উৎপল শুভ্র নির্বাচিত পাঠকের লেখা

ফাওয়াদ আলমের দিন এসেছে, আপনারও আসবে

ইফতেখার নিলয়

২৭ আগস্ট ২০২১

ফাওয়াদ আলমের দিন এসেছে, আপনারও আসবে

বোলারের বল করার অপেক্ষায় ফাওয়াদ আলম

অদ্ভুত এক স্টান্স তাঁর। যা মনে করিয়ে দেয় সাবেক ওয়েস্ট ইন্ডিয়ান ব্যাটসম্যান শিবনারায়ণ চন্দরপলের কথা। স্টান্সে মিল থাকতে পারে, কিন্তু প্রত্যাবর্তনের গল্পে ফাওয়াদ আলম অনন্য এক গল্প। দশ বছর পর আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে ফিরে এমন খেলছেন যে, যা পেয়ে যাচ্ছে বৃহত্তর অর্থ। জীবনে কখনোই `সব শেষ` বলে হাল ছাড়তে নেই, বরং সুযোগের অপেক্ষায় থাকতে হয়।

শিবনারায়ণ চন্দরপলের কথা মনে করিয়ে দেন ফাওয়াদ আলমচন্দরপলের স্টাম্প উন্মুক্ত দেখে রান আপ শুরুর আগে বোলার চওড়া হাসি দিতেন ঠিকই! কিন্তু বোলারের সেই হাসি বিলীন হয়ে যেত মুহূর্তেই। এমন অদ্ভুতুড়ে ব্যাটিং স্টান্স নিয়ে কিভাবে দিনের পর দিন নিজেকে সামলে রেকর্ডের পর রেকর্ড গড়েছেন! সে প্রশ্নের জবাব খোদ চন্দরপল ছাড়া কারোরই বোধহয় জানা নেই।

সাম্প্রতিক সময়ে ফাওয়াদ আলমকেও চন্দরপলের পাল্লায় মাপা হয় ব্যাটিং স্ট্যান্সের কারণে। তবে আমি খুঁজে নিয়েছি দু'জনের মাঝে বৈচিত্র্য। দু'জনের ব্যাটিং শৈলীর বৈচিত্র্য খুঁজে পাওয়ার পর ফাওয়াদ আলমকেই ঢের সাহসী মেনে নেওয়ার চূড়ান্ত সিদ্ধান্তেও উপনীত হয়েছি। ফাওয়াদের মতো নিয়মিত তিন স্টাম্পকে উন্মুক্ত করে রাখার রেওয়াজ চন্দরপলের মধ্যে দেখা যায়নি।

ফাওয়াদের বাঁ পা লেগ স্টাম্পে আর ডান পায়ের অবস্থান প্রায় ওয়াইড লাইনের কাছাকাছি। বলতে পারেন—তাঁর দুই পায়ের অবস্থান দুই মেরুতে। প্রথম দেখায় বিপরীত পাশ থেকে ছুটে আসা কোনো বোলারকে মোকাবিলার প্রস্তুতি নিচ্ছে বলে মনে হলেও তাৎক্ষণিক সেই ভুল ভেঙে যায় বোলারের হাত থেকে বল বেরোনোর পরপরই। ফাওয়াদ যেন বাইশ গজে বোলারের বিপক্ষে ঠাট্টা-মশকরায় মেতে উঠেন। 

ঠাট্টাই তো! হানিফ মোহাম্মদের পর সবচেয়ে কম ইনিংসে প্রথম শ্রেণির ক্রিকেটে ১২ হাজারি ক্লাবে নাম লেখানো পাকিস্তানি তিনিই। হানিফের ১২ হাজার রানের মাইলফলক ছুঁতে লেগেছিল ২৩১ ইনিংস, ফাওয়াদের লেগেছে ২৫৭ ইনিংস। তবুও ফাওয়াদ উপেক্ষার শিকার হয়ে থেকেছেন বছরের পর বছর। বাইশ গজে বোলারদের সাথে ঠাট্টা-মশকরা করতেন তিনি আর তাঁর সঙ্গে ঠাট্টা-মশকরা করছিলেন পাকিস্তান জাতীয় দলের নির্বাচক প্যানেল।

২০০৯ সালে পি সারা ওভালে টেস্ট অভিষেকে লিকলিকে এক তরুণ ফাওয়াদ দ্বিতীয় ইনিংসে মেন্ডিস-হেরাথদের বিপক্ষে ঠাট্টা-মশকরা করেই ১৬৮ রানের এক অনবদ্য ইনিংসের জন্ম দেন। প্রথম ইনিংসে ৯০ রানে অলআউট হওয়া পাকিস্তান দলের দ্বিতীয় ইনিংসে ম্যাচ না জিতলেও সম্মান বাঁচে ফাওয়াদের ব্যাটে। এশিয়ান ক্রিকেট ছাড়িয়ে বিশ্ব ক্রিকেটেরও অনন্য একজন বনে যাওয়ার সম্ভাবনার সূর্যের উঁকি দেওয়া শুরু সেখান থেকেই। কিন্তু, বিধি বাম! পরের দুই টেস্টে ভালো করতে না পারায় দল থেকে ছিটকে যান। এরপর আর ফিরেও তাকানো হয়নি তাঁর দিকে।

গত দশ বছরে অভিষেক টেস্ট শতকের তালিকা ঘাঁটাঘাঁটি করতে গেলেই কেবল উচ্চারিত হতো ফাওয়াদের নাম। এশিয়ান ক্রিকেটের বাইরে তাঁর নাম উচ্চারিত হতো কালেভদ্রে। দীর্ঘ বিরতির পর ইংলিশদের বিপক্ষে মাঠে নেমে ব্যর্থ হলেও বিস্ময়ের জন্ম দিয়েছেন ঠিকই। আবার যেন চন্দরপল নেমে এসেছিলেন বিলেতের জমিনে।

স্পষ্ট করে বললে, ইদানীংকালে ফাওয়াদের ব্যাটিং স্ট্যান্স নিয়ে ব্যাপক হারে আলোচনা সৃষ্টি হওয়ার মূল কারণ হলো—দীর্ঘ এক দশকেরও বেশি সময় ধরে চলা উপেক্ষার অবসান ঘটিয়ে গেল বছর জাতীয় দলের জার্সিতে ফেরত আসা এবং ইংলিশদের মাটিতে তাদেরই বিপক্ষে। কতিপয় ইংলিশ সমর্থকরা তো তার ব্যাটিং স্ট্যান্সকে চন্দরপলের চেয়েও অদ্ভুত বলেও আখ্যা দিচ্ছিলেন টুইটারে। সাথে প্রকাশ করেছিলেন বিরক্তি।

যদিও এসব ফাওয়াদকে একটুও ভাবিয়ে তোলেনি। এসব তো নতুন কিছুই নয় তাঁর কাছে, অভিষেকের পর থেকে এসব কথা শুনে শুনে অভ্যস্তই হয়ে গেছেন। উপেক্ষার পাশাপাশি ব্যাটিং স্ট্যান্স নিয়ে বারবার এক প্রশ্নের সম্মুখীন হলেও উত্তর দিয়েছেন একটাই—'এটাই আমার ব্যাটিং করার স্বাভাবিক নিয়ম, কাউকে নকল করে এভাবে ব্যাটিং করছি না।' 

বারবার চন্দরপলের সাথে তুলনা করা হলেও ফাওয়াদ তাতে মাথা ঘামাননি বিন্দুমাত্র। যদিও চন্দরপলের সাথে এ নিয়ে আলাপ করার লোভ হয়েছিল ঠিকই। ২০১২ সালে শ্রীলঙ্কা প্রিমিয়ার লিগে দু'জনের সাক্ষাৎ হয়ে গেলে ফাওয়াদ করেছিলেন সেই আলোচনা। চন্দরপল সেদিন দারুণভাবে অনুপ্রাণিত করেছিলেন তাঁকে। 

শিবনারায়ণ চন্দরপলকেও ছাড়িয়ে যাওয়া ফাওয়াদ আলমের স্টান্স

চন্দরপল তাঁকে পরামর্শ দেন— 'লোকের কথায় কান দেওয়া যাবে না। আমি জানি, যেটা উইন্ডিজে হয় সেটা পাকিস্তানেও হয়। আমাকেও লোকের সমালোচনা শুনতে হয়েছে। তুমি এভাবে ব্যাটিং করে স্বচ্ছন্দ বোধ করলে এভাবেই করবে, ব্যাটে রান আসলে পরিবর্তনের তো দরকার নেই। ভালো না করলে সবাইকেই বাদ পড়তে হয়। নিজের স্বাভাবিক খেলাকে প্রাধান্য দাও, পারফরম্যান্স করলে সমালোচনা আপনা-আপনি বন্ধ হয়ে যাবে।' 

চন্দরপলের কথায় অনুপ্রাণিত হয়ে ব্যাটিং স্ট্যান্স নিয়ে সমালোচনাকে আর কখনোই পাত্তা দেননি। চন্দরপলের সাথে সাক্ষাৎ হওয়ার পর ফাওয়াদের ব্যাটিং স্ট্যান্সে স্টাম্প ছেড়ে দেওয়ার প্রবণতা বেড়ে যায় আরও বেশি। তাঁর প্রথম দিককার ব্যাটিং লক্ষ্য করলে দেখবেন—এতটা উন্মুক্ত স্ট্যান্স এর আগে ছিল না। তাই বলা চলে, চন্দরপলের অনুপ্রেরণায় নিজের স্ট্যান্সে বাড়তি স্বাচ্ছন্দ্য এনেছেন।

স্বাচ্ছন্দ্যে থাকলে আর কিসের সমালোচনা?

তবে বলে রাখা ভালো, সমালোচনার চেয়েও তাঁকে ঘিরে জন্ম নিয়েছে ভুরিভুরি আক্ষেপের গল্প। রানের পর রান করেও উপেক্ষিত হয়েছেন। আফ্রিদি নিজের ইউটিউব চ্যানেলে ফাওয়াদের ইন্টারভিউ নিতে গিয়ে নির্বাচকদের প্রশ্ন করেছিলেন, ‘আপনারা শুনছেন তো?’ 

অন্যান্য ইন্টারভিউয়েও ফাওয়াদ বারবার বলেছেন, ‘ফিটনেসের ওপর কিছুই নেই, আমি ফিটনেস ধরে রাখতে কাজ করে চলেছি। মিকি আর্থার কোচ থাকাকালীনও আমার ফিটনেস টেস্ট দেখে বলেছিলেন, "পারফর্ম করে যাও", কিন্তু এরপর কিছুই হয়নি।' ফাওয়াদের কথার সাথে কাজের মিলও পাওয়া যায়। ৩৬ ছুঁইছুঁই তাঁকে প্রথম দেখায় ২১ না ভেবে উপায় নেই।

এরপরেও তিনি দীর্ঘদিন উপেক্ষিত। এসব নিয়েই বছর তিনেক আগে পাকিস্তানের সাংবাদিক সেলিম খালিককে কিছুটা হেসে বলেছিলেন—'গুড বুকে তো নেই, ব্যাড বুকে তো অবশ্যই জায়গা হবে।' 

দীর্ঘ দশ বছর পর অবশেষে ব্যাড বুক থেকে গুড বুকে তাঁর জায়গা মিলেছে। আর জায়গা পাওয়ার প্রথম তিন ম্যাচ ভুগেছেন অবশ্য। ২০০৯ সালের পি সারা ওভালের রূপে ফিরতে সময় নিয়েছেন ডিসেম্বর ২০২০ পর্যন্ত। কিউইদের মাঠে দ্বিতীয় ইনিংসে তাঁর হার না মানা ১০২ রানের ইনিংসে বার্তা দিয়েছিলেন পুনরাবির্ভাবের। এর এক টেস্ট পর নিজ শহর করাচিতে প্রোটিয়াদের বিপক্ষে ইনিংস বাঁচানো ১০৯ রানে দাঁতভাঙা জবাব দিয়েছিলেন সকল উপেক্ষার। এরপরের সেঞ্চুরিটা গিয়ে ঠেকেছে ১৪০ রানে, জিম্বাবুয়ের বিপক্ষে। প্রত্যাবর্তনের পর ৭ টেস্টে ৩ সেঞ্চুরি!

মজার ব্যাপার হলো—তখন পর্যন্ত ক্যারিয়ারের ১০ টেস্টে সবগুলো হাফ সেঞ্চুরিকে শতকে রূপান্তর করায় হাফ সেঞ্চুরিের ঘরটা তখন পর্যন্ত শূন্য। উইন্ডিজ সফরে গিয়ে অবশেষে ক্যারিয়ারের চার সেঞ্চুরির পর প্রথম হাফ সেঞ্চুরির স্বাদ নিলেন। 

প্রত্যাবর্তনের পর প্রায় নিয়মিত হয়ে গেছে এই দৃশ্যটা

পরের টেস্টে গিয়ে আবারও হাফ সেঞ্চুরি করলেন। এবার শরীরে ব্যথা পেয়ে ধুঁকলেন খুব। রানিং বিটুইন দ্য উইকেটে বেগ পেতে হচ্ছিল। হাফ সেঞ্চুরিতেই থেমে যাবে তাঁর যাত্রা, এই আশঙ্কাও হচ্ছিল। রিটায়ার্ড হার্ট হয়ে মাঠ ছাড়লেন। পরের দিন বৃষ্টিতে পুরো দিনের খেলা পণ্ড হলে আর মাঠে নামা হয়নি। তৃতীয় দিন সুস্থ হয়ে মাঠে নেমে আর মনোযোগ হারাননি। উল্টো প্রতিপক্ষের বোলারদের নাভিশ্বাস তুলে চিরাচরিত অভ্যাস হাফ সেঞ্চুরিকে সেঞ্চুরির রূপ দিতে ভুললেন না। এরপরই বনে গেলেন এশিয়ানদের মধ্যে লাল বলের ক্রিকেটে দ্রুততম ২২ ইনিংসে পাঁচ শতকের মালিক। সেই পাঁচটি শতক আবার পাঁচটি ভিন্ন ভেন্যুতে।

জীবন আসলে এমনই। দুঃখের সাগরে ডুবিয়েও এক সময় সুখের সন্ধান জানিয়ে দিবে। ফাওয়াদের জীবন থেকে এই শিক্ষাই নিতে পারেন। তবে শর্ত আছে দুটি। পরিশ্রম করায় কখনোই অনীহা থাকলে চলবে না আর জীবনে সুযোগ এলেই তা লুফে নিতে হবে। হোক সেটা ফাওয়াদ আলমের মতো দীর্ঘ বিরতির পর।

শেয়ার করুনঃ
আপনার মন্তব্য
আরও পড়ুন
×