পিস্টোরিয়াসের জীবন কত সহজ!

২০১২ লন্ডন অলিম্পিক

উৎপল শুভ্র

২১ জুলাই ২০২১

পিস্টোরিয়াসের জীবন কত সহজ!

বান্ধবীকে হত্যার দায়ে অস্কার পিস্টোরিয়াস নামটা এখন আর ভক্তিভরে স্মরণ করেন না কেউ। তবে এই নামটাই তো একটা সময় উচ্চারিত হতো লাখো মানুষের অনুপ্রেরণা হিসেবে। জন্মেছিলেন হাঁটুর নিচ থেকে অ্যাঙ্কেল পর্যন্ত বিস্তৃত 'ফিবুলা' হাড়টা ছাড়াই। দুটি পা-ই কেটে ফেলতে হয়। কৃত্রিম পায়েই হেঁটে (নাকি দৌড়ে) এসেছিলেন এতটা পথ। কতটা পথ? অলিম্পিক পর্যন্ত পৌঁছাতে যতটা পথ হয়!

প্রথম প্রকাশ: ২ আগস্ট ২০১২। প্রথম আলো

যাঁরা তাঁকে প্রথম দেখছেন, সবার দৃষ্টি তাঁর পায়ের দিকে। দেখে কিছু বোঝার উপায় নেই। সুস্থ-স্বাভাবিক আর দশজন মানুষের মতোই হেঁটে এলেন সংবাদ সম্মেলনে। পরনে ট্র্যাকসুট, পায়ে জুতা। কে বলবে, জন্মের কিছুদিন পরই এই লোকটার দুটি পা-ই হাঁটুর নিচ থেকে কেটে ফেলা হয়েছে!

‘ব্লেড রানার’ নামে অ্যাথলেটিকস বিশ্ব চেনে তাঁকে। সীমানাটা শুধু অ্যাথলেটিকসে আটকে রাখলে ভুল হবে। অন্য অ্যাথলেটদের লড়াই শুধু প্রতিদ্বন্দ্বীদের সঙ্গে। অস্কার পিস্টোরিয়াসকে সেই লড়াইয়ে নাম লেখাতেই জিততে হয়েছে আরও অনেক লড়াই। এই অলিম্পিকে কোনো পদক না পেলেও কিছু আসে-যায় না। লন্ডন অলিম্পিকে অংশ নেওয়া নিশ্চিত হওয়ার দিন থেকেই তো তাঁর গলায় অদৃশ্য একটা পদক ঝুলছে। 

প্যারালিম্পিক তো শারীরিক প্রতিবন্ধীদের জন্যই। সেটির বড় তারকা আগে থেকেই। অংশ নেবেন এই অলিম্পিক শেষ হওয়ার পরপরই শুরু হতে যাওয়া এবারের প্যারালিম্পিকেও। কিন্তু পিস্টোরিয়াসের স্বপ্নের আকাশ যে অনেক বড়! সেই স্বপ্নই তাঁকে নিয়ে এসেছে অলিম্পিকে। কারও দয়ায় নয়, কোয়ালিফাই করেই এসেছেন। ইতিহাস হয়ে গেছে তাতেই—অলিম্পিকে এই প্রথম পা-হীন কোনো অ্যাথলেট! 

জন্মেছিলেন হাঁটুর নিচ থেকে অ্যাঙ্কেল পর্যন্ত বিস্তৃত ‘ফিবুলা’ হাড়টা ছাড়াই। দুটি পা-ই কেটে ফেলতে হয়। কৃত্রিম পায়েই হেঁটে (নাকি দৌড়ে) এসেছেন এতটা পথ। পা কৃত্রিম, কিন্তু বেড়ে উঠেছেন স্বাভাবিকভাবেই। ‘হয়তো খেলতে যাব, মা আমার ভাইকে বলতেন তুমি জুতা পরো, অস্কার তুমি প্রসথেটিক পা’—ছেলেবেলার স্মৃতিচারণা করলেন পিস্টোরিয়াস। স্কুলে যত খেলা হতো, সবই খেলতেন। কিন্তু নিয়তি যে তাঁর একের পর এক পরীক্ষা নেবে বলেই ঠিক করে রেখেছে। ২০০৩ সালে স্কুলের পক্ষে রাগবি খেলতে গিয়ে হাঁটু প্রায় গুঁড়িয়ে যায়। জীবনের সবকিছুই এমন সহজভাবে নিতে শিখেছেন যে সেই দুর্ঘটনার বর্ণনা দেওয়ার সময়ও পিস্টোরিয়াসের মুখে হাসি।

২০০৪ সালের জানুয়ারিতে এক শিক্ষকের পীড়াপীড়িতে প্রথম প্রতিযোগিতামূলক ১০০ মিটার স্প্রিন্ট। প্রিটোরিয়া বয়েজ হাইস্কুলের পক্ষে সেই স্প্রিন্টে ১১.৭২ সেকেন্ড টাইমিং করার পর পিস্টোরিয়াসের বাবা আবিষ্কার করেন, তাঁর ১৭ বছর বয়সী ছেলে প্যারালিম্পিকে ১০০ মিটার জয়ীর চেয়েও দশমিক ৪৮ সেকেন্ড সময় কম নিয়েছে। এটিই পিস্টোরিয়াসের মনে বুনে দিল অ্যাথলেটিকস-স্বপ্নের বীজ। এথেন্সে প্যারালিম্পিকে ২০০ মিটার স্প্রিন্টে সোনা জিতলেন বিশ্ব রেকর্ড গড়ে। ১০০ মিটারে ব্রোঞ্জ। পরের বছর স্বাভাবিক পায়ের সঙ্গে প্রথম প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নামা। দক্ষিণ আফ্রিকান চ্যাম্পিয়নশিপে ৪০০ মিটারে ষষ্ঠ। 

দৌড়াচ্ছেন পিস্টোরিয়াস, পা ছাড়াই! ছবি: গেটি ইমেজেস

লড়াই করেই এত দূর এসেছেন। সংবাদ সম্মেলন শেষে সাংবাদিকেরা হাততালি দিয়ে সেই লড়াইকে সম্মানও জানালেন। কিন্তু এর আগে অপ্রিয় কিছু প্রশ্নও হলো। বছর পাঁচেক ধরেই বিতর্ক চলছে, কৃত্রিম পায়ে দৌড়ে পিস্টোরিয়াস বাড়তি কোনো সুবিধা পান কি না। ২০০৭ সালে আন্তর্জাতিক অ্যাথলেটিকস ফেডারেশন নিষিদ্ধও করেছিল তাঁকে। আইনি লড়াই লড়ে, বিখ্যাত সব বিজ্ঞানীর পরীক্ষার গিনিপিগ হয়ে ফিরে পান নিজের অধিকার। 

তার পরও প্রশ্ন ওঠে এবং জবাব দিতে গিয়ে বিষণ্নতার ছায়া পড়ে পিস্টোরিয়াসের মুখে, ‘সবাই শুধু প্রসথেটিক পায়ের সুবিধার কথা বলে, অসুবিধার কথাটা কেউ বলে না। আমি যে প্রসথেটিক লেগ ব্যবহার করছি, ১৯৯৬ সাল থেকে প্যারালিম্পিকে অসংখ্য অ্যাথলেট তা ব্যবহার করছে। কেউ কি আমার মতো দৌড়াতে পেরেছে?’ প্রসথেটিক পা দিন-দিন উন্নত হবে ধরে নিয়ে যাঁরা আপত্তি করছেন, তাঁদের উদ্দেশে পিস্টোরিয়াস একরকম মিনতিই করলেন, ‘২০০৪ সাল থেকে আমি একই জিনিস ব্যবহার করে যাচ্ছি। আইএএএফ আমাকে আবার দৌড়ানোর অনুমতি দিয়েছে সেই শর্তেই।’ রানিং শ্যুর যে দিন-দিন উন্নতি হচ্ছে, অনুযোগের সুরে না হলেও সবাইকে তা ঠিকই মনে করিয়ে দিলেন।

কৃত্রিম পা নিয়ে আলোচনায় লোকে রানিং ট্র্যাকে তাঁর ঘণ্টার পর ঘণ্টা ঘাম ঝরানোটা ভুলে যায়, এ নিয়ে দুঃখও আছে। টাইমিংয়ের চেয়ে লোকে তাঁর কৃত্রিম পা নিয়েই বেশি কথা বলে। এটা কি তাঁর ভালো লাগে? কথাবার্তায় খুব সপ্রতিভ পিস্টোরিয়াস সাংবাদিকদের কোর্টেই বল ঠেলে দিলেন, ‘এটা তো আপনাদের ওপর।’ ব্লেড রানার নামটা? পিস্টোরিয়াস হাসেন, ‘এটাও তো আপনারাই দিয়েছেন।’

অলিম্পিকে আসার স্বপ্নপূরণ হয়েছে। এখন লক্ষ্য, ৪০০ মিটারের সেমিফাইনালে ওঠা। রিলেতেও দৌড়াবেন। লন্ডন ছাড়িয়ে এখনই স্বপ্ন বিস্তৃত রিও ডি জেনিরো পর্যন্ত, ‘অ্যাথলেটদের সেরা সময় ২৭ থেকে ২৯। তখন আমার ২৯ হবে।’

শেয়ার করুনঃ
আপনার মন্তব্য
আরও পড়ুন
×