উৎপল শুভ্র নির্বাচিত পাঠকের লেখা

`বাংলা উইলো`র অপেক্ষায়

আবু হায়াত রিয়াদ

৫ জুন ২০২১

`বাংলা উইলো`র অপেক্ষায়

বাংলাদেশের ক্রিকেটে কান পাতলে কেবল `নেই` `নেই`-এর হাহাকার। ভালো উইকেট নেই, পেশাদারিত্ব নেই, নতুন সাকিব-তামিম-মুশফিক নেই। ফ্লোরিডা প্রবাসী এক পাঠক লিখে পাঠালেন, বাংলাদেশে তো ক্রীড়া সরঞ্জামাদি প্রস্তুতকারক প্রতিষ্ঠানও নেই, আমাদের মতো দেশের খেলাধুলায় এগিয়ে যাওয়ার জন্য যেটি খুব দরকারি। পাঠকের পরিচয়টাও দেওয়া উচিত, অনূর্ধ্ব-১৭ দলে তামিম ইকবালের ওপেনিং পার্টনার ছিলেন তিনি।

টি-টোয়েন্টির এই যুগে বিশ্বের সাথে তাল মিলিয়ে বাংলাদেশেরও অবস্থা একেবারে রমরমা। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে এর বাজার আরও সম্প্রসারিত এবং আমরা প্রতিদিনই টক শো করে করে একেবারে ফাটিয়ে ফেলছি। দীর্ঘ সংস্করণের ম্যাচ নেই, ভালো উইকেট নেই, পেশাদারিত্ব নেই; বেতন মোটামুটি ভালো হলেও, ঠিক বিশ্বমানের নয়! পাইপলাইনে নতুন সাকিব-মুশফিক-তামিম নেই, ভালো মানের পেসার নেই....আরও কত কত সমস্যা আমাদের। আমি গভীরভাবে লক্ষ্য করে দেখলাম, একটা জিনিস নিয়ে আমাদের কারও কোনো মাথাব্যথা নেই। আমরা অবকাঠামো নিয়ে এক হাজার একটা কথা বলার পরও একটা জিনিস এড়িয়ে যাই।  

ব্যাপারটা আসলে খানিকটা লজ্জার। আমরা প্রায় দুই যুগের কাছাকাছি টেস্ট ক্রিকেট খেলে ফেললেও আমাদের দেশীয় কোনো ব্র্যান্ড নেই ক্রিকেট সরঞ্জাম তৈরী করার। নেই কোনো কারখানা, নেই কোনো পরিকল্পনা। নেই মানে নেই! 

আমরা ৭৫% ভারতের উপর নির্ভরশীল। বাকিটা আসে পাকিস্তান, ইংল্যান্ড, অস্ট্রেলিয়া এবং অন্যান্য দেশ থেকে। আমাদের সেরা খেলোয়াড়েরা তো তাদের সরঞ্জাম স্পন্সরশীপ থেকেই পেয়ে থাকেন। কিন্তু বাকিদের অবস্থা তথৈবচ। অনেক হাত ঘুরে, চড়া ট্যাক্স পরিশোধ করে ক্রিকেটারদের হাতে আসতে আসতে ওসব জিনিসের দাম অনেক অনেক বেড়ে যায়। বিশ্বাস না হলে এক কাজ করুন, ভারতীয় কোনো ওয়েবসাইটে গিয়ে একটা ভালো ব্যাটের দাম দেখুন এবং বাংলাদেশে ব্যাটটার বাজার দর দেখুন। আমি নিশ্চিত আপনি অবাক হবেন। ন্যায্য লাভ হিসাব করার পরও।

আমাদের দেশেও হতে পারে বিশ্বখ্যাত কোনো স্পোর্টস ব্র‍্যান্ডের কারখানা। ছবি: লেখক

এবার আমার কথা বলি। আমার নাম আবু হায়াত রিয়াদ। বর্তমানে ফ্লোরিডাতে থাকি। দেশ ছেড়েছি আজ থেকে এক যুগ আগে। দেশে থাকতে আমার অল্প কিছু ক্রিকেট খেলার সৌভাগ্য হয়েছে। খুব অল্প বয়সে ক্রিকেট ছেড়েছি বলেই হয়তো আমার প্রচন্ড একটা টান থেকে গেছে খেলাটার প্রতি। ব্যাংকিংকে পেশা হিসেবে নিলেও আমি ব্যাট-বলের নেশায় এখনো মেতে উঠতে ভালোবাসি। আমি সবসময় চেয়েছিলাম ক্রিকেটের সাথে লেগে থাকতে। ওই উদ্দেশ্য থেকেই ২০১৬ সালে শুরু করি আমার ব্যবসা প্রতিষ্ঠান গুড বাই ইনকরপোরেশন। ছোট্ট সামর্থ্য নিয়েই। আমাদের এই কয় বছরে সৌভাগ্য হয়েছে চট্টগ্রাম বিভাগীয় দল, খুলনা টাইটান্স, চিটাগং ভাইকিংস, সাউদার্ন ইউনিভার্সিটি, প্রিমিয়ার ইউনিভার্সিটি, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় ইত্যাদি দলের সাথে কাজ করার। আমরা বিদেশি সরঞ্জাম আমদানি করি। ভালো সরঞ্জামের দাম অনেক। খাঁটি জিনিস কেনাটা সব সময়ই চ্যালেঞ্জিং। মার্জিন খুব বেশি থাকে না। তার ওপর আছে প্লেয়ারদের বাকিতে সরঞ্জাম বিক্রির ঝামেলা। সব মিলিয়ে যেখানে যাবার স্বপ্ন ছিল, এখনো পৌঁছানো হয়নি। 

কিন্তু আমার প্রশ্ন হলো, আমার না হয় সামর্থ্য নাই নিজেদের জিনিস বানিয়ে বিক্রি করার। আমাদের দেশের বড় শিল্প প্রতিষ্ঠান যেগুলো আছে, তাদের কীভাবে এত বড় একটা বাজার চোখ এড়িয়ে যায়? আমি এক সময় ভাবতাম, আমি নিজেই একদিন এরকম কিছু করে সবাইকে চমকে দিয়ে অনেক পয়সাওয়ালা হয়ে যাব! কিন্তু আমার ইদানিং ভয় হয় যে, কেউ হয়তো কোনোদিন করবেই না! ভালো ক্রিকেট খেলতে ভালো সরঞ্জামের কোনো বিকল্প নাই। ক্রিকেট বড়লোকের খেলা, এই টার্মটা একসময় খুব প্রচলিত ছিল। আমরা যুগের পর যুগ কষ্ট করে একে সাধারণ মানুষের খেলা বানিয়েছি। আমাদের তাই সময় এসেছে নিজেদের পণ্য, নিজেদের ব্র্যান্ড বাজারে এনে সাধারণ মানুষের জন্য ক্রিকেট খেলাটা সহজ করে দেয়া। যেকোনো কর্পোরেট প্রতিষ্ঠান এগিয়ে এলেই আমি আমার জ্ঞান বিনামূল্যে দিতে রাজি আছি। কেউ অন্তত কাজটা করতে শুরু করুন প্লিজ। 

বল বানানো দিয়ে উদাহরণ দিতে পারি যে, এটা ব্যবসায়িকভাবে কতখানি লাভজনক। আমরা বেশির ভাগ বল ভারত-পাকিস্তান থেকে কিনে আনি। ট্যাক্স এবং ট্রান্সপোর্টেশন খরচ দেয়ার পর একটা সাধারণ মানের প্র্যাকটিস বলের দাম পড়ে যায় ৩০০ টাকার বেশি। বল বানাতে কী কী লাগে জানেন? চামড়া, সুতা, রং, গ্লু আর মাঝখানে একটা কর্ক! হ্যাঁ, এটা সত্যি যে বল বানাতে যথেষ্ট মুনশিয়ানার প্রয়োজন। এখন সমাধান দুটি। সম্পূর্ণ মেশিনে তৈরি করা (সিমের সেলাইটুকু বাদে), অথবা ভারত-পাকিস্তান থেকে কারিগর এনে দেশে প্রশিক্ষণ দেওয়া। দুটার একটাও কঠিন কিছু না। একটু খোঁজ রাখলেই জানতে পারবেন, বাংলাদেশে প্রতিদিন কত হাজার বল লাগছে। সব টাকা বিদেশে চলে যাচ্ছে! আমাদের কতগুলো লোকের কর্মসংস্থান হতো, একবার ভেবে দেখুন।

বল বানানোর উপাদানগুলো খুবই সহজলভ্য, অথচ বাইরে থেকে আমদানি করতে গিয়ে খরচ পড়ে কমপক্ষে ৩০০ টাকা। ছবি: লেখক

ক্রিকেট ব্যাট তৈরি হয় উইলো কাঠ দিয়ে। দুই ধরনের উইলো বিখ্যাত, ইংলিশ এবং কাশ্মীরি। মজার ব্যাপার হলো, এই কাশ্মীরি উইলো আসলে ইংরেজদের সঙ্গে করে নিয়ে আসা উইলো গাছের ভারতীয় সংস্করণ। প্রশ্ন হলো, আমাদের 'বাংলা উইলো' কেন হবে না? অন্তত চেষ্টা তো করতে পারি আমরা। একই কথা খাটে অন্যান্য সরঞ্জামের ক্ষেত্রেও। গার্মেন্টস শিল্পে যে দেশ এত ভালো, আমার তো ধারণা ক্রীড়া সরঞ্জামেও বিশ্বের সেরা ব্র্যান্ডগুলোর একটি হতে পারব আমরা, যদি চেষ্টা করি আর কি।

আমরা একেকটা বোলিং মেশিন নিয়ে আসি ইংল্যান্ড থেকে, ধরন বিশেষে যেগুলো আড়াই লাখ থেকে পাঁচ লাখ টাকা পর্যন্ত হয়। আমার ধারণা, বুয়েট পর্যন্ত যাওয়া লাগবে না, জিঞ্জিরাতে একটা বোলিং মেশিন নিয়ে ঢুকলে ওরা অবিকল আরেকটা বানিয়ে দেবে। এবং সেটা যথেষ্ট কাজে দেবে। একটা বোলিং মেশিন বানাতে কত খরচ হয়, শুনলে হাসবেন।

দিন-রাত ২৪ ঘণ্টা টিভিতে আরএফএল প্লাস্টিকের বিজ্ঞাপন দেখতে দেখতে চোখ-কান ঝালাপালা। এক সাধারণ প্লাস্টিক মোল্ড দিয়ে ক্রিকেটের কত প্রস্তুতির সরঞ্জাম হয়, ভাবাই যায় না। ইদানিং তো শুরু হয়েছে কাকলি ফার্নিচার নিয়ে লোকজনের ট্রল আর ট্রল। কিন্তু মানে ভালো দামে কম অনেক সরঞ্জামই আসলে দেশি একটা প্লাটফর্মে আরামসে বানিয়ে বাজারটা অনেকখানি মধ্যবিত্তের হাতের নাগালে নিয়ে আসা যেত। অথচ সবকিছু আসে বাইরে থেকে।

বাংলাদেশ-ইংল্যান্ড সিরিজ হচ্ছে ইংল্যান্ডে, একবার ভাবুন তো, ইংলিশ দুই ওপেনার বাংলা উইলোর ব্যাট হাতে খেলতে নামছেন। তাদের পোশাক এবং অন্যান্য সরঞ্জামেরও সিংহভাগ বাংলাদেশে তৈরি। সুক্ষ্মভাবে চিন্তা করলে, আমাদের খেলোয়াড়দের জন্যও তো এটা হবে একটা বাড়তি ভালো লাগার জায়গা। 

সেদিন দেব চৌধুরীর সাথে খালেদ মাসুদ পাইলটের সাক্ষাৎকার দেখছিলাম। পাইলট আক্ষেপ করে বলছিলেন, এখন আসলে সব বাবা মা যেভাবে নিজেদের বাচ্চাদের ক্রিকেট খেলাতে চান, সেভাবে আসলে এফোর্ড করতে পারেন না। সে কারণে অনেকে শুধু ভালো সরঞ্জামের অভাবে অকালে ঝরে যায়। একটা ভালো ব্যাট ছাড়া তো আসলে একটা ভালো ছয় মারা যায় না। যতই টাইমিং বলে বলে চিৎকার করুন, আধুনিক ক্রিকেটে ব্যাট নিজেই অনেক রান করে দেয়। প্র্যাকটিসের যথাযথ সরঞ্জাম এবং খেলার অন্যান্য আনুষঙ্গিক জিনিসপাতি তাই খুবই জরুরি। একটু ভাবুন, একটা ১০০ রানের ইনিংসে ব্যাটসম্যানকে এসব প্যাড-গ্লাভস পরে কতখানি দৌড়াতে হয় এবং কতখানি সময় এগুলোর সাথে থাকতে হয়। 

আমাদের দেশে এই জায়গাগুলোতে কাজ করা আসলেই জরুরি। বাইরের কেউ সহজে এই ব্যবসায় আসবে না। ক্রিকেটের কাউকেই করতে হবে। অন্তত যার খানিকটা পেশাদার অভিজ্ঞতা আছে। আমি সুদিনের অপেক্ষায় আছি। একদিন না একদিন বাংলা উইলো হবেই হবে।

শেয়ার করুনঃ
আপনার মন্তব্য
আরও পড়ুন
×