গল্পটা এদুয়ার্দ মেন্ডির, গল্পটা বেকারত্ব থেকে বিশ্বজয়ের

উৎপল শুভ্র নির্বাচিত পাঠকের লেখা

রাইসান কবির

৩ জুন ২০২১

গল্পটা এদুয়ার্দ মেন্ডির, গল্পটা বেকারত্ব থেকে বিশ্বজয়ের

এদুয়ার্দ মেন্ডি, চেলসির গোলবারের অতন্দ্র প্রহরী।

এজেন্টের বিশ্বাসঘাতকতায় এক সময় বেকার হয়ে পড়েছিলেন তিনি। পুরো এক মৌসুম খেলেছেন বিনা পয়সায়! দুঃখ-হতাশায় ফুটবলটাও ছেড়ে দেওয়ার কথা ভেবেছিলেন যে এদুয়ার্দ মেন্ডি, সেই তিনিই দিনকয়েক আগে উয়েফা চ্যাম্পিয়নস লিগ শিরোপা এনে দিলেন চেলসিকে। এই সুযোগে মেন্ডির শূন্য থেকে শিখরে ওঠার গল্পটা লিখে পাঠালেন এক পাঠক।

এদুয়ার্দ মেন্ডিকে চেনেন? ২ বছর আগেও এই প্রশ্নটার 'হ্যাঁ' বোধক উত্তর দিতে পারা মানুষ হয়তো খুঁজেই পাওয়া যেত না। কিন্তু ঠিক এখন ইউরোপিয়ান ফুটবল অনুসরণ করেন, অথচ এই ভদ্রলোককে চেনেন না এমন লোক খুঁজে পাওয়াটাই হয়তো বেশ কঠিন। সদ্য চেলসির হয়ে চ্যাম্পিয়নস লিগ জিতেছেন গোলকিপার এদুয়ার্দ মেন্ডি। কিন্তু এই মেন্ডির এই পর্যন্ত আসার পেছনে আছে বহু সংগ্রাম, আক্ষেপ আর সুখ-দুঃখের গল্প। 

১৯৯২ সালের মার্চ মাসের প্রথম দিন। সেদিনই ফ্রান্সে অভিবাসী মা-বাবার ঘরে পৃথিবীর আলো দেখেন এদুয়ার্দ মেন্ডি। অভিবাসী পরিবার হওয়া সত্ত্বেও পারিবারিক অবস্থা দারিদ্র্যে জর্জরিত ছিল না। মোটামুটি মধ্যবিত্ত এক পরিবারেই ভাই-বোনদের সাথে বেড়ে উঠতে থাকলেন মেন্ডি। নিজের চলার পথে তাই পরিবারের সহায়তাটা মেন্ডি পেয়েছেন ছোট থেকেই। 

বাচ্চা ছেলে মেন্ডির ফুটবলের ভালোবাসায় পড়ে যেতে খুব একটা বেশি সময় লাগেনি। পাশাপাশি ফুটবলকেই সারাজীবনের ধ্যান-জ্ঞান বানিয়ে ফেলার স্বপ্নও দেখতেন রোজ। ৭ বছর বয়সী মেন্ডির ফুটবলে হাতেখড়ির জন্য বাবা-মা ভর্তি করে দেন স্থানীয় ক্লাব লে হাভ্রের একাডেমীতে। মেন্ডির ছোটবেলার আইডলদের মধ্যে ছিলেন গোলকিপার ফ্যাবিয়ান বার্থেজসহ অনেকেই। গোলকিপিংয়ের বেসিক আয়ত্তে আনার জন্য লে হাভ্রে অ্যাথলেটিক ক্লাবেও যোগ দেন কিছুদিন পরেই। ভালো পারফরম্যান্স থাকা সত্ত্বেও ক্লাবের ফার্স্ট চয়েজ গোলকিপার হতে পারছিলেন না মেন্ডি, কারণ সে জায়গাটায় ছিলেন আরও বেশি প্রতিভাবান জাকারি বাউচার। 

মেন্ডি তাঁর জীবনে ধাক্কা খেয়েছেন আরও অনেকবারই। নিজের পেশাদার ক্যারিয়ারের শুরুটা করেছিলেন এএস শারবার্গের হয়ে। সেখানেও খাপ খাওয়াতে পারছিলেন না কোনোক্রমেই, পর্যাপ্ত সুযোগ পান নি। ২০১৪ সালের দিকে ক্লাবের সাথে চুক্তি শেষ হয় মেন্ডির। আশেপাশের অনেক ক্লাব থেকে অফার থাকলেও মেন্ডির নজর ছিল ফ্রান্সের বাইরের কোনো ক্লাবে থিতু হওয়ার দিকে।  মেন্ডির তখনকার এজেন্ট নিশ্চয়তা দেন নতুন একটা চুক্তি হয়তো হয়েই যাবে। পরবর্তীতে সেই এজেন্টের ধোঁকাতেই নতুন কোনো চুক্তি সই করা হলো না মেন্ডির। বারবার যোগাযোগ করা হলেও এজেন্ট দিচ্ছিলেন না প্রত্যুত্তর, মেন্ডির প্রতি এজেন্টের মেসেজ কেবল ছিল তাঁর ভবিষ্যৎের জন্য শুভকামনা জানানো, ব্যস এটুকুই। আর এদিকে যেন জীবনের চরম দুরাবস্থায় পৌঁছে গেলেন মেন্ডি। ২২ বছর বয়সে বেকার হয়ে যাওয়া মেন্ডি ভুগছিলেন হতাশা আর মানসিক অস্থিরতায়। শৈশবে মেন্ডি। ছবি: লাইফব্লগার

যাই হোক, সেই মেন্ডিকে নর্দান ফ্রান্সে চাকরি প্রত্যাশীদের সাথেও লাইনে দাঁড়াতে হলো। প্রায় এক বছর ফুটবল থেকে দূরে কাটানো মেন্ডি যেন চিরতরে বিদায় বলে দিতে চাইছিলেন ফুটবলকে। তবে বরাবরের মতই জীবনের এই কঠিন সময়টাতে পরিবারকে পাশে পেয়েছিলেন মেন্ডি। সবার অনুপ্রেরণা আর উৎসাহ ছিল মেন্ডির সাথে। আর পরামর্শ ছিল, শেষবারের মতো ফুটবলকে নিয়ে চেষ্টা করে দেখা। কে জানে, সফলতা তো আসতেও পারে এবার। মেন্ডি তাদের কথা রেখেছিলেন, শেষবারের মত চেষ্টা চালালেন ফুটবলে। 

মেন্ডি এবার ফিরে গেলেন শেকড়ে, লে হাভ্রেতে। যেখানে ফুটবলের হাতেখড়ি হয়েছিল মেন্ডির। হাভ্রেতে কোনো প্রকার বেতন কিংবা টাকাপয়সা ছাড়াই আবার খেলা শুরু করেন মেন্ডি। হ্যাঁ, ঠিকই পড়েছেন, বিনে পয়সায়! বিনে পয়সাতেই টানা এক বছর ক্লাবের হয়ে খেলা চালিয়ে গেলেন মেন্ডি। অবাক করার মতো ব্যাপার হলেও এটাই সত্যি। 

হঠাৎ একদিন মেন্ডির কাছে খবর এল, মার্শেইর রিজার্ভ বেঞ্চের জন্য গোলকিপার দরকার। ক্লাবের অ্যাপ্লাই আর ট্রায়াল প্রসেস পাশ করে মার্শেইর চতুর্থ পছন্দের গোলকিপার হিসেবে মেন্ডি যোগ দিলেন ক্লাবটায়। যাই হোক, এখানেও ফার্স্ট চয়েজের গোলকিপারের সাথে টেক্কা দেওয়াটা ছিল যথেষ্ট কষ্টসাধ্য। নিজের সামর্থ্যকেও ছাড়িয়ে যাওয়ার মতো শক্তি সঞ্চয় করছিলেন তিনি, যার ফলে খুব দ্রুতই নিজেকে নিয়ে যাচ্ছিলেন নতুন উচ্চতায়।

মেন্ডি খেলেছেন রেনেঁতেও। ছবি: এএফপি

নিয়মিত খেলার সুযোগের অপেক্ষাতে থাকা মেন্ডি সেকেন্ড ডিভিশন লিগ 'টু' এর দল রেইমসে নাম লেখান ২০১৭-১৮ মৌসুমে। ক্লাবকে প্রথম ডিভিশন লিগ 'ওয়ান'-এ প্রমোটেড করার আগ পর্যন্ত নিজের সর্বোচ্চটাকেই উজাড় করে দিয়েছেন মেন্ডি। পরে ক্লাব ছেড়েছেন রেনেঁ এর উদ্দেশ্যে। 

রেনেঁতে গিয়েই যেন সুপারসনিক গতিতে উন্নতি হতে থাকল মেন্ডির। ক্লাবকে তৃতীয় করলেন লিগে, চ্যাম্পিয়নস লিগে খেলার যোগ্যতাও অর্জন করল দল। চারদিকে ছড়িতে পড়তে লাগল মেন্ডির সুনাম। প্রশংসায় পঞ্চমুখ হয়ে যান পিওতর চেক আর ল্যাম্পার্ডের মত লেজেন্ডরা। চেকেরই পরামর্শে ল্যাম্পার্ড চেলসিতে নিয়ে আসেন মেন্ডিকে। আর তার পরের গল্পটা তো একদমই তরতাজা। চেলসির চ্যাম্পিয়নস লিগ জয়ে মৌসুম শেষ হয়েছে, যেখানে তিন কাঠির নিচে দারুণ পারফরম্যান্সে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছেন মেন্ডি। মৌসুমজুড়ে ৪৬ ম্যাচের মধ্যে ক্লিনশীট রেখেছেন ২৬টিতে। প্রিমিয়ার লিগে ৩১ ম্যাচের ১৬টা আর চ্যাম্পিয়নস লিগে ১২ ম্যাচের ৯টাতেই অক্ষত ছিল গোলপোস্ট। মূলত চেলসির গোলকিপার কেপার দৃষ্টিকটু ভুলগুলোর কারণেই তাঁর স্থলাভিষিক্ত করার জন্য কিনে আনা হয় মেন্ডিকে। মেন্ডি আস্থার প্রতিদান দিয়েছেন একেবারে দু'হাত ভরে।

দক্ষ হাতে চেলসির গোলপোস্ট সামলেছেন মেন্ডি। ছবি: এএফপি

খুব সম্ভবত জীবনের সুন্দরতম সময়টা পার করছেন মেন্ডি। এজেন্টের বিশ্বাসঘাতকতায় এক সময় বেকার হয়ে পড়া মেন্ডিই এখন চ্যাম্পিয়নস লিগজয়ী গোলকিপার। মেন্ডির জীবনটা হয়তো একটু বেশিই সুন্দর! মেন্ডি পারফরম্যান্সের ধারাবাহিকতা বজায় রাখতে পারেন কি না সেটাই এখন দেখার ব্যাপার। মেন্ডির ভবিষ্যৎের জন্য থাকল অনেক শুভকামনা। 

শেয়ার করুনঃ
আপনার মন্তব্য
আরও পড়ুন
×