ক্রিকেট কি শুধু ব্যাটসম্যানরাই খেলে?

উৎপল শুভ্র নির্বাচিত পাঠকের লেখা

শাওন শেখ শুভ

৭ জুন ২০২১

ক্রিকেট কি শুধু ব্যাটসম্যানরাই খেলে?

যুগটা ব্যাটিং বান্ধব উইকেট, বাউন্ডারির ছোট সীমানা, কুইক আউটফিল্ড, ফিল্ড রেস্ট্রিকশন, ভারি ব্যাট আর ফ্রি হিটের। দর্শকরাও দেখতে চায় চার-ছক্কার ফুলঝুরি। কিন্তু ব্যাটিংয়ের দিকেই সমস্ত দৃষ্টি আটকে আমরা ক্রিকেটের সত্যিকারের স্বাদটা হারিয়ে ফেলছি না তো! ব্যাট-বলের সমানে সমান লড়াইটাই যদি না থাকে, তবে ক্রিকেটের সৌন্দর্যটা কীভাবে বজায় থাকবে, এই লেখায় সেই প্রশ্নই তুললেন এক পাঠক।

২০১৯ বিশ্বকাপ ফাইনাল। মুখোমুখি ইংল্যান্ড-নিউজিল্যান্ড। নির্ধারিত ওভার শেষে ম্যাচ গড়াল সুপার ওভারে। সুপার ওভারেও দুই দল সমানে সমান। আইসিসির নিয়মানুযায়ী বাউন্ডারির হিসেবে জয় পেল ইংল্যান্ড। আপত্তিটা এই নিয়মেই! কেন বাউন্ডারির হিসেবেই জয়-পরাজয় নির্ধারিত হবে, ফলাফল উইকেটের বিচারে নির্ধারিত হলে ক্ষতি কী? উইকেটের বিচারে নির্ধারিত হলে সেদিন কিন্তু জয় পেত নিউজিল্যান্ড।

অবশ্য জয়-পরাজয় নিয়ে হিসেব কষা আজ আমার উদ্দেশ্য নয়। ক্রিকেট যে দিনে দিনে ব্যাটারস্ গেমে পরিণত হচ্ছে, এটা শুধুমাত্র তার একটা উদাহারণ।

সর্বকালের সেরা ক্রিকেটার কে--এমন প্রশ্নে নাম শোনা যায় শচীন টেন্ডুলকার,ডন ব্র‍্যাডম্যান কিংবা ভিভ রিচার্ডসের। অথচ সর্বোচ্চ উইকেটশিকারি মুত্তিয়া মুরালিধরনের নাম একবারও শোনা যায় না। শোনা যায় না ওয়াসিম আকরাম, গ্লেন ম্যাকগ্রা কিংবা ওয়ার্নের নামও। কিন্তু ইমপ্যাক্টের দিক বিচার করতে গেলে দেখা যায়, অনেক অনেক সেঞ্চুরির থেকে এগিয়ে থাকে ৫ উইকেট নেওয়া পারফরম্যান্স।

কিন্তু ব্যাটিং বান্ধব উইকেট, বাউন্ডারির ছোট সীমানা, কুইক আউটফিল্ড, ফিল্ড রেস্ট্রিকশন, ভারি ব্যাট, ফ্রি হিটের যুগে খেলা এক বোলার যখন মানকাডিং আউট করে, তখন আসে ক্রিকেটীয় চেতনার প্রশ্ন। বোলিং বান্ধব উইকেট হলেই বিশ্লেষকরা প্রশ্ন তোলেন পিচের মান নিয়ে। অথচ বেশির ভাগ পিচেই বোলারদের জন্য থাকে না কিছুই। লিমিটেড ওভার ক্রিকেটে নতুন বল সুইং করে খুব বেশি হলে ৪-৫ ওভার। যার ফলে লড়াইটা এখন ব্যাটার বনাম ব্যাটারের মধ্যেই বেশি হয়।

ব্যাট-বলের  দ্বৈরথ থেকে শুধু যে দর্শকরাই বঞ্চিত হচ্ছেন, তা-ও নয় কিন্তু। বঞ্চিত হচ্ছে ব্যাটাররাও। এজন্যই হয়তো বিরাট কোহলিকে সেরা বলার আগে অনেকেই দোনামনা করেন, কোহলি যে ওয়াসিম আকরামকে খেলেনি! টি টোয়েন্টি ক্রিকেটে একজন বোলার সর্বোচ্চ ৪ ওভার বল করতে পারেন। এমন যদি হতো, একজন ব্যাটার সর্বোচ্চ ৩০ বল খেলতে পারবে! এমন হওয়া উচিত তা বলছি না, একবার ভাবুন শুধু।

সে যুগের ভিভ রিচার্ডস, ক্লাইভ লয়েডদের নাম আমাদের মুখে মুখে; কিন্তু জেফ থমসনকে আমরা ক`জন চিনি!

দায় আমাদের দর্শকদেরও আছে। আমরা দর্শকরাও প্রতিনিয়ত বোলারদের নিরুৎসাহিত করছি। আমরাও ক্রিকেটটা বুঝতে চাই ব্যাটারের দৃষ্টিভঙ্গি থেকে। একজন রোহিত শর্মার ২৬৪ রানের ইনিংস আপনি কখনোই ভুলবেন না, কিন্তু চামিন্দা ভাসের ১৯ রানে ৮ উইকেট নেওয়া ম্যাচের কথা মনে আছে কি? আদৌ  কি জানার ইচ্ছে হয়েছে, ওয়ানডের সেরা বোলিং স্পেলটা কার দখলে? ব্রায়ান লারার ৪০০ রানের ইনিংসের মাহাত্ম্য তো সবাই জানি, কিন্তু এক টেস্টে ১৯ উইকেট নেওয়া জিম লেকারকে কি চিনি? টেস্টে ৫০০ উইকেট নেওয়া স্টুয়ার্ট ব্রড যতটা না আমাদের আলোচনায় আসে, তার চেয়ে যুবরাজের কাছে ছয় ছক্কা খাওয়া ব্রডকে আলোচনায় আনতে আমরা বেশি পছন্দ করি। এমনকি হালের রাবাদা,মোস্তাফিজ, বুমরারাও কি যথেষ্ট মূল্য পাচ্ছেন, যা তাদের পাওয়া উচিত? এত কিছুর পর আর যাই হোক, আমরা ওয়াসিম আকরাম, ম্যাকগ্রাকে এ যুগে পাওয়ার কথা ভাবতে পারি না।

এটা অস্বীকার করার উপায় নেই, একজন বোলার ম্যাচে পারফর্ম করার অনেকগুলো সুযোগ পায়, অন্য দিকে ব্যাটার সুযোগ পায় মাত্র একটি।এটাই তো ক্রিকেটের আসল সৌন্দর্য। তাই বলে কি ক্রিকেট সংশ্লিষ্ট সবাইকেই একটা পক্ষকে বেশি সুবিধা দিতে হবে?

রোমাঞ্চকর দ্বৈরথ তখনই হয়, যখন দুটো পক্ষই থাকে সমানে সমান। অবশ্যই দরকার লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড। আর সেটা নিশ্চিত করতে হবে ক্রিকেট সংশ্লিষ্ট সবাইকে। আমাদের মনে রাখা উচিত, 'হেডস ইজ অ্যাজ ইম্পরট্যান্ট অ্যাজ টেলস'।

সম্পর্কিত বিষয়:

শেয়ার করুনঃ
আপনার মন্তব্য
আরও পড়ুন
×