চার বছর বয়সে হলুদ-সবুজের প্রেমে!

উৎপল শুভ্র নির্বাচিত পাঠকের লেখা

কৃপাসিন্ধু জয়

৮ জুলাই ২০২১

চার বছর বয়সে হলুদ-সবুজের প্রেমে!

চার বছর বয়সের স্মৃতি কতটুকুই বা মনে থাকে! এই পাঠকের শুধু মনে আছে, ২০১০ বিশ্বকাপে রেফারি বল হাতে মাঠে নামছেন,। আর মনে আছে পেছনে হলুদ জার্সি পরা একটা দল। সেই স্মৃতিই মনে এমন গেঁথে যায় যে, হলুদ-সবুজই হয়ে যায় তার কাছে ফুটবলের রং।

আমার ফুটবল বোঝার শুরু হয় ২০১৪ ব্রাজিল বিশ্বকাপ থেকে। তবে দেখার শুরু হয়েছিল ২০১০-এর দক্ষিণ আফ্রিকা বিশ্বকাপ থেকে। কিন্তু সেই বিশ্বকাপের শুধু একটা স্মৃতিই রয়ে গেছে। চোখ বন্ধ করে সেই সময়ের কথা স্মরণ করতে গিয়ে দেখতে পাই, রেফারি বল হাতে করে মাঠে নামছে আর পেছনে হলুদ জার্সি পরা একটি দল এবং প্রথম ভালো লাগা। এতটুকু স্মৃতিই যে আমার মনে রয়ে গেছে, এতেই আমি সন্তুষ্ট। কেননা চার বছর বয়সের কথা আর কী-ইবা মনে থাকে! হ্যাঁ, ২০১০ বিশ্বকাপের সময় আমার বয়স ছিল মাত্র চার বছর!

২০১৪ ব্রাজিল বিশ্বকাপের আগে ফুটবল সম্পর্কে তেমন কোনো ধারণাই আমার ছিল না। তবে কয়েকজনের কাছে মেসি,রোনালদো আর নেইমারের নাম শুনেছিলাম। ওই সময়ে আমি ক্লাস থ্রিতে পড়তাম, কিন্তু সেই বয়সেই নিয়মিত পত্রিকা পড়তাম। বিশেষ করে দৈনিক জনকণ্ঠ এবং দৈনিক কালের কণ্ঠ। বিশ্বকাপের কয়েক মাস আগে থেকেই পত্রিকার খেলার পাতার প্রধান বিষয় ছিল ব্রাজিল বিশ্বকাপ। আমি কিন্তু সেই সময়ে নিশ্চিত ছিলাম না যে, আমি কোন দলের সমর্থক হব। নিজে নিজে সিদ্ধান্ত নেওয়ার জন্য সেটা কোনো বয়সই ছিল না। তাই পরিবারের সবাই ব্রাজিলের সমর্থক হওয়ার কারণে আমাকেও ব্রাজিলের সমর্থক হতে হলো।

আমার বোনের কারণে আমিও সেই সময়ে প্রফেসর'স কারেন্ট অ্যাফেয়ার্স পড়ার সুযোগ পাই। ওই সময়ে মাসিক সাময়িকীটিতে বিশ্বকাপের ইতিহাস নিয়ে একটা আলাদা আয়োজন থাকত। তো ওখানে ব্রাজিলের অসামান্য ইতিহাস জানার পর আমি আরও ভালো করেই ব্রাজিলের সমর্থক হয়ে গেলাম। এই সাময়িকী আর পত্রিকার জ্ঞানের দ্বারাই আস্তে আস্তে ব্রাজিল দলের প্রায় সকল খেলোয়াড়কেই চিনে গেলাম। আমার পছন্দের খেলোয়াড় ছিলেন ব্রাজিলের অধিনায়ক থিয়াগো সিলভা আর ফরোয়ার্ড অস্কার।

সময়ের সাথে সাথে এসে গেল বিশ্বকাপ। বিশ্বকাপের প্রথম ম্যাচ ছিল ব্রাজিল আর ক্রোয়েশিয়ার মধ্যে। আমরা বেশ কয়েকজন মিলে খেলা দেখেছিলাম। আমার এখনো মনে আছে ম্যাচটা ছিল রাত বারোটার পরে। তো আট বছর বয়সী এক বালকের জন্য এত রাত পর্যন্ত না ঘুমানো অনেক কঠিন এক বিষয় ছিল। কেননা, ওই সময়ে আমি রাত সাড়ে ন'টার মধ্যেই ঘুমিয়ে পড়তাম। ওই দিন অনেক কষ্ট করে জেগে ছিলাম।

তো উদ্বোধনী অনুষ্ঠানের পর শুরু হলো ম্যাচ। ম্যাচের কিছুক্ষনের মধ্যেই রাইটব্যাক মার্সেলো ভিয়েইরার আত্মঘাতী গোলে পিছিয়ে পরে ব্রাজিল। বিষয়টি বোঝা আমার জন্য অনেক কঠিন ছিল। আমার মনে প্রশ্ন হলো, কীভাবে এটি হলো? তো এত সব প্রশ্ন বাদ দিয়ে আবার মনোযোগ সহকারে খেলা দেখা শুরু করলাম। এক সময় ব্রাজিল পেনাল্টি কিক পেল আর কিকটি নিতে এলেন ব্রাজিলের সেরা খেলোয়াড় ১০ নম্বর জার্সিধারী নেইমার জুনিয়র। নেইমার কিক নিলেন, এবং গোল। ব্রাজিল সমতায় ফিরল। পরে নেইমার আরও একটি গোল দিয়েছিলেন। তবে সেই ম্যাচের আমার সেরা স্মৃতি হচ্ছে ব্রাজিলের অস্কারের করা গোলটি। ডি বক্সের বাইরে থেকে অত্যন্ত সুন্দর একটি গোল করেছিলেন অস্কার।

ব্রাজিলের গ্রুপ পর্বের বাকি দুই ম্যাচের কথা আমার খুব একটা মনে নেই। তারপর এলো ব্রাজিল বনাম চিলির শেষ ষোলোর খেলা। নির্ধারিত সময়ে ১-১ সমতার পর খেলাটি গড়ায় ট্রাইবেকারে। আর ট্রাইবেকারে ব্রাজিলকে জিতিয়ে দেন গোলরক্ষক হুলিও সিজার। সেদিন অনেক ভালো পারফরম্যান্স করেছিলেন তিনি। এখনও মনে আছে, পরদিনের দৈনিক 'কালের কণ্ঠ' পত্রিকার খেলার পাতায় তাঁকে নিয়ে একটা কলাম লেখা হয়েছিল। কলামটির শিরোনাম, 'বীরত্বের ভাষা হারানো সিজার।'

তারপর ব্রাজিল বনাম কলম্বিয়ার মধ্যকার শেষ আটের খেলা। সেই ম্যাচের দুটি ঘটনা এখনো মাঝে মাঝে মনে পড়ে। নেইমারের সেই ইনজুরি আর ডিফেন্ডার ডেভিড লুইজের ৬৫ মিনিটে ফ্রি কিক থেকে করা গোল। ডেভিড লুইজের গোলের পর সেই উল্লাসটা এখনো চোখে ভাসে। তারপরই তো জার্মানির বিপক্ষে সেমিফাইনাল। আর সব ব্রাজিল সমর্থকের মতো আমিও সেই রাতের কথা ভুলে যেতে চাই। নেইমার-সিলভাবিহীন আত্মবিশ্বাসহীন এক ব্রাজিল খেলেছিল সে রাতে। ৭টি গোল হজম করার রাতে চোখে জল এসে গিয়েছিল।

তারপর ব্রাজিল দলে অনেক অনেক পরিবর্তন হয়েছে। কিন্তু সাফল্য আসেনি। সবচেয়ে বাজে লেগেছিল, যখন ব্রাজিল কোপা আমেরিকায় গ্রুপ পর্ব থেকেই বাদ পড়েছিল। এরপর আসে রাশিয়া বিশ্বকাপ। বাছাইপর্ব থেকে সবার আগে বিশ্বকাপের টিকিট নিশ্চিত করেই ২০১৮'র রাশিয়া বিশ্বকাপে গিয়েছিল ব্রাজিল। বিশ্বকাপের শুরু থেকেই অন্যতম ফেবারিটও ছিল। তাই কোয়ার্টার ফাইনালে বেলজিয়ামের সাথে ১-২ গোলে হেরে যাওয়াটা আমার বিশ্বাসই হচ্ছিল না। বেলজিয়াম দল অনেক শক্তিশালী সেটা জানতাম, কিন্তু কেন যেন মানতে পারছিলাম না ব্রাজিলের বাদ পড়া।

এরপর ২০১৯ সালে ব্রাজিলে হলো কোপা আমেরিকা। নেইমারবিহীন ব্রাজিলের জেতার 'কোনো আশাই নেই' বলেই ভেবে নিয়েছিলাম। কিন্তু কুতিনহো, জেসুস, এভারটন আর বিশেষ করে দানি আলভেজের পারফরম্যান্সে নিজেদের ঘরের মাটি থেকে কোপার শিরোপা অন্য কোনো দলকে নিয়ে যেতে দেয়নি সেলেসাওরা। বিশেষ করে সেমিফাইনালে যখন মেসির আর্জেন্টিনার সাথে ২-০ দল জিতেছিল, তখন যে কী আনন্দ হয়েছিল, সেটা লিখে প্রকাশ করা অত্যন্ত কঠিন এক কাজ।

এরপর ব্রাজিল মোটামুটি পারফরম্যান্স করে গেলেও সন্তুষ্ট হতে পারিনি। এমনকি এবারের কোপাতেও ফাইনালে গেলেও ব্রাজিলের খেলা আর সকল ব্রাজিল সমর্থকের মতো আমাকেও হতাশ করেছে। বিশেষ করে সেমিফাইনালে পেরুর সাথে খেলা ম্যাচটা। শত শত ভুলে ভর্তি ম্যাচ। নেইমার-রিচার্লিসনরা এত সব গোলের সুযোগ মিস করেছেন যে, ৪/৫ গোলের ব্যবধানে যে ম্যাচ জেতা উচিত, সেই ম্যাচটা ব্রাজিল জিতেছে মাত্র ১-০ গোলে। ১১ জুলাই ফাইনালে ব্রাজিল মুখোমুখি হবে আর্জেন্টিনার। এবারের কোপা আমেরিকার সবচেয়ে আকর্ষণীয় ম্যাচই হবে হয়তো। ব্রাজিল কী পারবে নিজেদের মাটিতে কোপায় প্রত্যেকবার জয়ী হওয়ার রেকর্ড ধরে রাখতে? নাকি লিওনেল মেসি পাবেন তাঁর ক্যারিয়ারের প্রথম আন্তর্জাতিক শিরোপা?

আপনার মতো আমিও তো দেখব বলে অপেক্ষার ক্ষণ গুনছি!

শেয়ার করুনঃ
আপনার মন্তব্য
আরও পড়ুন
×