ইউরোপা লিগের জাদুকর

উৎপল শুভ্র নির্বাচিত পাঠকের লেখা

শাওন শেখ শুভ

২৭ মে ২০২১

ইউরোপা লিগের জাদুকর

ইউরোপা লিগের ট্রফিতে এখন উনাই এমেরির নাম খোদাই করে রাখার সময় এসেছে। ছবি: ইপিএ-ইএফই

এর আগে চারবার ফাইনাল খেলে তিনবারই জিতেছে তাঁর দল। সেই তিনবার আবার টানা তিন মৌসুমে। এবার পঞ্চম ফাইনালে চতুর্থ শিরোপা এলো ম্যানচেস্টার ইউনাইটেডের মতো দলকে হারিয়ে। ইউরোপা লিগে এমন সাফল্য নেই আর কোনো কোচের। উনাই এমেরিকে তাই `ইউরোপা লিগের জাদুকর` বলাই যায়।

উনাই এমেরি ইউরোপা লিগ বিশেষজ্ঞ! আগে সেভিয়ার হয়ে তিনবার ফাইনাল খেলে তিনবারই জিতেছিলেন শিরোপা। ইংলিশ ক্লাব আর্সেনালের হয়েও একবার ফাইনাল খেলেছিলেন। তবে সেবার শিরোপা জিততে না পারলেও সবচেয়ে বেশি, চারবার ইউরোপা লিগের ফাইনাল খেলার রেকর্ড গড়েন।

এবার ফের স্প্যানিশ ক্লাব ভিয়ারিয়ালকে ফাইনালে তুলে নিজের রেকর্ড আরও সমৃদ্ধ তো করেছেনেই, খালি হাতেও ফিরতে হয়নি ৪৯ বছর বয়সী এই কোচকে। বাইশ পেনাল্টি শুট আউটের ম্যাচে ইংলিশ ক্লাব ম্যানচেস্টার ইউনাইটেডকে হারিয়ে প্রথমবার ভিয়ারিয়ালকে ইউরোপা লিগের শিরোপা এনে দিলেন প্রতিযোগিতার ইতিহাসে সফলতম এই কোচ।

প্রতিযোগিতাপূর্ণ ফুটবলের এই যুগে, যেখানে এক বছরে জেতা যেকোনো ট্রফিই পরের বছর নিজেদের কাছে রাখা মোটামুটি অসম্ভব একটা ব্যাপার, সেখানে টানা তিন বছর ইউরোপীয় ক্লাব ফুটবলের দ্বিতীয় সর্বোচ্চ পুরষ্কার ইউরোপা লিগ জিতিয়েছিলেন সেভিয়াকে। আর এবার লিগে সপ্তম অবস্থানে থাকা ভিয়ারিয়ালকে শিরোপা জিতিয়ে নিজেকে নিয়ে গেছেন অনন্য এক উচ্চতায়।

সেভিয়ার হয়ে ইউরোপিয়ান কাপ জয়ের পর উনাই এমেরি। ছবি: এএফপিতবে কোচ হিসেবে ক্যারিয়ার সমৃদ্ধ হলেও খেলোয়াড় হিসেবে বলার মতো কিছু ছিলেন না।  লেফট মিডফিল্ডার হিসেবে ক্যারিয়ারের প্রায় পুরোটাই স্পেনের দ্বিতীয় বিভাগে কাটিয়ে দেওয়া এই ফুটবলারের ফুটবলের হাতেখড়ি পরিবার থেকেই। বাবা, দাদা – দুজনই ছিলেন ফুটবলার। খেলোয়াড়ি জীবনে ২১৫ ম্যাচে নয় গোল করা উনাই এমেরিকে মাত্র ৩২ বছর বয়সেই ইনজুরির কারণে খেলোয়াড়ি জীবনের পাট চুকিয়ে কোচিংয়ে নাম লেখাতে হয়।

সেই সুযোগটাও এসেছিল ইনজুরির কারণেই। ২০০৪ সালে উনাই এমেরি গুরুতর ইনজুরিতে পড়লে লোরকা দেপোর্তিভা ক্লাব প্রেসিডেন্ট তাঁকে কোচ হওয়ার প্রস্তাব দেন। সুযোগটা লুফে নন এমেরি। তৃতীয় বিভাগ থেকে লোরকাকে তুলে আনেন দ্বিতীয় বিভাগে। প্রথম মৌসুমেই কোপা দেল রেতে হারিয়ে দেন শীর্ষ লিগের দল মালাগাকে। বছরের সেরা কোচের স্বীকৃতি হিসেবে পেয়ে যান মিগুয়েল মুনোজ ট্রফিও।

২০০৬ সালে যোগ দেন আলমেরিয়াতে যোগ দেওয়ার পর প্রথম মৌসুমেই আলমেরিয়াকে প্রথমবারের মতো স্পেনের প্রথম বিভাগ তথা লা লিগা তে তুলে নিয়ে আসেন। লা লিগায় প্রথম মৌসুমেই এমেরির আলমেরিয়া লিগে অষ্টম, মাত্রই লা লিগায় উঠে আসা একটা দলের জন্য যা দারুণ এক অর্জন।

আলমেরিয়ার ইতিহাসের সেরা কোচ তাঁকে বলাই যায়।আলমেরিয়ার হয়ে এমেরির এই অর্জন নজর এড়ায়নি ভ্যালেন্সিয়ার। পরের মৌসুমে এমেরিকে নিয়ে আসে তারা। তিন বছরের ভ্যালেন্সিয়া অভিজ্ঞতা আরও দারুণ। ক্লাব ছেড়ে  ডেভিড ভিয়া, ডেভিড সিলভা, হুয়ান মাতার মত খেলোয়াড়েরা চলে গেলেও ভ্যালেন্সিয়াকে রিয়াল-বার্সার সাথে টেক্কা দেওয়ার মত শক্তি হিসেবে গড়ে তুলেছিলেন এমেরি।

 টানা দুই মৌসুম রিয়াল-বার্সার পরে লা লিগায় ভ্যালেন্সিয়াকে তৃতীয় স্থান এনে দিয়ে ২০১২ সালে পাড়ি জমান রাশিয়ায়, স্পার্তাক মস্কোতে। এক মৌসুম সেখানে থাকার পরই আবার ডাক আসে নিজভূমে, চলে আসেন সেভিয়ায় – ইউরোপা-কাব্য রচনার শুরু যেখানে।

সেভিয়াতে প্রতি মৌসুমেই নিজের স্কোয়াড নতুন করে সাজাতে হয়েছে তাঁকে। প্রথম ইউরোপা জয়ের পর ক্লাব ছেড়ে চলে গেলেন হেসাস নাভাস, লুইস আলবার্তো, আলভারো নেগ্রেদো, গ্যারি মেডেল ও জফ্রি কনডগবিয়া। পরের মৌসুমে কার্লোস বাক্কা, আলবার্তো মরেনো, ইভান রাকিটিচ, অ্যালেক্স ভিদাল, ফেদেরিকো ফাজিওদের। তাও এমেরির স্কোয়াডে মরচে পড়েনি মোটেও। যে-ই চলে যাক না কেন, অবশিষ্ট ও নতুনদের নিয়ে গড়া স্কোয়াডেই বারবার ছুঁয়েছেন ইউরোপা লিগ সাফল্য।

সেভিয়ার হয়ে এমন সাফল্যের পর এমেরির দিকে বড় বড় ক্লাবগুলোর নজর পড়াই স্বাভাবিক। বড় স্বপ্ন দেখতে থাকা পিএসজি এমেরির মধ্যেই দেখে সেই স্বপ্ন পূরণের সারথিকে। ২০১৬ সালে তাই এমেরির ঠিকানা হয়ে যায় প্যারিস। চ্যাম্পিয়নস লিগে সাফল্য না পেলেও লিগ শিরোপাসহ দুই মৌসুমে পিএসজিকে জেতান ৭টি ট্রফি। কিন্তু চ্যাম্পিয়নস লিগ জিততে না পারায় সেই অধ্যায়ও শেষ হয়। 

এমেরি যোগ দেন আর্সেনালে। টানা ২২ ম্যাচ অজেয় থাকলেও শেষ পাঁচ ম্যাচের ব্যর্থতায় গানাররা লিগ শেষ করে পয়েন্ট টেবিলের পাঁচ নম্বরে। তবে ঠিকই ওঠে ইউরোপা লিগের ফাইনালে। এই একবারই ইউরোপা লিগের ফাইনালে গিয়েও শিরোপা ছোঁয়া হয়নি উনাই এমেরির। কাল রাতে ভিয়ারিয়ালের হয়ে এবারের শিরোপা জয় হয়তো সেই কষ্টে প্রলেপ বুলিয়ে দিয়েছে।

উনাই এমেরি কোচ হিসেবে ভিডিও ক্লিপস পদ্ধতির  অনেক ভক্ত। এতটাই ভক্ত যে তিনি তাঁর ক্লাবের কোচিং স্টাফে কোন ভিডিও অ্যানালিস্ট রাখেন না, নিজের দলের জন্য প্রয়োজনীয় ভিডিও ক্লিপস তিনি নিজেই তৈরি করেন। ভিডিও কাটা, জোড়া লাগানো, এডিট করা–সব কাজ খেটেখুটে এই এমেরিই করেন, আর ঘন্টার পর ঘন্টা সেগুলো দেখতে হয় খেলোয়াড়দের!

ভিডিও অ্যানালিস্টের কাজটা নিজেই করেন উনাই এমেরি।  ছবি: আর্সেনালের অফিসিয়াল সাইটএমেরির অধীনে ভ্যালেন্সিয়ায় খেলা সাবেক স্প্যানিশ উইঙ্গার জোয়াক্যুইন যেমন একবার বলেছিলেন, “আমার পপকর্ন শেষ হয়ে যায়, কিন্তু এমেরির ভিডিও আর শেষ হয় না!”

ভ্যালেন্সিয়ায় থাকতে একবার এমেরির সন্দেহ হয়েছিল সেন্টারব্যাক জেরেমি ম্যাথিউ তাঁর ভিডিও ক্লিপস গুলো দেখছেন না। সেটা ধরার জন্য একবার ম্যাথিউকে খালি পেনড্রাইভ দেন এমেরি, পরেরদিন সকালে ম্যাথিউ ঠিকই এসে বলে যান তিনি ভিডিও দেখেছেন। ফলাফল, ঝাড়ি!

এমেরির সাফল্যের মূল রেসিপি সম্ভবত খেলোয়াড়দের ওপর অগাধ বিশ্বাস রাখা, তাঁর তুখোড় ম্যান ম্যানেজমেন্ট। 

ভক্তদের সাথেও উনাই এমেরির সম্পর্ক বেশ দারুণ। ভদ্রলোকের নিজের ওয়েবসাইটে তিনি নিয়মিত ফুটবল ট্যাকটিকস ও জীবনদর্শন নিয়ে বিভিন্ন লেখা লেখেন। প্রায়ই দর্শকের জন্য রাখেন কুইজ ও পুরষ্কার।

ম্যানচেস্টার ইউনাইটেডের বিপক্ষে এবারের ফাইনালে নাটকীয় জয়, এর আগে সেমিফাইনালে সাবেক দল আর্সেনালকে হারানো...সব মিলিয়ে উনাই এমেরির কাছে এই ইউরোপা লিগটার মাহাত্ম্য একটু বেশিই হওয়ার কথা।

তাঁর আগের পরিচিতিটাই আরও বেশি ঔজ্জ্বল্য পেল সর্বশেষ এই সাফল্য। ইউরোপা লিগের জাদুকর! 

সম্পর্কিত বিষয়:

শেয়ার করুনঃ
আপনার মন্তব্য
আরও পড়ুন
×