কান্নায় শেষ হলো মারিয়ন জোন্সের অলিম্পিক

২০০৪ অলিম্পিক

উৎপল শুভ্র

২১ জুলাই ২০২১

কান্নায় শেষ হলো মারিয়ন জোন্সের অলিম্পিক

২০০৪ অলিম্পিক থেকে যখন বেরিয়ে যাচ্ছেন, মারিয়ন জোন্সের দু'চোখে শ্রাবণের ধারাপাত। সেই কান্নায় অন্য কোনো আবেগ নেই। তা নির্ভেজাল ব্যর্থতার কান্না, হতাশার কান্না। চার বছর আগে যে অলিম্পিক তাঁর দু'হাত ভরিয়ে দিয়েছিল, সেই অলিম্পিকই এবার শূন্য হাতে বিদায় দিল তাঁকে। সেটিও কী নিষ্ঠুরভাবে!

প্রথম প্রকাশ: ২৯ আগস্ট ২০০৪। প্রথম আলো

চার বছর পর বেইজিংয়ে থাকবেন কি না, তিনি জানেন না। হয়তো জানেন, কিন্তু সত্যিটা স্বীকার করতে চাইছে না তাঁর মন। ৩৩ ছুঁই ছুঁই বয়স হবে তখন, অ্যাথলেটদের মৃত্যুঘণ্টা বেজে যায় এর আগেই। সবাই তো আর মারলিন ওটি নন। ধরে নেওয়াই ভালো, এই এথেন্সেই মারিয়ন জোন্সকে বিদায় জানিয়ে ফেলল অলিম্পিক। কে জানত, বিদায় সংবর্ধনাটা এমন হবে!

গত পরশু রাতে সম্ভবত শেষবারের মতো যখন অলিম্পিক থেকে বেরিয়ে যাচ্ছেন, মারিয়ন জোন্সের দু'চোখে শ্রাবণের ধারাপাত। সেই কান্নায় অন্য কোনো আবেগ নেই। তা নির্ভেজাল ব্যর্থতার কান্না, হতাশার কান্না। চার বছর আগে যে অলিম্পিক তাঁর দু'হাত ভরিয়ে দিয়েছিল, সেই অলিম্পিকই এবার শূন্য হাতে বিদায় দিল তাঁকে। সেটিও কী নিষ্ঠুরভাবে!

অনেক বছর পর হয়তো এথেন্স-দুঃস্বপ্নের চেয়ে সিডনিতে জেতা ৩টি সোনাই বেশি উজ্জ্বল হয়ে থাকবে তাঁর স্মৃতিতে। তবে সেটি অনেক দিন পর। এই মুহূর্তে এবং আরও অনেক অনেক দিন মারিয়ন জোন্সের চোখে ভাসতে থাকবে একটাই দৃশ্য— তাঁর বাড়িয়ে দেওয়া ব্যাটন লরি উইলিয়ামসের হাত খুঁজে পাচ্ছে না!

দু-একটা ব্যতিক্রম বাদ দিলে ৪০০ মিটার রিলে যুক্তরাষ্ট্রেরই ইভেন্ট। গত পরশুও তা-ই হতে যাচ্ছিল। শুরুতেই অ্যাঞ্জেলা উইলিয়ামস ছিটকে বেরিয়ে গিয়ে বাকিদের সঙ্গে যে ব্যবধান গড়ে দিয়েছিলেন, তাঁর কাছ থেকে ব্যাটন পাওয়ার পর তা কমতে দেননি মারিয়ন জোন্সও। দুঃস্বপ্ন তাঁর ভয়ালতম রূপ নিয়ে দেখা দিল এরপরই। তৃতীয় লেগ দৌড়ানোর কথা লরি উইলিয়ামসের, কিন্তু মারিয়ন জোন্সের বাড়িয়ে দেওয়া ব্যাটন তাঁর হাতই খুঁজে পাচ্ছিল না। তিনবারের চেষ্টা ব্যর্থ হওয়ার পর শেষ পর্যন্ত উইলিয়ামস যখন ব্যাটনটা হাতে নিতে পারলেন, ততক্ষণে সব শেষ। বাকিরা এতটাই এগিয়ে গেছে যে, উইলিয়ামস আর ‘অ্যাঙ্কর’ কলান্ডার আর দৌড়ানোর কোনো যুক্তি খুঁজে পেলেন না। রেজাল্ট শিটে যুক্তরাষ্ট্রের পাশে লেখা হলো : ডিএনএফ, ডিড নট ফিনিশ!

ইউএসএ: ডিড নট ফিনিশ। ছবি: গেটি ইমেজেস

রিলের বাকি তিনজন তাঁর চেয়ে অনেক নবীন। নিজের হতাশা ভুলে মারিয়ন জোন্স তাই চেষ্টা করলেন তাঁদের সান্ত্বনা দিতে। উইলিয়ামস আর কলান্ডারকে জড়িয়ে ধরে এগিয়ে গেলেন ট্র্যাকের অন্য প্রান্ত থেকে হরর ছবির দৃশ্য দেখতে থাকা অ্যাঞ্জেলা উইলিয়ামসের দিকে। অনেক দিন প্রশ্নাতীতভাবে বিশ্বের দ্রুততম মানবীর ওটুকু পথ পেরোতেই যেন বছর লেগে গেল। হয়তো তিন সতীর্থের কথা ভেবেই মাঠে সামলে রেখেছিলেন নিজেকে। মিক্সড জোনে সাংবাদিকদের সামনে এসে আর পারলেন না। মারিয়ন জোন্সের দু'চোখে তখন অঝোর জলের ধারা। 

বললেন, এমন কিছু যে হতে পারে, এটা তাঁর কল্পনাতেও ছিল না। লরি উইলিয়ামসের হাত খুঁজে না পাওয়ার সময়টায় কত কী বলে চিৎকার করেছেন সব তাঁর মনে নেই।

১০০ মিটারে রুপাজয়ী উইলিয়ামস স্বীকার করলেন ভুলটা হয়েছে তাঁরই, ‘আমি একটু আগেই দৌড় শুরু করে দিয়েছিলাম।’ কিন্তু কার ভুল, তাতে আর কী আসে যায়? চোখ মুছতে মুছতে মারিয়ন জোন্স যে বললেন, ‘এই অলিম্পিকটা খুব বাজে একটা অভিজ্ঞতা হয়ে থাকল’— সেই সত্যের তো আর কোনো পরিবর্তন হচ্ছে না। বেইজিংয়ে যদি না-ই থাকেন, মারিয়ন জোন্সের অলিম্পিক থাকবে দুটিই— সিডনি আর এথেন্স। সেই দুটি অলিম্পিকে কী অবিশ্বাস্য বৈপরীত্য!

সিডনি অলিম্পিকে স্পটলাইটের পুরোটাই ছিল তাঁর ওপর। থাকবে না-ই বা কেন? ’৯৮ সালে মার্কিন জাতীয় চ্যাম্পিয়নশিপে ১০০ ও ২০০ মিটারের ‘ডাবল’-এর সঙ্গে জিতেছিলেন লং জাম্পও। মার্কিন অ্যাথলেটিকসে এর আগের অর্ধশতাব্দীতে আর কোনো প্রমীলা অ্যাথলেটের এই কীর্তি নেই। ’৯৭ থেকে ২০০০ পর্যন্ত টানা চার বছর ছিলেন ১০০ ও ২০০ মিটারে র‍্যাঙ্কিংয়ের শীর্ষে। ’৯৮ থেকে ২০০০ পর্যন্ত টানা ৩৪টি ১০০ মিটার জিতেছেন। ১৯৩৬ অলিম্পিক যেমন জেসি ওয়েন্সের, ১৯৮৪ কার্ল লুইসের, তেমনি ২০০০ সালের অলিম্পিক মারিয়ন জোন্সেরই হওয়ার কথা ছিল। হয়েও ছিল। প্রথম অ্যাথলেট হিসেবে এক অলিম্পিকে ৫টি সোনা জয়ের ‘অসম্ভব’ এক স্বপ্ন দেখছিলেন, লং জাম্প আর ৪ গুণিতক ১০০ মিটার রিলেতে ব্রোঞ্জ পেয়ে যাওয়ায় সেই স্বপ্ন পূরণ হয়নি। কিন্তু যা  হয়েছিল, সেটিও তো ইতিহাস। ১০০ ও ২০০ মিটার এবং ৪ গুণন ৪০০ মিটার রিলেতে সোনা জিতেছিলেন, সঙ্গে ওই দুটো ব্রোঞ্জ। এক অলিম্পিকে ট্র্যাক অ্যান্ড ফিল্ডের আর কোনো মেয়ের ৫টি পদক জয়ের ঘটনা নেই। 

মাঝের চার বছর এমন টালমাটাল সময় যে, সিডনির সেই তারকা এথেন্সে এলেন নিভুনিভু হয়ে। এই চার বছরে শটপুটার স্বামী সিজে হান্টারের সঙ্গে বিচ্ছেদ হয়েছে, সন্তান জন্ম দেওয়ার জন্য প্রতিযোগিতার বাইরে থাকতে হয়েছে এক বছর, সেই সন্তানের বাবা টিম মন্টগোমারি ডোপিং-কলঙ্কিত, এই কলঙ্ক লেগেছে তাঁর নিজের গায়েও। গত অলিম্পিকের উজ্জ্বলতম তারকা এথেন্সেও যে আছেন, সেটিই যেন কারোর মনে থাকছিল না। 

১০০ ও ২০০ মিটারে মার্কিন ট্রায়াল উতরাতে পারেননি। ছিলেন শুধু লং জাম্প আর ৪ গুণন ১০০ মিটার রিলেতেই। সেই দুটো ইভেন্টের ফাইনালের মধ্যে এক ঘণ্টার ব্যবধানও নেই। গত পরশু রাতে লং জাম্পে পঞ্চম হওয়ার পর মন খারাপ করারও সময় পাননি। কিছুক্ষণের মধ্যেই এসে দাঁড়াতে হয়েছে রিলেতে। সেই রিলেতে ফেবারিট ছিল মারিয়ন জোন্সের দলই। সোনার পদক গলায় বিজয়মঞ্চে দাঁড়ানোটা অভ্যাস হয়ে গিয়েছিল এক সময়, আরেকবার তা দাঁড়াতে পারবেন বলেই স্বপ্ন দেখছিলেন মারিয়ন জোন্স।

কে জানত, তাঁর জন্য শুধু কান্নাই বরাদ্দ রেখেছিল এথেন্স অলিম্পিক! 

সম্পর্কিত বিষয়:

শেয়ার করুনঃ
আপনার মন্তব্য
আরও পড়ুন
×