৩০০ টন ফল ও তরিতরকারি
 ১২০ টন মাংস
 ৭৫০ লিটার টমেটো সস
 ২০ লাখ লিটার পানি

তালিকায় সামুদ্রিক মাছ, পাউরুটি, এমন আরও অনেক কিছুর হিসাব ছিল। সেসব আর লিখলাম না। যা বোঝানোর ইচ্ছে, তা তো এই তালিকা থেকেই পরিষ্কার।

তা অলিম্পিক ভিলেজে এত সব খেলার এত সব অ্যাথলেট যে একসঙ্গে মিলেমিশে থাকলেন, সেই অভিজ্ঞতাটা কেমন? আর্জেন্টাইন ফুটবলার হাভিয়ের স্যাভিওলার কাছে তা এক কথায় অসাধারণ, ‘এ এক অন্য জগৎ। এত দিন যেসব হকি খেলোয়াড়, ভলিবল খেলোয়াড়দের টিভিতে দেখেছি, তাঁদের চোখের সামনে ঘুরে বেড়াতে দেখার অভিজ্ঞতাটা এক কথায় দারুণ।’ স্যাভিওলাকে দেখেও নিশ্চয়ই অনেকের একই অনুভূতি হয়েছে।

ফুটবল-টেনিস অলিম্পিকে থাকলেও অলিম্পিকে আগে-পরে এই খেলাগুলোর একেবারের আলাদা জগৎ। বিশেষ করে টেনিস। ডেভিস কাপ ও ফেডারেশন কাপই টেনিস খেলোয়াড়দের দেশের হয়ে খেলার একমাত্র সুযোগ এবং সেটিকে সুযোগের পরিবর্তে ঝামেলাই মনে করেন বেশির ভাগ খেলোয়াড়। সারা জীবন শুধুই নিজেকে নিয়ে চিন্তা করতে করতে অনেকটাই আত্মকেন্দ্রিক হয়ে পড়া টেনিস খেলোয়াড়দের দেশের হয়ে খেলাটা আদৌ উদ্দীপ্ত করতে পারে কি না, তা নিয়ে সংশয় আছে অনেকেরই। এই যে রজার ফেদেরার, অ্যান্ডি রডিক, গুস্তাফো কুয়ের্তেন, মারাত সাফিনরা থাকার পরও এথেন্স অলিম্পিক টেনিসে পুরুষ এককের ফাইনাল খেললেন নিকোলাস মাসু ও মার্ডি ফিশ, অনেকের বিশ্বাস শুধু অলিম্পিক বলেই তা সম্ভব হয়েছে, কোনো গ্র্যান্ড স্লাম টুর্নামেন্টে এমন হবে না। লাখ লাখ টাকার প্রাইজমানি পেয়ে অভ্যস্ত টেনিস খেলোয়াড়দের জন্য শুধুই একটা পদক যথেষ্ট প্রেরণা নয় বলেই সাধারণ ধারণা। অলিম্পিকে সব খেলাতেই শুধু পদক, প্রাইজমানির কোনো প্রথা নেই। টেনিস-ফুটবলের সঙ্গে অন্য খেলাগুলোর পার্থক্য হলো, সেগুলোতে অলিম্পিকই সবচেয়ে বড় মঞ্চ, এখানে সোনা জয়ের অর্থই পেছনে স্পনসরদের লাইন লেগে যাওয়া। টেনিসে তা নয়। সোনার পদক এখানে শুধুই সম্মান, আর কিছুই নয়। 

পাখির চোখে এথেন্স অলিম্পিকের মূল ভেন্যুগুলো। ছবি: উইকিপিডিয়া

তবে ‘হোটেলে ওঠো, টুর্নামেন্ট খেলো, আবার সুটকেস গুছিয়ে অন্য শহরে যাও’-এই চক্র থেকে অলিম্পিকই তাঁদের মুক্তি দেয় বলে অনেক টেনিস খেলোয়াড় তা উপভোগও করেন। মার্টিনা নাভ্রাতিলোভা তো এথেন্স অলিম্পিককে তাঁর জীবনের ‘সবচেয়ে অবিস্মরণীয় অভিজ্ঞতার’ মর্যাদাই দিয়ে দিলেন। টেনিসের ‘জীবন্ত কিংবদন্তি’র এটিই ছিল প্রথম অলিম্পিক এবং তিনি জানাচ্ছেন, ‘অলিম্পিকে না এলে আমার জীবনটা অপূর্ণ থেকে যেত।’ মূলত অলিম্পিক ভিলেজের জীবনের কারণেই তাঁর এই উপলব্ধি, ‘কত বর্ণ, কত শারীরিক গড়নের এত সব অ্যাথলেটকে একসঙ্গে দেখে বিস্ময়ই লাগে।’ 

শুধু অ্যাথলেট-কর্মকর্তাই নয়, অলিম্পিক ভিলেজ এবার মহামান্য এক অতিথিকেও পেয়েছিল। এর আগে ইন্টারন্যাশনাল অলিম্পিক কমিটির (আইওসি) সভাপতি অলিম্পিকের সময় পাঁচতারা হোটেলেই থেকেছেন সব সময়। এবারই সেই নিয়মের ব্যতিক্রম ঘটিয়ে জ্যাক রগে থাকলেন অলিম্পিক ভিলেজে। সেখানে প্রথম রাত কাটানোর পর সাংবাদিকদের জানালেন সেই অভিজ্ঞতার কথাও, ‘আহ্, নীরবতা! কোনো কোলাহল নেই, হই চই নেই, শুধু হিরণ্ময় নীরবতা। দারুণ ঘুম হয়েছে আমার।’ 

অলিম্পিক ভিলেজের অভিজ্ঞতা জানাতে গিয়ে নানা বর্ণ, নানা শারীরিক আকারের কথা বলেছেন মার্টিনা নাভ্রাতিলোভা। অলিম্পিকের সাংবাদিকদের মূল ঘাঁটি মেইন প্রেস সেন্টারের (এমপিসি) বর্ণনাতেও তা ব্যবহার করা যায়। কত বর্ণ, কত আকারের সঙ্গে শুধু যোগ করতে হবে ‘কত ভাষা’। বিশাল হলরুমের এক প্রান্ত থেকে অন্য প্রান্ত পর্যন্ত বিস্তৃত সারি সারি ল্যাপটপ। সেই ল্যাপটপগুলোর মনিটরে কত বিচিত্র আঁকিবুঁকি। অপরিচিত ভাষা তো আঁকিবুঁকি বলেই মনে হয়। 

অলিম্পিকে ২৪ ঘণ্টা খেলা হয় না, কিন্তু এমপিসি ২৪ ঘণ্টাই সরগরম। এই বিশ্বে যত টাইম জোন আছে, সব জোনের সাংবাদিকই আছেন অলিম্পিকে। সব সময়ই কেউ না কেউ কাজে ব্যস্ত, সব সময়ই কাউকে না কাউকে দেখা যায় পত্রিকার ডেডলাইন মিস হয়ে যাওয়ার দুশ্চিন্তায় কাতর। 

অলিম্পিকে এত খেলা, সব খেলা সব দেশে জনপ্রিয় নয়। বাংলাদেশের কোনো সাংবাদিকের কাছে এটি একটু বিস্ময়করই যে, জাপানি পত্রিকাগুলোতে ‘জুডো করেসপন্ডেন্ট’ আছে, ‘ফেন্সিং করেসপন্ডেন্ট’ আছে ফ্রান্সের অনেক পত্রিকায়। রুমানিয়ার এক সাংবাদিকের সঙ্গে পরিচয় হলো, যিনি শুধু রোয়িং নিয়ে লেখেন। এ নিয়ে এমপিসিতে অনেক মজার অভিজ্ঞতাও হয়েছে। যেমন একদিন অস্ট্রেলিয়ার এক সাংবাদিক পরিচিত হওয়ার কিছুক্ষণের মধ্যেই একটু আগে কাভার করে আসা সেইলিংয়ের একটি ইভেন্ট নিয়ে তুমুল উচ্ছ্বাস প্রকাশ করে ঘোষণা করলেন, এটি না দেখায় আমার অলিম্পিকে আসাটা পরিপূর্ণ হলো না। আরেক দিন এক সুইডিশ সাংবাদিক ইকুয়েস্ট্রিয়ান কাভার করে এসেও একই রকম উচ্ছ্বসিত। তাদের উচ্ছ্বাসে মাথা দুলিয়েছি, বেশির ভাগই না বুঝে। সেইলিং সাগরে পাল তোলা নৌকাবাইচ জাতীয় একটা খেলা আর ইকুয়েস্ট্রেরিয়ান ঘোড়ার পিঠে চড়ে খেলতে হয়-- এর চেয়ে বেশি কিছু জানলে তো! বাংলাদেশে এগুলো হয় নাকি!

হুয়ান লরিসিও মরিসের সঙ্গেও মেইন প্রেস সেন্টারেই পরিচয়। বয়স ৬৬, খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে হাঁটেন, কাজ করেন আর্জেন্টিনার একটি সংবাদপত্রে। স্প্যানিশের বাইরে পর্তুগিজ ভাষাটা মোটামুটি জানেন, কিন্তু ইংরেজিতে কিছু বোঝাতে বা বুঝতে কঠিন সংগ্রামের মধ্য দিয়ে যেতে হয় তাকে। সেই ভদ্রলোক যখন জানলেন, বাংলাদেশে আর্জেন্টিনা ফুটবল দলের অনেক সমর্থক এবং ম্যারাডোনা বলতে অনেকে পাগল বিস্ময়ে তার ইংরেজি আরও দুর্বোধ্য হয়ে গেল। বারবার একটা কথাই বলতে লাগলেন। অনেক কষ্টে বুঝতে পারলাম, আমার নাম এবং কোন পত্রিকায় কাজ করি তা লিখে দিতে বলছেন। বাংলাদেশে আর্জেন্টিনা ও ম্যারাডোনার জনপ্রিয়তা নিয়ে লিখবেন তাঁর কাগজে।

এথেন্স অলিম্পিকের ইনডোর হল। ছবি: গেটি ইমেজেস

প্যাট্রিসিও কামিন্সও আর্জেন্টাইন। তবে ২৫ বছর বয়সী এই যুবক আর্জেন্টিনিয়ানদের মধ্যে ব্যতিক্রম। ইতালির বিপক্ষে আর্জেন্টিনার সেমিফাইনাল ম্যাচ দেখতে গিয়ে বাসে তাঁর সঙ্গে পরিচয়। পরিচয় হওয়ার পরই যখন জিজ্ঞেস করলেন, ‘বাংলাদেশের ক্রিকেট দলের খবর কী’, আমার তো রীতিমতো ভিরমি খাওয়ার দশা। একজন আর্জেন্টিনিয়ানের মুখে ক্রিকেটের কথা! রহস্যটা পরিষ্কার হলো কিছুক্ষণের মধ্যেই, যখন জানলাম নিউজিল্যান্ড টেলিভিশনে চাকরি নিয়ে প্যাট্রিসিও কামিন্স তিন বছর ধরে অকল্যান্ডে আছেন। সেখানেই তাঁর ক্রিকেটের সঙ্গে পরিচয়। ১৯৯৭ আইসিসি ট্রফিতে বাংলাদেশ আর্জেন্টিনার সঙ্গে খেলেছিল জেনে তিনি মহা বিস্মিত, ‘আর্জেন্টিনার জাতীয় ক্রিকেট দল আছে! আমার তো এটি জানা ছিল না।’

ব্রাজিল আর আর্জেন্টিনার সমর্থকদের মধ্যে বাংলাদেশে যেমন সাপে-নেউলে সম্পর্ক, প্যাট্রিসিও কামিন্সের কথা মানলে ব্রাজিলিয়ান আর আর্জেন্টাইনদের মধ্যে সম্পর্কটা মোটেই সে রকম নয়, ‘ব্রাজিলিয়ানদের সঙ্গে আমাদের কোনো সমস্যা নেই। আমার অনেক ব্রাজিলিয়ান বন্ধু আছে। বরং চিলিয়ানদের সঙ্গেই আমাদের রেষারেষিটা বেশি। প্রতিবেশী দেশের মধ্যে যেমন হয় আর কি!’

ম্যারাডোনা প্রসঙ্গ ওঠার পর অবশ্য বোঝা গেল, সামনে একজন ব্রাজিলিয়ান থাকলে কামিন্সের সঙ্গে তাঁর সম্পর্কটা আর মধুর থাকত না। কোকেন আসক্তির প্রভাবে ম্যারাডোনা মানসিক ভারসাম্য হারিয়ে ফেলেছেন, শিক্ষার অভাবই দায়ী তাঁর এই পরিণতির জন্য... নিজে থেকেই বললেন এসব। তবে এর পরই যোগ করে দিলেন, ‘তারপরও আর্জেন্টিনার মানুষ ম্যারাডোনাকে ভালোবাসে। বিশ্ব মানচিত্রে আর্জেন্টিনাকে তুলে দিয়েছেন তিনি। ব্রাজিলিয়ানরা পেলের কথা বলবে, কিন্তু আমার কাছে ম্যারাডোনাই সর্বকালের সেরা।’ 

এ কথা বলার পর জানতে চাইলেন, ‘আপনি কী বলেন?’

আমি কিছুই না বলে শুধু হাসলাম। প্যাট্রিসিও কামিন্সের সিদ্ধান্তে যুক্তি তো আছেই, তবে তার সঙ্গে আবেগও এমনভাবে মিশে যে, এ নিয়ে আলোচনা করে কোনো লাভ নেই।

আরও পড়ুন:
অলিম্পিক এত বড়!

শেয়ার করুনঃ
আপনার মন্তব্য
আরও পড়ুন
×