একটি হলুদ জার্সির প্রতি প্রেম, আবেগ ও ভালোবাসার গল্প

উৎপল শুভ্র নির্বাচিত পাঠকের লেখা

মোঃ নবীর হোসেন

৯ জুলাই ২০২১

একটি হলুদ জার্সির প্রতি প্রেম, আবেগ ও ভালোবাসার গল্প

বেদনা? তা তো সমর্থনের অংশ। ২০১৪ বিশ্বকাপে জুনিগার ট্যাকলে নেইমারের মেরুদণ্ডের হাড়ে চোট, এরপর বেলো হরিজন্তেতে জার্মানির বিপক্ষে ৭-১ গোলে পরাজয়-- সব ব্রাজিল-সমর্থকের মতো এই লেখকেরও আজন্ম আক্ষেপের স্মৃতি৷ কিন্তু ব্রাজিলের প্রতি ভালোবাসায় ঘাটতি পড়েনি এরপরও। পেয়েছেন তাই আনন্দের অনুভূতিও। দলের সঙ্গে জিতেছেন ২০১৩ কনফেডারেশনস কাপ আর ২০১৯ কোপা আমেরিকা।

সময়টা ২০০৯-এর শেষাংশ। এক বছর পরই দক্ষিণ আফ্রিকায় অনুষ্ঠিত হতে যাচ্ছে' গ্রেটেস্ট শো অন আর্থ'-খ্যাত ফুটবল বিশ্বকাপ। চারদিকে শুরু হয়ে গেছে বিশ্বকাপের উন্মাদনা। ঘরে-বাইরে, রাস্তা-ঘাটে, বাজারে কিংবা চায়ের টঙে চলছে প্রবল মাতামাতি, কখনো কখনো তা রূপ নিচ্ছে তর্কাতর্কিতে। সবচেয়ে বেশি যে দুটি দলের নাম শুনছিলাম, তা ব্রাজিল ও আর্জেন্টিনা। ব্রাজিল-সমর্থকদের মুখে ছিল রিকার্ডো কাকার নাম, আর্জেন্টিনা-ভক্তদের মুখে মেসির নাম।

সব জল্পনা-কল্পনা শেষে অবশেষে এল বিশ্বকাপের সেই মাহেন্দ্রক্ষণ। বাবা, চাচা কিংবা এলাকার বড় ভাইদের মুখে শুনেছিলাম, ফুটবলের তীর্থস্থান বলা হয় ব্রাজিলকে। শুনেছিলাম রোমারিও, রিভালদো, রোনালদো, রোনালদিনহোদের শৈল্পিক ফুটবলের কথা। ২০১০ বিশ্বকাপে ব্রাজিলের প্রথম ম্যাচ ছিল উত্তর কোরিয়ার সাথে। সেই ম্যাচে ব্রাজিল জিতে যায় ২-১ গোলে। সেদিনই হলুদ জার্সিধারীদের ফুটবলের প্রেমে পড়া। মূলত ফুটবলকে, বিশেষ করে ব্রাজিলকে ভালোবাসতে বাধ্য করেছিলে সে সময়ের তারকা ফুটবলার কাকা। কাকার পায়ের শৈল্পিক ফুটবলের জাদু, ডিফেন্স চেরা সব পাস, গোলের পর আকাশের দিকে তাকিয়ে দুই হাত তুলে কাকার সেই ট্রেডমার্ক সেলিব্রেশন-- সব কিছু মনে গেঁথে যায়। সেই থেকেই মূলত ব্রাজিলকে সমর্থন করা। ২০১০ বিশ্বকাপে হল্যান্ডের কাছে কোয়ার্টার ফাইনালে হেরে বিদায় নেয় ব্রাজিল। সেদিন মনের কোণে অনেকটা চাপা কষ্ট জমে ছিল। ভাবতেই কষ্ট হচ্ছিল যে, ব্রাজিল বিশ্বকাপের মঞ্চ থেকে বিদায় নিয়েছে।

বিশ্বকাপের পরে ধীরে ধীরে ইতি ঘটতে থাকে কাকা-যুগের। এক সময় ফুটবল নামক আকাশ থেকে রিকার্ডো কাকা নামক সেই নক্ষত্রটি ঝড়ে যায়। তখন ব্রাজিল দলে শুরু হয় দৈন্যদশা। তবে ফুটবলের দেশ ব্রাজিলকে খাদের কিনারা থেকে উদ্ধার করতে আবির্ভাব ঘটে হালকা, রোগাপলকা গড়নের একটি ছেলের, যাঁর নাম নেইমার জুনিয়র। ২০১৩ সালে ব্রাজিল ঘরের মাটিতে কনফেডারেশন কাপ খেলতে নামে। ততদিনে দলের সেরা তারকা নেইমার। স্বভাবতই তাঁর উপর প্রত্যাশা ছিল আকাশচুম্বী। তখনকার ব্রাজিল দলের গোলবার সামলানোর দায়িত্বে ছিলেন হুলিও সিজার। ডিফেন্স লাইনে ছিলেন থিয়াগো সিলভা, ডেভিড লুইজ,দানি আলভেজ, মার্সেলো। অ্যাটাকে নেইমারের সাথে ছিলেন ফ্রেড, হাল্ক ও অস্কার। সেবার ব্রাজিল নেইমার-ফ্রেডের অনবদ্য পারফরম্যান্সে পৌঁছে যায় টুর্নামেন্টের ফাইনালে। ফাইনালে ওঠার পথে ব্রাজিল টপকে যায় সাবেক বিশ্ব চ্যাম্পিয়ন ইতালি ও উরুগুয়ে বাধা। ফাইনালে ব্রজিলের প্রতিপক্ষ ছিল বিশ্ব চ্যাম্পিয়ন স্পেন।

জাভি, ইনিয়িস্তা, ক্যাসিয়াস, পিকেদের নিয়ে স্পেন তখন র‍্যাংকিয়ের এক নম্বর দল। অন্যদিকে সামনের বিশ্বকাপের স্বাগতিক হওয়ার কারণে ব্রাজিল প্রতিযোগিতামূলক ম্যাচ খেলতে পারছিল না বলে দলটা নেমে গিয়েছিল ২৩-এ। চারিদিকে তাই স্পেনের জয়জয়কার। নিন্দুকেরা তো ফাইনালের আগেই ব্রাজিলকে উড়িয়ে দিয়েছিল। কিন্তু ফাইনালে যে ব্রাজিলের দেখা মিলেছিল, তা রীতিমতো অবিশ্বাস্য। স্পেনকে ৩-০ গোলে হারিয়ে দিয়ে ফিফা কনফেডারেশন কাপের চ্যাম্পিয়ন হয়ে যায় ব্রাজিল। জয়ের নায়ক সেই নেইমার-ফ্রেড। টুর্নামেন্টের সেরা খেলোয়াড়ও হয়েছিলেন ধীরে ধীরে ব্রাজিলের প্রাণভোমরা হয়ে ওঠা নেইমার। এটাই ছিল প্রিয় দলকে প্রথম শিরোপা জিততে দেখা। এটাই এখন অবধি প্রিয় দলের আনন্দের সেরা স্মৃতি।

আনন্দের স্মৃতির বিপরীতে বেদনার স্মৃতি থাকবে না? হ্যাঁ, তা-ও আছে। কনফেডারেশন কাপ জয়ের পর ব্রাজিল সমর্থকরা ২০১৪ সালে নিজেদের মাটিতে অনুষ্ঠিত হতে যাওয়া বিশ্বকাপ জয়ের স্বপ্ন দেখতে শুরু করে। ২০১৪ সালের বিশ্বকাপের প্রথম ম্যাচেই দলের প্রাণভোমরা নেইমার করেন জোড়া গোল, ব্রাজিল জেতে ৩-১ গোলে। নেইমারের এমন পারফরম্যান্সের পর বিশ্বকাপ জয়ের স্বপ্নটা আকাশ ছোঁয়। এরপর ব্রাজিল তাদের সেরাটা খেলে পৌঁছে যায় কোয়ার্টার ফাইনালে। প্রতিপক্ষ ছিল কলম্বিয়া। ম্যাচ তখন ১-১ সমতায়। তখনই কলম্বিয়ান ডিফেন্ডার জুনিগার মারাত্মক এক ট্যাকলের শিকার হন নেইমার। কাঁদতে কাদঁতে স্ট্রেচারে করে মাঠ ছাড়েন নেইমার। সেদিনই শেষ হয়ে যায় নেইমারের বিশ্বকাপ-স্বপ্ন। নেইমারের নয়, আসলে সেদিন শেষ হয়ে গিয়েছিল ব্রাজিলের বিশ্বকাপ-স্বপ্নই।

একজন ব্রাজিল সমর্থন হিসেবে সেদিনের অনুভূতিটুকু প্রকাশ করা হয়তো সম্ভব না। তবে ব্রাজিল সেদিন কলম্বিয়ার সাথে জিতে সেমিতে পা রাখে। সেমিফাইনালে প্রতিপক্ষ শক্তিশালী জার্মানি। দলে নেইমারের পাশাপাশি ছিলেন না ডিফেন্সের অতন্দ্র প্রহরী থিয়াগো সিলভা। নেইমার-সিলভাবিহীন ব্রাজিলকে নিয়ে একটু ভয় হচ্ছিল। সেই ভয় যেন মাঠে চরমভাবে প্রতিফলিত হতে লাগল। সেদিন ব্রাজিলের জালে গুনে গুনে ৭ গোল দেয় জার্মানি। পাঁছবারের বিশ্বচ্যাম্পিয়ন ব্রাজিলের জালে জার্মানদের এমন গোল-উৎসব! নিজেই নিজের চোখকে বিশ্বাস করাতে পারছিলাম না। সেদিন বেলো হরিজন্তেতে রচিত হয়েছিল ব্রাজিল ফুটবলের এক কলঙ্কিত-অধ্যায়। সেদিন খুব কান্না পাচ্ছিল, চোখের কোনে মেঘের মত জল জমা হয়েছিল, ধীরে ধীরে তা বৃষ্টিতে রূপ নিয়েছিল। সেই ট্রাজেডির পর অনেক রাত না ঘুমিয়েই কাটাতে হয়েছে। সেদিনের পর অনেক ট্রল সহ্য করেছি, নিন্দুকের সমালোচনার তীর হজম করেছি।

এরপর অনেক দিন কেটেছে। দল অনেক চরাই-উতরাইর ভেতর দিয়ে গেছে। তবে সেলেসাওদের প্রতি ভালোবাসা একটুও কমেনি, কমেনি হলুদ জার্সির প্রতি অগাধ প্রেম, আস্থা ও বিশ্বাস। ব্রাজিলও ঘুরে দাঁড়িয়েছে। জিতেছে ২০১৬ সালের অলিম্পিক গোল্ড মেডেল, যা কি না ব্রাজিলের কাছে সব সময়ই ছিল আরাধ্য। এখন ভালো-খারাপ মিলিয়েই চলছে। ২০১৮ সালের বিশ্বকাপে ব্যর্থ হয়েছে ব্রাজিল। আবার সেই ব্রাজিলই ২০১৯ সালে নেইমারকে ছাড়াই জয় করে কোপা আমেরিকা।

ঠিক দুই বছর পর আরেকটি কোপা আমেরিকা টুর্নামেন্ট। আরেকটি ফাইনালের মঞ্চ, আরেকটি শিরোপার হাতছানি। প্রতিপক্ষ মেসির আর্জেন্টিনা। বিশ্বাস, চিরপ্রতিদ্বন্দ্বীদের হারিয়ে শিরোপা-উৎসব করবে সাম্বার দেশ ব্রাজিল। তবে ফুটবলে যেকোনো কিছুই তো ঘটতে পারে। কে হাসবে শেষ হাসি? মেসির আর্জেন্টিনা? নাকি নেইমারের ব্রাজিল?

উত্তরটা তো ১১ জুলাই সকালেই জানা যাবে।

শেয়ার করুনঃ
আপনার মন্তব্য
আরও পড়ুন
×