‘অসম্ভব’ শব্দটাই নেই ফেলপসের অভিধানে

উৎপল শুভ্র

২৭ জানুয়ারি ২০২১

‘অসম্ভব’ শব্দটাই নেই ফেলপসের অভিধানে

১৯৭২ মিউনিখ অলিম্পিকে মার্ক স্পিৎজের ৭টি সোনা জয়ের রেকর্ডটিকে এত দিন সাঁতার-বিশ্ব শুধু নতমস্তকে শ্রদ্ধাই জানিয়ে এসেছে, সেটিকে ছাড়িয়ে যাওয়ার কথা কারো কল্পনাতেও আসেনি। ক্রিকেটে স্যার ডন ব্র্যাডম্যানের ৯৯.৯৪ ব্যাটিং-গড়ের মতোই অস্পর্শনীয় একটি উচ্চতায় অধিষ্ঠিত স্পিৎজের এক অলিম্পিকে ৭টি সোনা জয়ের রেকর্ড শুধু স্পর্শই নয়, তা ছাড়িয়ে যাওয়ার প্রতিজ্ঞা নিয়েই এথেন্সে এসেছিলেন মাইকেল ফেলপস।

প্রথম প্রকাশ: ১২ আগস্ট ২০০৪। প্রথম আলো।

তিন বছর আগে জাপানে বিশ্ব চ্যাম্পিয়নশিপে ২০০ মিটার বাটারফ্লাইয়ে বিশ্ব রেকর্ড গড়ার কিছুক্ষণ পর তখন ১৬ ছুঁই ছুঁই মাইকেল ফেলপস তাঁর কোচের কাছে জানতে চেয়েছিলেন, 'সাংবাদিকরা সবাই মার্ক স্পিৎজের কথা জিজ্ঞেস করছে কেন? স্পিৎজ কী করেছিলেন?’

মার্ক স্পিৎজ কী করেছিলেন, এখন তা খুব ভালোভাবেই জানেন মাইকেল ফেলপস। না জানলে আর তাঁকে ছাড়িয়ে যাওয়ার স্বপ্ন দেখেন কীভাবে? ১৯৭২ মিউনিখ অলিম্পিকে মার্ক স্পিৎজের ৭টি সোনা জয়ের রেকর্ডটিকে এত দিন সাঁতার-বিশ্ব শুধু নতমস্তকে শ্রদ্ধাই জানিয়ে এসেছে, সেটিকে ছাড়িয়ে যাওয়ার কথা কারো কল্পনাতেও আসেনি। ক্রিকেটে স্যার ডন ব্র্যাডম্যানের ৯৯.৯৪ ব্যাটিং-গড়ের মতোই অস্পর্শনীয় একটি উচ্চতায় এত দিন অধিষ্ঠিত হয়ে ছিল স্পিৎজের এক অলিম্পিকে ৭টি সোনা জয়ের রেকর্ড। শুধু স্পর্শই নয়, সেটি ছাড়িয়ে যাওয়ার প্রতিজ্ঞা নিয়েই এথেন্সে এসেছেন মাইকেল ফেলপস। 

গত পরশু সংবাদ সম্মেলনে ফেলপসের সঙ্গে তার প্রতিদ্বন্দ্বিতা নিয়ে কথা বলতে হলো ইয়ান থর্পকে। কাল সংবাদ সম্মেলনে এলেন মাইকেল ফেলপস। পুরো মার্কিন সাঁতার দলেরই সংবাদ সম্মেলন, কিন্তু ফেলপসের ছায়াতে বাকি সবাই এমন ঢাকা পড়ে রইলেন যে, তাঁরা না এলেই পারতেন!

৩টি রিলে আছে, তবে থর্পের সঙ্গে শুধু ২০০ মিটার ফ্রি স্টাইলেই মুখোমুখি হচ্ছেন ফেলপস। থর্পের সঙ্গে প্রতিদ্বন্দ্বিতার বিষয়টি তাই সংবাদ সম্মেলনে মোটেই মুখ্য হয়ে উঠল না, সেখানে ঘুরে-ফিরে বারবার এলেন মার্ক স্পিৎজ। স্পিৎজের রেকর্ড ছুঁতে পারবেন আপনি? পেরিয়ে যেতে পারবেন স্পিৎজকে? ১৯ বছর বয়সী এক তরুণের জন্য বেমানান পরিণতিবোধ ফেলপসের উত্তরে, ‘৭টা-৮টা পরের কথা, আগে তো ১টা সোনা জিতি। অলিম্পিকে তো সোনাই জিতিনি কখনো, শূন্য হাতেই ফিরেছিলাম সিডনি থেকে। এবার তাই প্রথম সোনাটি জয়ের অপেক্ষায় আছি, তারপর দেখা যাক কী হয়।’

সিডনিতে ২০০ মিটার বাটারফ্লাইয়ে পঞ্চম হয়েছিলেন। ফেলপস তো তখনো ফেলপস হননি। ২০০১ সালে জাপানের ফুকুওয়ায় নতুন বিশ্ব রেকর্ড গড়ে ২০০ মিটার বাটারফ্লাই জয়ের মাধ্যমে ঘোষিত হলো তার আগমনবার্তা। দু বছর পর বার্সেলোনায় পরবর্তী আসরে ৪টি সোনা জয়ের পথে ৫ বার বিশ্ব রেকর্ড ভেঙে সবাইকে বুঝিয়ে দিলেন, সুইমিংপুলের রাজা হিসেবে কোনো কিছু না ভেবেই ইয়ান থর্পের নামটি উচ্চারণ করার দিন শেষ। কোনো দিন কেউ স্পিৎজের রেকর্ড ভাঙলে সেটি ভাঙবেন থর্পই— এই বিশ্বাসের গোড়া ধরেও নাড়া দিয়েছেন ফেলপস। স্পিৎজের রেকর্ড তাড়া করাটাকে দুঃসাহস ভেবে সেই চেষ্টাই করতে রাজি হননি থর্প। আর ফেলপস স্পিৎজের রেকর্ড ছোঁয়াটাকেই যথেষ্ট মনে না করে নামছেন তাঁকে ছাড়িয়ে যাওয়ার ‘মিশন ইমপসিবল’-এ।

২০০ মিটার ফ্রি স্টাইল, ১০০ ও ২০০ মিটার বাটারফ্লাই, ২০০ ও ৪০০ মিটার ব্যক্তিগত মিডলে ফেলপসের একার লড়াই। দলের হয়ে আছে ৪০০ ও ৮০০ মিটার ফ্রি স্টাইল এবং ৪০০ মিটার মিডলে রিলে। মার্কিন ট্রায়াল তাঁকে আরেকটি ইভেন্টে অংশ নেওয়ার সুযোগ দিয়েছিল। ৮টি সোনা জিতলেই স্পিৎজকে ছাড়িয়ে যাওয়া যাবে ভেবে নবম ইভেন্টটি বাদ দিয়েছেন। ৮টি সোনা জয়কে ‘মিশন ইমপসিবল’ বলেও মানছেন না তিনি, ‘কোনো কিছুকেই অসম্ভব বলতে রাজি নই আমি। ১৯৮০ সালে কেউ ভাবতেও পারেনি যে, রাশিয়ানদের আইস হকিতে হারানো সম্ভব। কিন্তু আমেরিকানরাই তা করেছে। অসম্ভব বলে আসলে কিছু নেই।’ অসম্ভবকে সম্ভবে পরিণত করার মিশনে এত সাবধানী যে, আগামীকাল উদ্বোধনী অনুষ্ঠানেও অংশ নেবেন না ফেলপস। ‘পরদিনই আমার সাঁতার আছে। সিডনিতেও আমি উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে যাইনি।’ সিডনি অলিম্পিকের সময় তাঁর বয়স ১৫। প্রস্তুতিতে সমস্যা হবে ভেবে ১৫ বছর বয়সী এক কিশোর যে জীবনের প্রথম অলিম্পিকের উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে যায়নি, বাকি বিশ্বের সেটি খেয়াল করার কথা নয়, করেওনি। যারা করেছে, তাদের কাছে আজকের মাইকেল ফেলপস নিশ্চয়ই কোনো বিস্ময় নন। 

আত্মবিশ্বাস আছে, আকাশ ছোঁয়ার ইচ্ছেয় লাফ দেওয়ার সাহস আছে, আছে পরিণতি বোধ— তাই বলে বয়সটার কোনো চিহ্নই থাকবে না, তা হয় নাকি? অলিম্পিক ইতিহাসে নতুন এক অধ্যায় যোগ করার লক্ষ্য নিয়ে এসেছেন তিনি, অথচ এথেন্স অলিম্পিকের কোনো পোস্টারে তার ছবি নেই। এক সাংবাদিক প্রশ্নটা করলেন, ইঙ্গিতটা অবশ্যই ইয়ান থর্পের দিকে আপাত-নিরীহ এই প্রশ্নের মধ্যে আসল যে প্রশ্নটা লুকিয়ে আছে তা এ রকম : গত বিশ্ব চ্যাম্পিয়নশিপের ফল বিবেচনায় থর্পকে ছাপিয়ে যাওয়ার পরও যে এখনো সাঁতারের সবচেয়ে বড় বিজ্ঞাপন মনে করা হয় ওই অস্ট্রেলিয়ানকে, এটা আপনার কেমন লাগে?

প্রশ্নের অন্তর্নিহিত অর্থটা ঠিকই বুঝলেন ফেলপস, ‘আমি এখানে সাঁতার কাটতে এসেছি, বিলবোর্ড বা পোস্টারের দিকে তাকিয়ে থাকতে নয়।’ উত্তর দেওয়ার সময় তাঁর চোখমুখ এমন লাল দেখাল যে, আধঘণ্টার সংবাদ সম্মেলনে প্রথম বোঝা গেল, গত জুনে উনিশে পা দিয়েছেন মাইকেল ফেলপস। 

আরো পড়ুন...
মাইকেল ফেলপস: জীবন্ত কিংবদন্তিতে কুলাচ্ছে না!

সম্পর্কিত বিষয়:

শেয়ার করুনঃ
আপনার মন্তব্য
আরও পড়ুন
×