মানুষ প্রিয় দলের জন্য এভাবে কাঁদে কেন?
উৎপল শুভ্র নির্বাচিত পাঠকের লেখা
আর্জেন্টিনা বিশ্বকাপের গ্রুপ পর্ব থেকেই বাদ পড়ার পর সমর্থকদের কান্না দেখে মাধ্যমিকে পড়া যে কিশোর মহা বিস্মিত হয়েছিল, কোথাকার কোন দল হেরে গেছে, ওরা কাঁদছে কেন? এক যুগ পর আরেকটি বিশ্বকাপের ফাইনালে আর্জেন্টিনা হারার পর সেই কিশোরের চোখেই অঝোর বর্ষণ।
২০০২ বিশ্বকাপ চলছে। মাধ্যমিকে পড়া আমি তেমনভাবে কোনো দলকেই চিনি না। সাদা-কালো টিভিতে চলা খেলায় আমি বাবাকে জিজ্ঞেস করলাম 'আব্বা, কার কার খেলা?'
বাবা বললেন, 'আর্জেন্টিনা আর সুইডেন খেলে।'
বলেই উনি বের হয়ে গেলেন। আমি খানিকক্ষণ খেলা দেখে ঘুমিয়ে পড়লাম। রাতে ঘুম থেকে উঠছি। কে হারল, কে জিতল তা নিয়ে আমার মাথাব্যথা নাই। ঘুম থেকে উঠে দেখি আম্মা টিভিতে খবর দেখছেন। ও্ই মুহূর্তে দেখলাম একজন রিপোর্টার মানুষের সাক্ষাৎকার নিচ্ছেন। আর্জেন্টিনা ড্র করে গ্রুপ পর্ব থেকে বাদ পড়েছে বলে সমর্থকরা ব্যথিত। তাদের সে কী কান্না! আমি ভাবছিলাম, কোথাকার কোন দল হেরে গেছে, মানুষ এভাবে কাঁদছে কেন? এরপর ঐ টুর্নামেন্টে টুকটাক খেলা দেখেছি। তখন ব্রাজিল বিশেষত রোনালদো মানেই একটা ক্রেজ। একের পর গোল করে যাচ্ছেন আর ছিল সেই বিখ্যাত চুলের কাট! কিন্তু আমার মন পড়ে ছিল ওখানেই, মানুষগুলো কাঁদছিল কেন?
এরপর এলো ফাইনাল। জার্মান-দুর্গ জয় করে ব্রাজিল বিশ্ব চ্যাম্পিয়ন এবং যথারীতি রোনালদো হিট। আমি ততদিনে প্রথম আলো পড়া শুরু করেছি। এর পরের বছরগুলোতে আমিও ইউরোপীয় ফুটবলের অলি-গলিতে বিচরণ শুরু করেছি আর আমার হালে পানি দিচ্ছে প্রথম আলো। ক্রিকেট তখন রমরমা এদেশে। আমি মাঠে ক্রিকেট খেলি, পত্রিকার পাতায় উৎপল শুভ্রর মন মাতানো রিপোর্ট পড়ি। এর পাশাপাশি প্রথম আলোতে সূচি দেখে ম্যানচেস্টার ইউনাইটেডের খেলাও দেখি। পাশাপাশি একটু-আধটু জানতে শুরু করেছি লিভারপুল, চেলসি এবং রিয়াল মাদ্রিদের নাম। ধীরে ধীরে জানছি লা লিগা, প্রিমিয়ার লিগ, সিরি আ, চ্যাম্পিয়নস লিগের কথা। তবে আমার ভালো লাগা ছিল অন্যখানে। ঝাঁকড়া চুলের রাইকার্ড আর ম্যাজিশিয়ান রোনালদিনহোর কারণে বার্সেলোনাকে মন দিয়েছি অনেক আগেই।
এর মাঝে ঘনিয়ে আসে ২০০৬ বিশ্বকাপ। সার্বিয়া এন্ড মন্টেনেগ্রোর সাথে আর্জেন্টিনার খেলা টিভিতে দেখছি। ততদিনে মেসি নামক বিস্ময়-বালকের নাম একটু-আধটু শুনেছি প্রথম আলো মারফত। কিন্তু আর্জেন্টিনার প্রতি আমার ঝোঁক তো সেই 'মানুষ গুলো এভাবে কাঁদছে কেন'- সময় থেকে। আর্জেন্টিনার বড় জয় সেই ম্যাচে আমাকে আনন্দে ভাসিয়েছিল। বলা চলে পূর্ণ সমর্থক হিসেবে সেটাই আমার প্রথম আর্জেন্টিনার ম্যাচ দেখা এবং টিভি পর্দায় প্রথম মেসি-দর্শন। একই সাথে রিকুয়েলমেদের খেলা দেখে আমি ব্যাকুল। সেই বিশ্বকাপে কোয়ার্টার ফাইনালে আর্জেন্টিনার গোলকিপারের ট্রাজেডিকে আমি দীর্ঘদিন 'ক্লোসা ইচ্ছে করে মারছে' বলেই বিশ্বাস করেছি।
এর পরের বছর গুলো খুব দ্রুত কেটেছে। ২০১০ বিশ্বকাপের আগেই ফুটবলের সকল খোঁজখবর আমার মুখস্থ । ম্যারাডোনা কোচ হলেন, আমি দ্বিগুণ আনন্দিত। বাদ পড়ে যায়-যায় অবস্থা থেকে যখন আর্জেন্টিনা কোয়ালিফাই করে ফেলল, তখন স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলি। চূড়ান্ত দলে যখন জানেত্তি, রিকুয়েলমকে দেখলাম না, তখন ম্যারাডোনার প্রতি খানিকটা উষ্মা থাকলেও আমি মনে-প্রাণে ততদিনে আর্জেন্টিনার সমর্থক। ২০১০-এ খালি হাতে ফিরলাম, যা ২০১৪-তে হাত ভরে ফেরত পেতে গিয়েও পেলাম না। এরপর ২০১৫, ২০১৬, তারপর আশা হারানো ২০১৮...এভাবেই হয়তো আরও এক শতাব্দী কেটে যাবে, তবুও আমি দৃঢ় কণ্ঠেই বলব, আমি আর্জেন্টিনার সমর্থক।
পরিশেষে: ২০১৪ বিশ্বকাপ ফাইনালে শেষ মুহূর্তের গোলে যখন হেরে যাই, স্ক্রিনে তাকিয়ে থাকা আমার চোখ দিয়ে তখন জলের নহর বইছে। এক ছোট ভাই সামনে এসে বলল, 'ভাই, আপনি এভাবে কাঁদছেন কেন?' আমার মনে পড়ে গেল ১২ বছর আগের কথা! আমি তখন ওকে বলতে পারিনি এরিক ক্যান্টোনার সেই বিখ্যাত উক্তি। কিংবা বোঝাতে পারিনি, মানুষ প্রিয় দলের জন্য এভাবে কাঁদে কেন!



 
										 
										 
										 
										 
										 
										

 
            





 
						 
						 
						 
						 
						