বয়সকে জয় করা তাঁরা দুজন

২০১৬ রিও অলিম্পিক

উৎপল শুভ্র

২০ জুলাই ২০২১

বয়সকে জয় করা তাঁরা দুজন

ভেরোনিকা ক্যাম্পবেল-ব্রাউন। ৩৪ বছরেও নেমে এসেছিলেন অ্যাথলেটিকস ট্র‍্যাকে। ছবি: গেটি ইমেজেস

উসাইন বোল্ট দৌড় ছেড়েছেন বয়স ৩০ পেরোতে না পেরোতেই। অ্যাথলেটিকসের দুনিয়ায় এটাই অবশ্য অবসর নেওয়ার স্বাভাবিক বয়স। `ব্যতিক্রম` হতে চাওয়া অ্যাথলেটদের জন্য তাই বোল্ট উদাহরণ হতে পারবেন না, সে জন্যে তাকাতে হবে কিম কলিন্স আর ভেরোনিকা ক্যাম্পবেল-ব্রাউনের দিকে। রিও অলিম্পিকে দুজন অংশগ্রহণ করেছিলেন ৪০ আর ৩৪ বছর বয়সে!

প্রথম প্রকাশ: ১৭ আগস্ট ২০১৬। প্রথম আলো

কিম কলিন্স বলে দিয়েছেন, এটাই তাঁর শেষ অলিম্পিক। কোনো চ্যাম্পিয়নশিপেও আর তাঁকে দেখা যাবে না। এ বছরই বিদায় জানাবেন ট্র্যাককে।

ভেরোনিকা ক্যাম্পবেল-ব্রাউন বলছেন, এখানেই শেষ নয়। চার বছর পর টোকিও অলিম্পিকেও থাকবেন। রিওর দুঃখ ঘুচিয়ে তারপরই বিদায়।

দুজনের মধ্যে অনেক মিল। দুজনই ক্যারিবিয়ান। কিম কলিন্স সেন্ট কিটস ও নেভিসের। ভেরোনিকা ক্যাম্পবেল-ব্রাউন জ্যামাইকার। দুজনের কোচ একই সঙ্গে তাঁদের জীবনসঙ্গীও। ভেরোনিকা ক্যাম্পবেলের নামের শেষে ব্রাউনটা যোগ হয়েছে বিয়ের পর। স্বামী ওমর ব্রাউনও ছিলেন স্প্রিন্টার। ২০০৬ কমনওয়েলথ গেমসে ২০০ মিটারে সোনাও জিতেছেন। কিম কলিন্সের স্ত্রী পলা ফিটনেস ট্রেনার ও কোচ। কিম কলিন্সের এই অলিম্পিকেও আসতে পারায় পলার বড় অবদান। কারণ, কলিন্সের বয়স এখন ৪০।

ক্যাম্পবেল-ব্রাউন এর চেয়ে ছয় বছর কম। দুজনের সবচেয়ে বড় মিল বয়সকে বুড়ো আঙুল দেখানোয়। জ্যামাইকান মেয়েদের স্প্রিন্ট-বিপ্লব ক্যাম্পবেল-ব্রাউন শুরু করেননি। সেই কৃতিত্ব মারলিন ওটির। তবে অলিম্পিক স্প্রিন্টে সোনা যে এখন জ্যামাইকারই সম্পত্তি হয়ে গেছে, সেই রাজত্বের গোড়াপত্তন ক্যাম্পবেল-ব্রাউনের হাতেই। ২০০৪ এথেন্স অলিম্পিকে ২০০ মিটারে সোনা জিতেছিলেন। ছেলে-মেয়ে মিলিয়েই স্প্রিন্টে যা জ্যামাইকার প্রথম অলিম্পিক সোনা। সেটি ধরে রাখেন চার বছর পর বেইজিংয়েও। সেই ২০০ মিটারেই কি না এবার হিটেই বাদ ভেরোনিকা ক্যাম্পবেল-ব্রাউন!

কাল সকালে নিজের হিটে তৃতীয় হয়েছেন। এর চেয়েও অদ্ভুত ঘটনা ঘটেছে ওই হিটে। এত বছরের অভিজ্ঞ ক্যাম্পবেল-ভেরোনিকা কিনা বাঁক নেওয়ার সময় নিজের ৬ নম্বর লেন থেকে ভুল করে ৭ নম্বর লেনে! ৬ নম্বর লেনের প্রতিদ্বন্দ্বীর তাতে সমস্যা হয়নি বলে ডিসকোয়ালিফায়েড হননি। কিন্তু ঠিকই বাদ পড়েছেন টাইমিংয়ের কারণে।

কিম কলিন্স। ছবি: গেটি ইমেজেস

আগের পাঁচটি অলিম্পিকে ৩টি সোনা জিতেছেন, সঙ্গে ২টি রুপা ও ২টি ব্রোঞ্জও। ১০০ মিটার রিলেটা এখনো আছে। এই অলিম্পিক থেকেও হয়তো শূন্য হাতে ফিরতে হবে না। কিন্তু প্রিয় ইভেন্টে এমন ব্যর্থতার দুঃখ তাতে যাওয়ার নয়। দৌড় শেষে ক্যাম্পবেল-ব্রাউন মিক্সড জোনে বললেন, ‘এটা সহ্য করা কঠিন। জীবনে কখনো এমন হয়নি।’ বলেই অবশ্য নিজেকে সান্ত্বনা দিলেন, ‘এর চেয়ে খারাপ কিছুও আমি দেখেছি। আমি আবার ফিরে আসব।’

৩৪ বছর বয়সেও ভেরোনিকা ক্যাম্পবেল-ব্রাউন দৌড়াচ্ছেন, ৩৮-এও দৌড়াতে চান—এতে খুব একটা বিস্মিত হওয়া যাচ্ছে না ওই মারলিন ওটির কারণেই। ৫২ বছর বয়সেও ইউরোপিয়ান চ্যাম্পিয়নশিপে দৌড়েছেন। অংশ নিয়েছেন ৭টি অলিম্পিকে। এর রহস্য জানতে চাইলে ওটি একটাই উত্তর দিয়ে এসেছেন, ‘মৃত্যুর পর গবেষণা করার জন্য আমার শরীরটা দিয়ে যাব।’

৪০ বছর বয়সে অলিম্পিকে দৌড়ানোর রহস্য সম্পর্কে কলিন্সের উত্তরটা আরও মজার, ‘গোপন এই কথাটা আমি বলব কেন? বিক্রি করব।’ ১০০ মিটার স্প্রিন্টের ফাইনালে যেতে পারেননি। তবে সেমিফাইনাল পর্যন্ত উঠেছিলেন। শরীর নাকি বিদ্রোহ করতে শুরু করেছে। ট্র্যাককে বিদায় জানাচ্ছেন এ কারণেই।

যা জানার পর সেন্ট কিটস ও নেভিসে নেমে এসেছে বিষাদ। ছোট্ট সেন্ট কিটস ও আরও ছোট নেভিস—এই দুটি দ্বীপ নিয়ে ক্যারিবিয়ান দ্বীপপুঞ্জের ওই দেশ। কিম কলিন্স যে দেশের জাতীয় বীর। তাঁর নামে স্টেডিয়াম হয়েছে, নামকরণ হয়েছে একটা হাইওয়ের। জ্যামাইকাতে বোল্টের নামেও এমন হয়েছে। তবে একটা জায়গায় বোল্টকেও হারিয়ে দিচ্ছেন কলিন্স! জ্যামাইকায় ‘বোল্ট দিবস’ বলে কিছু নেই। সেন্ট কিটস ও নেভিসে বছরের একটি দিন ‘কিম কলিন্স দিবস’ হিসেবে ঘোষিত। সেটি ২৫ আগস্ট। ২০০৩ সালের এই দিনেই বিশ্ব চ্যাম্পিয়নশিপে ১০০ মিটার জিতেছিলেন কলিন্স।

প্রথম অলিম্পিক সেই ১৯৯৬ সালে আটলান্টায়। এটি তাই কলিন্সের ষষ্ঠ অলিম্পিক হওয়ার কথা ছিল। হয়নি ২০১২ অলিম্পিকে বড় এক বিতর্কের কারণে। অলিম্পিক ভিলেজ ছেড়ে স্ত্রী-সন্তানদের সঙ্গে হোটেলে রাত কাটিয়েছিলেন। যে ‘অপরাধে’ সেন্ট কিটস ও নেভিস অলিম্পিক অ্যাসোসিয়েশন তাঁর অ্যাক্রিডিটেশন কার্ড ফিরিয়ে নেয়, পাঠিয়ে দেয় দেশেও। ক্ষুব্ধ কলিন্স আর কোনো দিন সেন্ট কিটস ও নেভিসের হয়ে না দৌড়ানোর ঘোষণা দেন। অলিম্পিকের টানেই পরে যে সিদ্ধান্ত বদলান।

রিওতেই শেষ কলিন্সের। ছবি: গেটি ইমেজেস

গত মে মাসে জার্মানির এক মিটে নিজের সেরা সময় ৯.৯৩ সেকেন্ডে ১০০ মিটার দৌড়ে ইতিহাসে নাম তুলেছেন। ৪০ পেরোনো কোনো স্প্রিন্টারের ১০ সেকেন্ডের ব্যারিয়ার ভাঙার প্রথম ঘটনা এটি। বয়সের ব্যাপারটাকে পাত্তা না দিয়ে কলিন্স তখন বলেছিলেন, ‘বয়স ৪০, এতে কিছু যায় আসে না। আমি তো ২১ বছর বয়সের চেয়েও ভালো বোধ করছি। তবে চল্লিশে এসে নিজের সেরা করাটা আমার কাছেও একটু বিস্ময়ের।’

হিটে বাদ পড়ার পর ভেরোনিকা-ক্যাম্পবেল যে এর চেয়েও ‘খারাপ কিছু দেখার’ কথা বলেছেন, সেটি নিশ্চয়ই ডোপিং-বিতর্কে প্রায় এক বছর ট্র্যাকের বাইরে থাকার সময়টা। ২০১৩ সালে জ্যামাইকান এক মিটের সময় নিষিদ্ধ যে ড্রাগ ধরা পড়ে তাঁর শরীরে, সেটি পারফরম্যান্স-বর্ধক নয়। তবে সেটি পারফরম্যান্স-বর্ধক অন্য ড্রাগকে আড়াল করে রাখার কাজ করে। ভেরোনিকা-ক্যাম্পবেল যেটিকে অনিচ্ছাকৃত বলে দাবি করেন। জ্যামাইকান অ্যাথলেটিক সংস্থা তা মেনেও নেয়। তবে ওই সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে আইএএফ আন্তর্জাতিক আদালতে যায়। যেখানে ভেরোনিকা-ক্যাম্পবেলই জেতেন। একসময় অংশ নেওয়ার আশা ছেড়ে দেওয়া রিও অলিম্পিক নিয়ে স্বপ্ন দেখার শুরুও তখনই।

ভেঙে যাওয়া সেই স্বপ্ন নিয়ে বিদায় বলতে চান না। থাকতে চান টোকিওতে তাঁর ষষ্ঠ অলিম্পিকেও। কে জানে, আরও চার বছর পরের অলিম্পিকেও কি না! ভেরোনিকা-ক্যাম্পবেল যে বড় হয়েছেন মারলিন ওটিকে আদর্শ মেনে!

শেয়ার করুনঃ
আপনার মন্তব্য
আরও পড়ুন
×