দৌড়ানোর জন্যই যাঁদের জন্ম

ফিরে দেখা ২০০৪ অলিম্পিক-১

উৎপল শুভ্র

২১ জুলাই ২০২১

দৌড়ানোর জন্যই যাঁদের জন্ম

মরিস গ্রিন। ছবি: গেটি ইমেজেস

শুধু অ্যাথলেটিকসের নয়, পুরো অলিম্পিকেরই শো পিস ইভেন্ট ১০০ মিটার স্প্রিন্ট। এটি আগেই জানা ছিল, তবে ১০ সেকেন্ডেরও কম সময়ের একটি ইভেন্ট যে পুরো স্টেডিয়ামে আবেগ-উত্তেজনার এমন ঢেউ বইয়ে দিতে পারে, তা কল্পনায়ও ছিল না। এত দিন পর যখন এথেন্স অলিম্পিকের দিকে ফিরে তাকাই, সব কিছু ছাপিয়ে প্রথমেই মনে পড়ে ২৩ আগস্টের রাত। পুরুষদের ১০০ মিটার স্প্রিন্টের আগের ও পরের সময়টা। অনেকের চোখেই যা সর্বকালের সেরা ১০০ মিটারের স্বীকৃতি পেয়ে গিয়েছিল।

প্রথম প্রকাশ: ১৯ সেপ্টেম্বর ২০০৪। প্রথম আলো

প্রতিদিন ভোরে আফ্রিকায় একটা হরিণের ঘুম ভাঙে। সে জানে দ্রুততম সিংহের চেয়েও জোরে দৌড়াতে হবে তাকে, নইলে মরতে হবে। প্রতিদিন ভোরে একটি সিংহ ওঠে, সে জানে সবচেয়ে দুর্বল হরিণের চেয়ে দ্রুত দৌড়াতে হবে তাঁকে, নইলে অনাহারে মরতে হবে। আপনি হরিণ না সিংহ, তাতে কিছু আসে যায় না। কথা একটাই, সূর্য উঠলে দৌড়াতে হবে।

এটা যদি কারো খেলোয়াড়ি-দর্শন হয়, তার সর্বকালের সেরা স্প্রিন্টার হওয়ারই কথা। মরিস গ্রিন তা হয়েছেনও। এথেন্স অলিম্পিকে তার গলায় যে ব্রোঞ্জের পদক ঝুলল, তারপরও তার বাহুতে আঁকা উল্কিটা (জিওএটি-‘গোট’ নয়, গ্রেটেস্ট অব অল টাইম-এর শব্দ সংক্ষেপ) মুছে ফেলার কথা ভাবতে হচ্ছে না মরিস গ্রিনকে। কেউ মুছে ফেলতে বলছেও না। 

১০০ মিটারের পর সংবাদ সম্মেলনে ব্রোঞ্জজয়ী স্প্রিন্টারের ছায়াতেই যেন ঢাকা পড়ে থাকলেন সোনা আর রুপাজয়ী জাস্টিন গ্যাটলিন ও ফ্রান্সিস ওবিকওয়েলু। এক আমেরিকান সাংবাদিক সরাসরি জিজ্ঞেস করলেন, ‘মরিস, এখনো কি আপনি নিজেকে সর্বকালের সেরা মনে করেন? করলে কেন?’ মরিস গ্রিন একটু হাসলেন। ‘ইয়েস, আই অ্যাম’— এটা প্রশ্নের প্রথম অংশের উত্তর। দ্বিতীয় অংশের উত্তর, ‘পরিসংখ্যান দেখুন। আজ আমি ৫৪তম বারের মতো ১০ সেকেন্ডের কমে দৌড়ালাম। এর কাছাকাছিও কি কেউ আছে?’

নেই। নেই বলেই তাঁর এই গৌরবের মুহূর্তে আরেকজন নিজেকে সেরা বলে দাবি করছেন দেখেও আপত্তি করলেন না গ্যাটলিন। বরং এমনভাবে মাথা ঝোঁকালেন, যার অর্থ, ‘ঠিকই তো! এ নিয়ে প্রশ্ন ওঠাই তো অন্যায়।’

শুধু অ্যাথলেটিকসের নয়, পুরো অলিম্পিকেরই শো পিস ইভেন্ট ১০০ মিটার স্প্রিন্ট। এটি আগেই জানা ছিল, তবে ১০ সেকেন্ডেরও কম সময়ের একটি ইভেন্ট যে পুরো স্টেডিয়ামে আবেগ-উত্তেজনার এমন ঢেউ বইয়ে দিতে পারে, তা কল্পনায়ও ছিল না। এত দিন পর যখন এথেন্স অলিম্পিকের দিকে ফিরে তাকাই, সব কিছু ছাপিয়ে প্রথমেই মনে পড়ে ২৩ আগস্টের রাত। পুরুষদের ১০০ মিটার স্প্রিন্টের আগের ও পরের সময়টা।

কানে বাজে ওই মিউজিকটাও। অন্য সব ইভেন্ট শেষ করে কানায় কানায় ভরা অলিম্পিক স্টেডিয়াম যখন ১০ সেকেন্ডের নাটকীয়তার অপেক্ষায়, তখনই বাজতে শুরু করল অদ্ভুত ওই গ্রিক মিউজিক। বড় কিছু হতে যাচ্ছে, সে জন্য অধীর প্রতীক্ষায় সবাই— মিউজিকের প্রতিটি টোনে ব্যাপারটি এমনই মূর্ত যে, মনে হলো ১০০ মিটার স্প্রিন্টের কথা ভেবেই কম্পোজ করা হয়েছে তা!

সেই ১০০ মিটারে প্রতিযোগীরা এমন গায়ে গায়ে লেগে দৌড় শেষ করলেন যে, বোকা ক্যামেরা প্রথমে ধরেছিল শন ক্রফোর্ডকে। খুব ‘বোকা’ও বলা যাচ্ছে না, কারণ চতুর্থ হলেও প্রথমের সঙ্গে ক্রফোর্ডের ব্যবধান তো এক সেকেন্ডের একশ ভাগের চার ভাগ! অলিম্পিক ইতিহাসে ক্রফোর্ডের আগে ৯.৮৯ সেকেন্ডে ১০০ মিটার শেষ করে কেউ পদকবঞ্চিত থাকেননি। সেকেন্ডের একশ ভাগের এক ভাগের সোনা-রুপা-ব্রোঞ্জের মধ্যে ব্যবধান হয়ে থাকার ঘটনাও এথেন্সেই প্রথম দেখল অলিম্পিক। 

‘অলিম্পিকের ইতিহাসে সর্বকালের সেরা ১০০ মিটার’— এ নিয়ে কোনো তর্কই ছিল না। মরিস গ্রিন নিজেও দিয়ে দিলেন এই স্বীকৃতি। সাংবাদিকরা তাতেই সন্তুষ্ট না থেকে অলিম্পিকের সীমানা ছাড়িয়ে সব প্রতিযোগিতা মিলিয়েই এটি সর্বকালের সেরা ১০০ মিটার কি না, সেই প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে ব্যস্ত হয়ে পড়লেন।

এথেন্স অলিম্পিকের দ্রুততম তিন মানব, (বাঁ থেকে) ফ্রান্সিস, জাস্টিন গ্যাটলিন, মরিস গ্রিন। ছবি: গেটি ইমেজেস

মরিস গ্রিনের কোচ জন ওয়াল্টন স্মিথকে বর্তমান অ্যাথলেটিকসের সবচেয়ে নামী কোচ বলে মানা হয়। সেই জন স্মিথ জানালেন, ‘না, এমন ১০০ মিটার এর আগে আর হয়নি।’ পরের প্রশ্ন, ‘টোকিওকে মনে রেখেও?’ স্মিথের উত্তর, ‘হ্যাঁ, টোকিওকেও ছাড়িয়ে গেছে এটি।' টোকিও মানে ’৯১ সালে সেখানে অনুষ্ঠিত বিশ্ব অ্যাথলেটিকস, এথেন্স অলিম্পিকের আগে সেটিকেই সর্বকালের সেরা ১০০ মিটার বলে মেনে এসেছেন সবাই। 

টোকিওতে ৯.৮৬ সেকেন্ডের বিশ্ব রেকর্ড গড়ে সোনা জিতেছিলেন কার্ল লুইস। ১০ সেকেন্ডের কমে দৌড় শেষ করেছিলেন তাঁর পেছনে থাকা আরও পাঁচজন (লেরয় বুরেল ৯.৮৮, ডেনিস মিচেল ৯.৯১, লিনফোর্ড ক্রিস্টি ৯.৯২, ফ্রাংকি ফ্রেডেরিকস ৯.৯৫, রে স্টুয়ার্ট ৯.৯৬)। ৯.৯২ সেকেন্ডে দৌড় শেষ করে ইউরোপিয়ান রেকর্ড থেকে দশমিক শূন্য ৫ সেকেন্ড ছেঁটে দেওয়ার পরও পদক বঞ্চিত থাকার হতাশায় লিনফোর্ড ক্রিস্টি অবসরই নিয়ে ফেলতে চেয়েছিলেন। কারণ? ঘনিষ্ঠ মহলে সেটিও বলেছিলেন ক্রিস্টি, ‘৯.৯২ সেকেন্ডেও যদি পদক না পাই, তাহলে আর দৌড়ে লাভ কী? এই বয়সে আমি তো আর এর চেয়ে কমে দৌড়াতে পারব না।’ শেষ পর্যন্ত অবসর নেননি, না নিয়ে ভালোই করেছিলেন, নইলে পরের বছর বার্সেলোনা অলিম্পিকে সবচেয়ে বেশি বয়সে ১০০ মিটার স্প্রিন্ট জেতার রেকর্ডটা আর গড়তে পারতেন না ক্রিস্টি।

টোকিওর পাশে এথেন্সকে রাখুন। জাস্টিন গ্যাটলিন ৯.৮৫, ফ্রান্সিস ওবিকওয়েলু ৯.৮৬, মরিস গ্রিন ৯.৮৭, শন ক্রফোর্ড ৯.৮৯, আসাফা পাওয়েল ৯.৯৪, কিম কলিন্স ১০.০, ওবাডেলে টমসন ১০.১। ফাইনালের আরেকজন আজিজ জাকারি আহত হয়ে দৌড় শেষ করতে পারেননি।

মাঝে মধ্যে দু-একবার ব্যতিক্রম হয়েছে, তবে তা নিয়মকে প্রমাণ করতেই। নইলে ১০০ মিটার স্প্রিন্ট যুক্তরাষ্ট্রেরই ইভেন্ট। তবে পালাবদলের একটা ইঙ্গিত বোধহয় দিয়ে গেল এথেন্স অলিম্পিক। এথেন্সে পুরুষদের ১০০ মিটার ফাইনালে আটজনের তিনজন আমেরিকান, ক্যারিবিয়ানও তিন জন। মার্কিন স্প্রিন্টারদের জন্য এখন বড় চ্যালেঞ্জ হয়ে উঠছেন ক্যারিবিয়ানরা। তাদের নিয়েও একটা লেখা লিখতে হবে দেখছি।

সম্পর্কিত বিষয়:

শেয়ার করুনঃ
আপনার মন্তব্য
আরও পড়ুন
×