বাংলাদেশের ক্রিকেটের সমস্যাটা কোথায়?
উৎপল শুভ্র নির্বাচিত পাঠকের লেখা
আসিফ আফনান পিয়াল
২১ এপ্রিল ২০২১
অধিনায়কের কথার সঙ্গে কাজের মিল পাওয়া যাচ্ছে না, নতুনরা মাঠের চেয়ে মাঠের বাইরের কার্যকলাপেই বেশি আলোচনায়, বিসিবির কর্মকাণ্ডেও ধরা পড়ছে গণ্ডগোল। দর্শকের চোখে ধরা পড়া অসঙ্গতিগুলোই তুলে ধরেছেন এক পাঠক।
শ্রীলঙ্কা সফরে যাওয়ার আগে সংবাদ সম্মেলনে অধিনায়ক মুমিনুল হক বলে গেলেন, তিনি উইকেটের পেছনে দলের সেরা কিপারকেই চান। টেকনিক, রিফ্লেক্স, আই সাইট-এসবের সমন্বয়ে নুরুল হাসান সোহান যে বাংলাদেশের সেরা কিপার, এ নিয়ে কারও সন্দেহ থাকার কথা নয়। সফরসঙ্গী হওয়ায় সোহান যে স্বাভাবিকভাবেই স্কোয়াডে এবং একাদশে থাকবেন, এটা ক্যাপ্টেনের কথায় মোটামুটি অনুমিতই ছিল। কিন্ত কিসের কি? ১৫ জনের দলেই নাই সোহান।
আবার শুভাগত হোমকে নেওয়ার পেছনে যুক্তি ছিল, সাকিব আল হাসানের বিকল্প হিসেবে সুযোগ পাচ্ছেন তিনি। সেই শুভাগতও নেই স্কোয়াডে। শ্রীলঙ্কায় সবসময়ই স্পিন ভালো ধরে। তাতে যদি উইকেট ঘাস দিয়ে মোড়াও থাকে, তবুও দর্শক হিসেবে আমি বেশি স্পিনার খেলানোর পক্ষে। দেখুন, স্কোয়াডে দুই স্পিনার, চার পেসার। আর কোনো বিকল্পও নেই বোলিং করানোর। একমাত্র বোলিং অপশন মিঠুন। এভাবে টেস্ট খেলা কি আদৌ সম্ভব?
আর এক ফরম্যাটে কোনো প্লেয়ার ভালো করলেই অন্য ফরম্যাটে খেলিয়ে তাঁকে ওয়েস্ট করাটা আমাদের পুরোনো স্বভাব। মোস্তাফিজ, সৌম্যের পর এটার সম্ভাব্য বলি হতে পারেন শরিফুল। আমি শরিফুলের মাঝে আরেকজন মাশরাফি খুঁজে পাচ্ছি, মানে ইনজুরড মাশরাফি। যদি ধরেও নিই, শরিফুল একাদশে সুযোগ পেলেন না, তবুও শরিফুল নিজেকে কীভাবে প্রস্তুত করবেন? টেস্ট বোলার হিসেবে নাকি সীমিত ওভারের ক্রিকেটের বোলার হিসেবে? এই অল্প বয়সে প্রেশারটা বেশি হয়ে যাবে না?
ঘরোয়া ক্রিকেটে রাব্বি-মোসাদ্দেক নিয়মিত পারফর্মার। রাব্বি দলে আছেন, মোসাদ্দেক আর লিটনকে ব্যক্তিগতভাবে বাংলাদেশের সেরা টেস্ট ব্যাটসম্যান মনে করি আমি। কারণ তাঁদের ডিফেন্স আমার কাছে 'আপ টু দ্যা মার্ক' মনে হয়েছে। মোসাদ্দেক দলে নাই, কারণ হিসেবে অনেক জায়গায় শুনেছি তিনি নাকি ইনজুরি লুকিয়ে নিউজিল্যান্ডে গিয়েছেন। একটা ইন্টারন্যাশনাল টিমে এসবও কি সম্ভব? একটা প্লেয়ার চাইলেই কি ইনজুরি লুকাতে পারে যেখানে ফিজিও-ট্রেনার আছেন? যদি লুকিয়েই ফেলেন, তাহলে ট্রেনাররা কী করছেন? ফিজিওর কাজটাই বা কী তাহলে? আমার মনে হয়, আমরা ইন্টারন্যাশনাল ক্রিকেটকে খুব সহজ ভেবে নিচ্ছি, আমরা যথেষ্ট মূল্য দিচ্ছি না।
রাসেল ডমিঙ্গোর দোষ আমি দিচ্ছি না, দোষ দেব তাঁকে, যিনি কোচ বানিয়েছেন। যে লোকটা এসেছিলেন এইচপির কোচ হতে, তাঁকে আমরা বানিয়ে দিয়েছি ন্যাশনাল টিমের কোচ। ন্যাশনাল টিম কি হাতের পুতুল? তবে তাঁর যে 'দীর্ঘমেয়াদী পরিকল্পনা' নিয়ে ট্রল হয়, আমি সেক্ষেত্রে তাঁকে সমর্থন করছি। দীর্ঘমেয়াদী পরিকল্পনা ছাড়া এ দলটাকে গড়া সম্ভব না। যদিও উনি মুখে বললেও কাজে ফলাতে পারছেন না, কাউকেই দীর্ঘ সময় ধরে খেলাতে পারছেন না।
আমি স্রেফ একটা পরিকল্পনার কথা বলি, সাকিব তিন নম্বরে খেলার আগে পজিশনটায় বাংলাদেশের একটা সমস্যা ছিল। সেটা দূর হয়েছে সত্যি, কিন্ত সাকিব পাঁচে না খেলায় এখন সেখানে একটা সমস্যা তৈরি হয়েছে। সেখানে আমরা মিঠুনকে ট্রাই করছি। আমার মনে হয়, ওয়ানডে ক্রিকেটে মিনি অলরাউন্ডাররা দারুণ কার্যকর। বাংলাদেশে এই অপশনটা বেশি, আমরা পাঁচে মোসাদ্দেক কিংবা ধ্রুবকে (আফিফ হোসেন) ট্রাই করতে পারি তাঁদের বোলিং অপশনের জন্য। আর মিডল অর্ডারে তাঁরা কতটা ভালো ব্যাটসম্যান, যারা ঘরোয়া ক্রিকেটের নিয়মিত খোঁজ-খবর রাখেন, তারা নিশ্চয়ই জানেন।
টেস্ট ক্রিকেটেও এই সমস্যা দূর করা যায়। টেস্ট ক্রিকেটে টেকনিক্যালি দলের সব থেকে সাউন্ড ব্যাটসম্যান খেলেন নাম্বার থ্রিতে আর দলের সবচেয়ে ভালো ব্যাটসম্যান খেলেন চারে। উদাহরণ হিসেবে অস্ট্রেলিয়ার লাবুশেন-স্মিথ, ভারতের পূজারা-কোহলির নাম নেয়া যায়। বাংলাদেশে তেমন উদাহরণ হতে পারেন মুমিনুল আর মুশফিক। সাকিব পাঁচে, ছয় সাতে মোসাদ্দেক-লিটন, আটে মিরাজ। আমার মনে হয় না, বাংলাদেশ এই মুহূর্তে এর থেকে ভালো ব্যাটিং লাইন আপ পেতে পারে। একটা-দুইটা পজিশন এখানে রোটেট করা যেতে পারে, বাজে পারফর্ম করলে দলের বাইরে রাখা যেতে পারে। যেমন ওপেনিং স্লটে, অ্যাওয়েতে মুমিনুলকে, বাউন্সি উইকেটে মিরাজকে বসিয়ে এক্সট্রা পেসার কিংবা ব্যাটসম্যান নেওয়া যেতে পারে। এভাবে রোটেশন মেনে চললে হয়তো আগের থেকে ভালো পারফর্ম করা সম্ভব।
আরেকটা ব্যাপার হচ্ছে কমিটমেন্টের অভাব। বাংলাদেশের হয়ে পাঁচ-ছয় বছর ধরে আন্তর্জাতিক ক্রিকেট খেলেও এখনো যাঁরা তরুণ, তাঁরা নাকি পর্যাপ্ত প্র্যাকটিস করেন না। তাঁদের বুঝতে হবে, আমরা তখনই আউটপুট আশা করব, যখন প্রপার ইনপুট সেখানে দেব। যথেষ্ট প্র্যাকটিস না করে কীভাবে ভালো করবেন তাঁরা?
প্লেয়ারদের বাজে পারফরম্যান্সের পাশাপাশি গোদের ওপর বিষফোঁড়া হিসেবে রয়েছে টিম ম্যানেজমেন্টের দূরদর্শিতার অভাব। তাঁদের সমস্যা হচ্ছে, কেউ এক ফরম্যাটে ভালো পারফর্ম করলেই তাঁকে ধরে সব ফরম্যাটে খেলানো হয়। অনেক সময় ভালো পারফর্ম করতেও হয় না-যাঁকে একবার খেলানো হয়, তাঁকে সব ফরম্যাটে সুযোগ দেয়া হয়। আপনাকে একটা পুরো সিরিজ সুযোগ দিলে যেমন তিনটা টি-টোয়েন্টি, তিনটা ওয়ানডে আর দুইটা টেস্ট, সব মিলিয়ে এই দশ ইনিংসে আপনি এমনিতেও একটা-দুইটা সম্ভাবনাময় ইনিংস খেলবেন। ওই এক ইনিংসেই মিলবে আরেক সিরিজের টিকিট। এটাই মূল ঝামেলা করে।
আরেকটা প্রকট সমস্যা হচ্ছে তেলবাজি। আমাদের তথাকথিত ইয়াং প্লেয়াররা কেউই কিন্ত সিনিয়রদের ছাড়িয়ে যেতে চান না। কেউ বলেন না, সাকিব ভাইকে ছাড়াতে চাই, মুশফিক ভাইয়ের থেকে বেশি রান করতে চাই। তাঁদের উত্তর থাকে, 'সাকিব ভাই আছেন, তিনি বিশ্বসেরা অলরাউন্ডার', 'মুশফিক ভাই অনেক পরিশ্রম করেন'। এই পর্যন্তই। কেউ তাঁদের ছাড়িয়ে যেতে চান না, চাইলেও মুখে বলেন না। ইচ্ছাটাই আসল, পারবেন কি পারবেন না, সেটা ভিন্ন ব্যাপার। নিজের কাছে নিজের প্রত্যাশা না থাকলে কীভাবে হবে? নিজের প্রত্যাশার চাপই যদি তাঁরা নিতে না পারেন, সতেরো কোটি মানুষের প্রত্যাশার চাপ কীভাবে নেবেন?
আমি যতটুকু বুঝি, তাতে টেস্ট ক্রিকেট আসলে অভিজ্ঞদের খেলা, বয়সীদের খেলা। টি-টোয়েন্টিতে আসলে তরুণরা প্রাধান্য পাবে বেশি। এখন শচীন টেন্ডুলকার, মিসবাহ-উল-হক, ইউনিস খান, কুমার সাঙ্গাকারা এদের উদাহরণ টানা যায় যে, এঁরা ৩৫ বছর বয়সের পরেও টেস্ট খেলেছেন। বললে হয়তো ভুল হবে না, ইউনিস-মিসবাহদের ক্যারিয়ার পিক টাইম শুরুই হয়েছে ত্রিশ বছরের পর। এমন অনেকেই আছেন। কারও কি মনে হয় না শাহরিয়ার নাফীস, তুষার ইমরান কিংবা আবদুর রাজ্জাককে টেস্টে সুযোগ দেওয়া যেত ঘরোয়ার পারফরম্যান্সের ভিত্তিতে? যেহেতু তাঁরা তাঁদের পিক ফর্মে ছিলেন তখন? দেওয়া তো যেতই। টেস্ট ক্রিকেটে অভিজ্ঞতার দাম অনেক, সেটা বাংলাদেশ ক্রিকেট দল এখনো বুঝতে পেরেছে কি না, কে জানে! যদিও তখন ভাবা হয়েছে, নতুনরাই হবে সোনার ডিম পাড়া হাঁস!
দীর্ঘমেয়াদী পরিকল্পনার বুলি আওড়ালেও আমাদের ক্রিকেট আসলে কোনো পরিকল্পনা ছাড়াই চলছে। আমরা বারবার বলি, আমাদের পাইপলাইনে 'প্লেয়ার নাই', 'ভালো প্লেয়ার নাই'। কিন্ত প্লেয়ার আসবে কীভাবে? আজ প্রায় দুই বছর ঢাকা লিগ বন্ধ, প্রিমিয়ার লিগ বন্ধ এক বছরের বেশি। তাহলে সেখানে যাঁরা খেলেন, তাঁরা খেলবেন কোথায়? বিসিবির কর্মকাণ্ডে মনে হয়, ক্রিকেট শুধু জাতীয় দলের প্লেয়াররাই খেলবেন, এর বাইরে কোনো দল নাই। জাতীয় দল থেকে কেউ বাদ পড়লে, তাঁর ফিরতে কষ্ট হয়ে যায়, কেননা তাঁরা সেই অনুশীলন সুবিধা পান না। এমনও উদাহরণ আছে, একজন জাতীয় লিগের নিয়মিত খেলোয়াড় অনুশীলন করেন স্থানীয় খেলোয়ারদের সঙ্গে, বয়সভিত্তিক দলের প্লেয়ারদের সঙ্গে। তাঁদের সঙ্গে অনুশীলন করে নিজের লেভেলকে কি উপরের দিকে নিয়ে যাওয়া আদৌ সম্ভব?
আমরা বারবার ভারতের উদাহরণ টানি, তাঁদের প্লেয়ারদের নিয়ে আফসোস করি। তাঁদের একটা প্লেয়ারকে জাতীয় দলে না খেললেও চলে, তাঁদের আর্থিক সমস্যা হয় না। তাই তাঁরা ন্যাচারাল ক্রিকেট খেলতে পারেন। বাংলাদেশের সবার আর্থিক সচ্ছলতা বাড়াতে হলেও জাতীয় দলে খেলতে হয়, অপ্রিয় হলেও এটাই সত্য কথা। এ কারণে নিজেরাই বেশি চাপ নিয়ে ফেলেন, ফলে স্রেফ বিপিএলেও ন্যাচারাল পারফর্মার বের হয় না। ঘুরে-ফিরে সেই পুরোনো প্লেয়াররাই পারফর্ম করেন। আইপিএল ভারতের প্লেয়ার তৈরি করার প্ল্যাটফর্ম না, ওটা রঞ্জি কিংবা সৈয়দ মুস্তাক আলী ট্রফির কাজ। কিন্ত আইপিএল একটা প্লেয়ারকে মেন্টালি স্ট্রং করে, লাইমলাইটে আনে। আমাদের বিপিএলও এমন হতে পারত। আফসোস, এমনটা হয়নি। সাকিবের সঙ্গে তাল মিলিয়ে বলতে চাই, বিপিএলটা যদি প্রতি বছর একই ফ্র্যাঞ্চাইজি নিয়ে একটা নির্দিষ্ট সময়ে হতো, তাহলে হয়তো বাংলাদেশ ক্রিকেট আরও এগিয়ে যেত।