উৎপল শুভ্র নির্বাচিত পাঠকের লেখা

নাসুমের গল্পটা কি জানেন?

মান্না চৌধুরী

৪ আগস্ট ২০২১

নাসুমের গল্পটা কি জানেন?

ছবি: বিসিবি

প্রথমবারের মতো অস্ট্রেলিয়ার বিপক্ষে টি-টোয়েন্টিতে জয় পেল বাংলাদেশ, নাসুম আহমেদও প্রথমবারের মতো আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে পেলেন ম্যাচসেরার পুরস্কার। ভাটির দেশ থেকে নাসুমের উঠে আসার গল্পটাও কম রোমাঞ্চকর না। সেই গল্পটাই সিলেট থেকে লিখে পাঠালেন এক পাঠক।

নাসুম আহমেদের পিতৃপুরুষের ভিটে সুনামগঞ্জের দিরাই উপজেলার ভাটিপাড়া গ্রামে। জল, হাওর, নদী মিলে যেখানে মানুষের জীবন। ভাটি এলাকা নিয়ে সিলেট অঞ্চলে পুরনো একটা কথা আছে, বর্ষায় নাও আর হেমন্তে পাও! নাসুমের বাবা- চাচারা জলের সাথে যুদ্ধ করেই জীবন সাজিয়েছেন। তাঁর অবশ্য ভাটির কঠিন জগত দেখতে হয়নি। তিনি দেখেছেন সবুজ গালিচার রঙিন দুনিয়া। ক্রিকেটের প্রেমে পড়ে, বাইশ গজের রোমাঞ্চ দেখে দেখেই নাসুম বড় হয়েছেন। সঙ্গে বড় হয়েছে তাঁর দু'চোখে আঁকা স্বপ্নটাও।

কিন্তু স্বপ্ন দেখে আর দেখিয়ে সময় বয়ে যায় অনেক। তবু স্বপ্ন আর বাস্তব এক হয় না। উল্টো অকারণ অবহেলায় বারবার পুড়তে হয়েছে হতাশার আগুনে। তাই বলে হাল ছেড়ে দেননি নাসুম। তাঁর রক্তে যে প্রবাহিত সংগ্রামের কঠিন দাগ। যাঁর কাছে জীবন মানেই লড়ে যাওয়ার গল্প। তাই প্রথম শ্রেণির ক্রিকেটে অভিষেকেই ৬ উইকেট পাওয়া একজন পরের ম্যাচে দল থেকে বাদ পড়েও মনোবল হারাননি! আস্থা, বিশ্বাসে বাইশ গজকেই ঠিকানা বানিয়ে চালিয়ে যান লড়াই। ধৈর্যের পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হতে হতে শেষ পর্যন্ত পেলেন সেই কাঙ্খিত ডাক, নিউজিল্যান্ড সফরে ওয়ানডে আর টি-টোয়েন্টি স্কোয়াডে নাসুমের নাম। কিন্তু নাম দেখেও বিশ্বাস হয় না নিউজিল্যান্ডের পেস সহায়ক কন্ডিশনে তিনি খেলবেন। তিন ম্যাচের ওয়ানডে সিরিজে সেই হতাশার ছবিটাই সত্যি হয়ে থাকল। টি-টোয়েন্টিতে এসে খুলে গেল স্বপ্নের দুয়ার। প্রথম টি-টোয়েন্টির একাদশে আছেন তিনি।

নিউজিল্যান্ডে অভিষেক। ছবি: গেটি ইমেজেস

নিউজিল্যান্ডের বিপক্ষে প্রথম টি-টোয়েন্টিতে প্রথম ওভারেই নাসুমের হাতে বল তুলে দিলেন বাংলাদেশ অধিনায়ক মাহমুদউল্লাহ। স্ট্রাইকে টি-টোয়েন্টিতে অভিষিক্ত কিউই ব্যাটসম্যান। কিন্তু নন স্ট্রাইকিং প্রান্তে যিনি দাঁড়িয়ে, তাতে নবীন নাসুমের হাত-পা কাঁপাটাই স্বাভাবিক ছিল। মার্টিন গাপটিলের সামনে বল ফেলা কি সহজ কাজ? তবে নাসুমের কাছে এই পরীক্ষায় পাস করাটা ছিল একটা চ্যালেঞ্জ। যে চ্যালেঞ্জের জন্য তাঁর প্রায় এক যুগের প্রস্তুতি। প্রথম বলেই পেলেন ইয়াংয়ের উইকেট। উল্টো গাপটিলকেই বারবার ভয় পাইয়ে দিয়ে নিয়েছেন নিউজিল্যান্ডের ভয়ংকর ব্যাটসম্যানের উইকেটও! চার ওভার হাত ঘুরিয়ে ২৪ রান দিয়ে দুই শিকার। শরিফুল ক্যাচ ধরে ভারসাম্যটা রাখতে পারলেই দুইয়ের জায়গায় উইকেট হতো তিন। 

টি-টোয়েন্টির মতো রানের খেলায় একজন বোলারের কাছে দুই উইকেটই বেশি কিছু। নাসুমের কাছে এই পরফরম্যান্স আরও স্পেশাল। তাঁর ভেতরটা যে অনেকদিন থেকেই পুড়ছিল। জাতীয় লিগে, ঢাকা প্রিমিয়ার লিগে নিয়মিত ভালো করার পরও উপেক্ষিতই থেকেছেন বারবার। শেষ পর্যন্ত জাতীয় দলে ডাক যখন এলো, তখন তাঁর বাড়ীর উঠানেই ক্রিকেট। মনে মনে বেশ রোমাঞ্চিত ছিলেন চেনা মানুষজনের সামনেই খুলে দেবেন বাঁহাতি স্পিনের জাদু। কিন্তু দুর্বল জিম্বাবুয়ের বিপক্ষেও তাঁর পরীক্ষাটা নিল না টিম ম্যানেজমেন্ট। অন্য কেউ হলে হয়তো ক্রিকেটকে গুডবাই বলে দিতেন। কিন্তু নাসুম যেন মাছ না ধরা বড়শি হাতে বসে থাকা এক শিকারী! ২০১২ অনুর্ধ্ব-১৯ বিশ্বকাপের পর থেকেই স্বপ্ন দেখে আসছেন। স্বপ্নের জগতে বাস করতে করতে বয়স বেড়ে হয়েছে ২৮। স্বপ্নটাকে তবু বিসর্জন দেননি। 

দেননি বলেই আজ তিনি বাংলাদেশের সবচেয়ে সুখী মানুষ! ক্রিকেটে মহাশক্তিধর অস্ট্রেলিয়াকে বাংলাদেশ হারিয়েছে নাসুমের হাত ধরেই। করোনায় কঠিন করে তোলা সময়ে অস্ট্রেলিয়া ক্রিকেট দল বাংলাদেশে এসেছে অতিথি হয়ে। পাঁচ ম্যাচের টি-টোয়েন্টি সিরিজে অস্ট্রেলিয়া যতটা না মাঠের খেলায় আছে, তার চেয়ে বেশি মাঠের বাইরের সতর্কতায়! যে সিরিজের শুরুতেই মাহমুদউল্লাহর মুখে তৃপ্তির হাসি। আর এই হাসির উৎস হয়ে এলেন নাসুম।

আরও একটা উইকেট। ছবি: বিসিবি

নিজের প্রথম ওভারে একটু খরুচে, ১০ রান দিয়ে এক উইকেট। পরের তিন ওভারে দিলেন মাত্র ৯ রান, উইকেট নিলেন ৩টি! এই যে অস্ট্রেলিয়া ব্যাটিংয়ের মেরুদন্ড ভেঙে দিলেন, আর সোজা হয়ে দাঁড়াতে পারেনি মিচেল মার্শের দল। 

১৯ রানে ৪ উইকেট। এমন একটি বোলিং ফিগারের স্বপ্ন নাসুমের অনেকদিনের। যে স্বপ্নের পেছনে ছুটতে গিয়ে মুদ্রার এপিঠ, ওপিঠ দুটোই দেখতে হয়েছে। সবুজ গালিচার বুকে ভবিষ্যতের ছবি আঁকতে গিয়ে কষ্ট করতে হয়েছে অনেক। একটা সময় এমনই এক ঝড় বয়ে যায় পরিবারের ওপর দিয়ে, জীবনের জন্য ক্রিকেটই ছেড়ে দিতে রাজি ছিলেন নাসুম! চাকরিও জুটিয়ে নিয়েছিলেন। কিন্তু ক্রিকেট যাঁর রক্তে মিশে আছে, তিনি ব্যাট-বল তুলে রাখেন কিভাবে? চাকরির পাশাপাশি সময় সুযোগ মতো প্র্যাকটিসও চলল। এভাবে জীবিকা আর ক্রিকেটকে এক করেই স্বপ্নের পথে হেঁটেছেন নাসুম। বন্ধুর পথে চলতে চলতে শেষ পর্যন্ত লাল-সবুজ জার্সির দেখা পাওয়া। বাকিটা তো ইতিহাস।

অস্ট্রেলিয়াকে বাংলাদেশ হারাল প্রথমবার, নাসুমও আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে প্রথমবার জিতলেন ম্যাচসেরার পুরস্কার। ছবি: গেটি ইমেজেস

বাংলাদেশ ক্রিকেটের আরেক প্রথম এনামুল হক জুনিয়র নাসুমের আদর্শ। একই শহর সিলেটের বড় ভাইকে আদর্শ মেনেই তিনি স্বপ্ন সাজিয়েছেন। সময়, সুযোগ পেলেই এনামের কাছ থেকে টিপস নিতেন। টেস্ট ক্রিকেটে বাংলাদেশকে প্রথম জয় এনে দেয়া স্পিনারও উদার হস্তে দেখিয়ে দিতেন বোলিংয়ের এদিক, ওদিক সব। এনামুল জুনিয়রের মতোই শেনাজ আহমেদ, মারুফ হাসান, রাজিন সালেহ, মাহমুদ ঈমন আর মশিউর রহমান টুটুলের কাছে নাসুমের যত ঋণ। ক্রিকেটে তাকে প্রথম পথ দেখানো নাম সিলেটের ক্রিকেটার শেনাজ আহমেদ। তিনিই নাসুমকে তুলে দেন ক্রিকেট কোচ মারুফ হাসানের হাতে। স্বপ্নের বীজ বুনে দিলেন মারুফ। পাশাপাশি জাতীয় দলের সাবেক অধিনায়ক রাজিন সালেহ, সিলেট বিভাগীয় ক্রিকেট কোচ মাহমুদ ঈমনের সহযোগিতার কথাও শ্রদ্ধাভরে স্মরণ করেন অস্ট্রেলিয়ার বিপক্ষে প্রথম টি-টোয়েন্টি জয়ের নায়ক। মশিউর রহমান টুটুল নামটা নাসুমের কাছে আরো স্পেশাল। নাসুমের ভাষায়, এই মানুষটা তাঁর ক্রিকেটার পরিচয়কে পুণর্জীবিত করেছেন।

ইউরোপ, আমেরিকা, পাশের দেশ ভারত হয়ে করোনার ভয়াবহতা এখন বাংলাদেশে। চারদিকে চলছে মৃত্যুর মিছিল। স্বজন হারানোর কান্নায় ভারী হচ্ছে বাংলার বাতাস। এমন এক অন্ধকার সময়ে লাল- সবুজের বুকে আলো জ্বালিয়ে দিল নাসুমের চার উইকেট। ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের দরোজা খুলতে না পারা ব্যবসায়ীর হতাশা, চাকরি হারানো যুবকের চাপা কান্না, ভবিষ্যত চিন্তায় অস্থির পরিবারের কষ্টের সীমা ভুলিয়ে দেয়া এক স্পেল। নাসুম নামটা তাই করোনার টিকা হয়েই থাকুক। 

শেয়ার করুনঃ
আপনার মন্তব্য
আরও পড়ুন
×