নেইমারের পায়েই ঘুচল ব্রাজিলের আক্ষেপ
উৎপল শুভ্র
২৭ জানুয়ারি ২০২১
বিশ্বকাপ ফুটবলে সফলতম দল কিনা অলিম্পিক ফুটবলে একবারও সোনা জিততে পারেনি! নিজেদের দেশে এই অপূর্ণতা ঘোচানোর দায়িত্ব এসে পড়েছিল নেইমারের কাঁধে, বরং বলা ভালো, নেইমারের পায়ে। মারাকানার সেই রাতের প্রত্যক্ষ সাক্ষী থাকাটাও অবিস্মরণীয় এক অভিজ্ঞতা।
প্রথম প্রকাশ: ২২ আগস্ট ২০১৬। প্রথম আলো।
ব্রাজিলের স্বপ্নপূরণের ভার তুলে দেওয়া হয়েছিল তাঁর কাঁধে। যত না স্বপ্নপূরণ, তার চেয়ে বেশি আক্ষেপ ঘোচানোর। সব জেতা হয়ে গেছে অথচ বিশ্বের সফলতম ফুটবল জাতি কিনা অলিম্পিকে সোনা জিততে পারেনি কখনো!
‘চাপ’ ছিল পাহাড়প্রমাণ। সেটি অতিপ্রাকৃত রূপ নিল টাইব্রেকারে। দুদলের প্রথম চারটি শট থেকেই গোল হয়েছে। তাহলে কি সাডেন ডেথ! এই ম্যাচ ব্রাজিলিয়ানদের স্নায়ুর আর কত পরীক্ষা নেবে!
মহাকাব্যিক এক লড়াইয়ে আসল মোচড়টা এরপরই। পিটারসেনের নেওয়া জার্মানির পঞ্চম শটটি ঠেকিয়ে দিলেন ব্রাজিলিয়ান গোলরক্ষক ওয়েভারটন। নেইমার গোল করতে পারলেই জিতে যায় ব্রাজিল। ঘুচে যায় এত এত বছরের আক্ষেপ।
আশি হাজারের মারাকানায় তখন থমকে গেছে সময়। নেইমার দুই পা এগিয়ে একটু থামলেন। এটাই তাঁর পেনাল্টি নেওয়ার স্টাইল। যা জানা থাকার পরও মনে হচ্ছে, ফুটবলপাগল দেশের প্রত্যাশার চাপ গুঁড়িয়ে দিচ্ছে না তো তাঁকে! সব জয় করে নেইমার গোল করলেন। ফেটে পড়ল মারাকানা। ম্যাচের শুরু থেকেই সমুদ্রের গর্জন তোলা গ্যালারিতে আনন্দে কে কী করছে, তার ঠিক নেই।
আর নেইমার? নেইমার তখন শুয়ে পড়েছেন মাঠে। অঝোরে কাঁদছেন। উঠে বসলেন একবার। কান্নার দমকেই হয়তো শুয়ে পড়লেন আবারও। ছুটে এসেছেন সতীর্থরা। কাঁদছেন তাঁরাও। এমন আনন্দের কান্না জীবনে কখনো কাঁদেননি তাঁদের কেউ।
এভাবে কতক্ষণ কাটল! পাঁচ মিনিট? দশ মিনিট? কে জানে, মারাকানার সময় তখন নিজস্ব নিয়মে চলছে। একসময় উঠে দাঁড়ালেন নেইমার। শুরু হলো বাঁধনহারা উদ্যাপন। লাফ দিয়ে ফেন্সিং টপকে চলে গেলেন গ্যালারির কাছাকাছি। হাত ছুড়ছেন, লাফাচ্ছেন। যেন অনেক দিনের চাওয়া কোনো খেলনা পেয়ে যাওয়ার পর এক বালকের উল্লাস!
‘বালক’ই তো! হতে পারে অনেক দিনই তিনি ব্রাজিল নামের এক ফুটবল পরাশক্তির আশাভরসার কেন্দ্রবিন্দু। কিন্তু বয়স তো মাত্র ২৪। স্টেডিয়ামে চক্কর দিতে দিতে এলেন অন্য প্রান্তের গোলপোস্টের পেছনে। একটু থমকে দাঁড়ালেন। এই গোলপোস্টেই ম্যাচের ২৬ মিনিটে অসাধারণ এক ফ্রিকিকে নেইমারের গোল এগিয়ে দিয়েছিল ব্রাজিলকে। ৫৯ মিনিটে জার্মান অধিনায়ক ম্যাক্সিমিলিয়ান মেয়ারের সমতাসূচক গোলটিও জড়িয়েছে এই জালেই।
নেইমারের ওপর দিয়েই বেশি গেছে ঝড়টা। অপমানও কম জোটেনি। জার্সির পেছনে তাঁর নাম বদলে মহিলা দলের স্ট্রাইকার মার্তার নাম বসিয়ে নিয়েছেন সমর্থকেরা। নিজের দেশের দর্শকের কাছ থেকেই শুনতে হয়েছে দুয়োধ্বনি।
দর্শক-উন্মাদনার নতুন এক সংজ্ঞা লিখেছে গত পরশুর মারাকানা। ম্যাচ শেষ হয়ে যাওয়ার ঘণ্টা খানেক পরও গ্যালারির প্রায় পুরোটাই ভরা। নেইমার যতক্ষণ মাঠে আছেন, তাঁরা কীভাবে চলে যান! উদ্যাপন শেষ হলো। গলায় পরা হলো সোনার পদকও। এরপর ব্রাজিল দলের সব খেলোয়াড়, কোচ, দলসংশ্লিষ্ট বাকি সবাই গোল হয়ে দাঁড়ালেন মাঠের মাঝখানে। দাঁড়িয়ে থাকলেন অনেকক্ষণ। কেউ কি কিছু বলছিলেন? স্মৃতিচারণা হচ্ছিল ফেলে আসা ১৮টি দিনের! নেইমারদের যা অনুভূতির সব রূপের সঙ্গেই পরিচয় করিয়ে দিয়েছে!
প্রথম দুই ম্যাচে দক্ষিণ আফ্রিকা ও ইরাকের মতো দলের বিপক্ষে গোলশূন্য ড্রয়ের পর ক্ষতবিক্ষত হতে হয়েছে সমালোচনায়। নেইমারের ওপর দিয়েই বেশি গেছে ঝড়টা। অপমানও কম জোটেনি। জার্সির পেছনে তাঁর নাম বদলে মহিলা দলের স্ট্রাইকার মার্তার নাম বসিয়ে নিয়েছেন সমর্থকেরা। নিজের দেশের দর্শকের কাছ থেকেই শুনতে হয়েছে দুয়োধ্বনি। তখনই কি সিদ্ধান্তটা নিয়ে ফেলেছেন নেইমার? যেটি জানালেন ব্রাজিলকে স্বপ্নের সোনা এনে দেওয়ার কিছুক্ষণ পরই। আর ব্রাজিলের অধিনায়কত্ব করতে চান না। অভিমানটা তখন মনের এক কোণে, বাকিটা জুড়ে শুধুই আনন্দ। যেটি প্রকাশের ভাষা খুঁজে পাচ্ছেন না, ‘এটা আমি বলে বোঝাতে পারব না। আমি আমার স্বপ্ন পূরণ করেছি। দেশের মাটিতে তা করতে পারায় আমি গর্বিত।’
শুধু এত বছরের আক্ষেপ ঘোচানোই নয়, অন্য মাহাত্ম্যও আছে নেইমারদের এই জয়ের। বিশ্বকাপ সেমিফাইনালে জার্মানির কাছে ৭-১ গোলে পরাজয়ের ‘মিনেইরোজো’, কোপা আমেরিকার প্রথম রাউন্ড থেকেই বিদায়, বিশ্বকাপ বাছাইপর্বে ষষ্ঠ স্থান—সবকিছু মিলিয়ে ব্রাজিলিয়ান ফুটবল নিয়ে গত কিছুদিন যে ‘গেল-গেল’ রব, সেটিও বোধ হয় এবার একটু থামবে। সংবাদ সম্মেলনে এসে সেই ঘোষণাই দিলেন ব্রাজিলের কোচ রোজেরিও, ‘ব্রাজিলিয়ান ফুটবল মরে যায়নি।’
‘ব্রাজিলিয়ান ফুটবল’ মানে শুধু ট্রফি জয়ই নয়, খেলার একটা নির্দিষ্ট ধরনও। প্রথম দুই ম্যাচের পর থেকে নেইমারের নেতৃত্বে এই তরুণেরা সেই ফুটবলটাই খেলেছে, সারা বিশ্ব যা ব্রাজিলের কাছ থেকে দেখতে চায়।
কিন্তু তার আগেই যে এই দলকে শূলে চড়িয়ে ফেলেছেন ব্রাজিলিয়ানরা, তার কী হবে? এর জবাব দিতে পারায় এই সাফল্য কি আরও বেশি আনন্দের? রোজেরিও মিকােল হাসেন, ‘এটা ব্রাজিলিয়ান সংস্কৃতিরই অংশ। আমরা এমনই। হয় ভালোবাসা নয়তো ঘৃণা। আমরা চরমভাবাপন্ন এক জাতি। তবে এই মুহূর্তে আমি একজন ব্রাজিলিয়ান হিসেবে গর্বিত।’
সেই গর্ব এখন সব ব্রাজিলিয়ানেরই। যে গর্বের একটা নামও দিয়ে দিতে পারেন।
নেইমার ডা সিলভা সান্তোস জুনিয়র!