৫৪ এর বিশ্বকাপ –মাইটি মাগার্স এবং দি মিরাকেল অফ বার্ন

১৩ মে ২০২১

৫৪ এর বিশ্বকাপ –মাইটি মাগার্স এবং দি মিরাকেল অফ বার্ন

দি মিরাকেল অফ বার্ন

৬ টি যার ১৬টিই ছিল অনটার্গেট। অন্যদিকে পশ্চিম জার্মানি শট করে ১৫টি যার দশটি ছিল অনটার্গেট। ৯ বার অফসাইডের ফাঁদে পড়ে জার্মানরা আর ৩ বার ভাগ্য সহায় হয় নি হাঙ্গেরির। 


একটা দল পাঁচ বছর ধরে অপরাজিত। গ্রুপ পর্বে সেই দল কোনো এক দলকে হারিয়েছে ৮-৩ গোলের ব্যবধানে। ৮-৩ গোলের ব্যবধানে হেরে যাওয়া দলই ফাইনালে পাঁচ বছর ধরে অপরাজিত দলকে ৩-২ গোলে হারিয়ে জিতে নিল বিশ্বকাপ। ঠিক এমনটাই ঘটেছিল ১৯৫৪ এর বিশ্বকাপ ফাইনালে। ‘দি মিরাকেল অফ বার্ন’ নামেই খ্যাত সুইজারল্যান্ডের সেই ফাইনাল। 

১৯৪৬ সালের ২২শে জুলাই ঠিক হয় ২য় বিশ্বযুদ্ধের পর হওয়া ১ম ও ২য় বিশ্বকাপের স্বাগতিক দেশ। সেই সুবাদে ১৯৫৪ বিশ্বকাপ আয়োজনের দায়িত্ব পায় সুইজারল্যান্ড। স্বাগতিক দেশ আর ডিফেন্ডিং চ্যাম্পিয়ন দুই দলই সরাসরি জায়গা পেত বিশ্বকাপে। ১৬ দলের বিশ্বকাপে বাকি ১৪ দলের ১১ দলই আসে ইউরোপ থেকে আর তিন দলের দুই দল আসে আমেরিকা একদল এশিয়া থেকে। 

ছয় শহরের ছয় ভেন্যুতে খেলা হয়  এই বিশ্বকাপ। সবচেয়ে বেশি ৬৪০০০ ধারণক্ষমতার বার্ন শহরের ওয়াংকডর্ফ স্টেডিয়ামে হয় ফাইনাল।

ছয় শহরের ছয় ভেন্যুতে খেলা হয়  এই বিশ্বকাপ। সবচেয়ে বেশি ৬৪০০০ ধারণক্ষমতার বার্ন শহরের ওয়াংকডর্ফ স্টেডিয়ামে হয় ফাইনাল। এছাড়া বাসেল, লাউসানে, জুরিখ, জেনেভা ও লুগানের পাঁচ স্টেডিয়ামে হয় বিশ্বকাপের ২৬ ম্যাচ।  সবচেয়ে বেশি ৬টি ম্যাচ হয় বাসেলের সেন্ট জেকব স্টেডিয়ামে  আর লুগানোর কার্নেডো স্টেডিয়ামে হয় মাত্র একটি ম্যাচ।

একদম মৌলিক এক ফরম্যাটে হয় ১৯৫৪ এর বিশ্বকাপ। ১৬ দলকে চার গ্রুপে ভাগ করা হয় যেখানে দুই দল। গ্রুপের চ্যাম্পিয়নিদের নকাউট হবে একসাথে আর রানার্সআপদের নকাউট হবে একসাথে এমন নিয়ম দেখা যায় এই বিশ্বকাপে। মানে বলা যায় ফাইনাল হবে সব গ্রুপ চ্যাম্পিয়নদের থেকে একজনের সাথে সব গ্রুপ রানার্সআপ থেকে একজনের সাথে। গ্রুপ পর্বের ম্যাচ ড্র হলে অতিরিক্ত ৩০ মিনিট খেলানোর ছিল এ বিশ্বকাপে। আবার কোনো গ্রুপের দুই দলের পয়েন্ট সমান হলে ড্র এর মাধ্যমে সে গ্রুপ চ্যাম্পিয়ন বাছাই করা হবে ঠিক একইভাবে নকাউটও। শুধু ফাইনাল ম্যাচ ড্র হলে ২য়বার ফাইনাল খেলার নিয়মও রাখা হয়।

‘মাইটি মাগার্স’ নামে হাঙ্গেরির লিজেন্ডারি দল কিংবা গোল্ডেন জেনারেশন যাই বলা হোক না কেন সেটাই ছিল ১৯৫৪ বিশ্বকাপের টপ ফেভারিট। ফাইনালে ওঠার আগে শেষ পাঁচ বছরে ৩১ ম্যাচ খেলে সবগুলোতে অপরাজিত ছিল এই ‘মাইটি মাগার্স’। তারা ছিল তখনকার অলিম্পিক চ্যাম্পিয়ন এবং ১৯৫৩ সালে হওয়া সেন্ট্রাল ইউরোপিয়ান ইন্টারন্যাশনাল কাপের চ্যাম্পিয়ন। প্রথম দল হিসেবে ইংল্যান্ডকে ইংল্যান্ডের মাঠে হারায় তারা। বিশ্বকাপের ঠিক আগেই বুদাপেস্টে ৭-১ গোলে ইংল্যান্ডকে বিধ্বস্ত করে হাঙ্গেরি। 

হাঙ্গেরি দলের প্রতিটা ফুটবলার ছিলেন প্রফেশনাল আর স্কিলের জন্য হাঙ্গেরি দলের নামডাক ছিল বেশ। ফ্রন্ট লাইনে ফেরেঙ্ক পুসকাস, সান্দোর ককসিস; এটাকিং মিডে নান্দোর হাইডগুতি কিংবা গিউলা গ্রসিকস এর মত গোলকিপাররা ছিলেন হাঙ্গেরির মূল দলে। আর সেই দলের কোচ ছিলেন হাঙ্গেরির ক্রীড়া উপমন্ত্রী গুস্তাভ সেবেস। 
এই বিশ্বকাপে ভাঙ্গে বেশকিছু রেকর্ড। এই বিশ্বকাপে ম্যাচপ্রতি সবচেয়ে বেশি গোল (৫.৩৮) হয়। হাঙ্গেরি দলটি কতটা ভয়ংকর ছিল সেটা কিছু রেকর্ডে চোখ বুলালেই বুঝতে পারার কথা একজন সাধারণ ফ্যানের।

এই বিশ্বকাপে হাঙ্গেরি দল গোল করে ২৭টি। হাঙ্গেরি দল প্রতি ম্যাচে গড়ে গোল করে ৫.৪টি। তাদের গোল ডিফারেন্স ছিল ১৭, যা বিশ্বকাপে সর্বোচ্চ ছিল। অস্ট্রিয়া ও সুইডেন ম্যাচে মোট গোল হয় ১২টি (৭-৫)। দক্ষিণ কোরিয়াকে ০-৯ গোলের ব্যবধানে হারায় হাঙ্গেরি যা বিশ্বকাপের সেরা তিন ম্যাচ জয়ের একটি। 
এই বিশ্বকাপই সর্বপ্রথম সম্প্রচারিত হয় টেলিভিশনে। বিশ্বকাপের জন্য বিশেষ মুদ্রার প্রচলনের শুরুও এই  বিশ্বকাপ থেকেই। 

এই বিশ্বকাপে সর্বোচ্চ ১১ গোল করেন সান্দোর ককসিস যা ২য় সর্বোচ্চ গোল ৬টি থেকে ৫ গোল বেশি। ৬টি করে গোল করেন অস্ট্রিয়ান এরিক প্রবস্ট, সুইজারল্যান্ডের জোসেফ হুগি ও জার্মানির ম্যাচ মরলোক। 

গ্রুপ পর্বের দুই ম্যাচে দুই জয় পেয়ে গ্রুপ চ্যাম্পিয়ন হয় জার্মানি। দুই ম্যাচে এক জয় নিয়ে রানার্স আপ হয় পশ্চিম জার্মানি। দক্ষিণ কোরিয়াকে ৯-০ গোলে উড়িয়ে দিয়ে শুভসূচনা করে হট ফেভারিট হাঙ্গেরি। জার্মানির সাথে ম্যাচে তারা জয় পায় ৮-৩ গোলের ব্যবধানে। কিন্তু পুসকাসের ইঞ্জুরি ভাবিয়ে তোলে হাঙ্গেরিকে। 

কোয়ার্টার ফাইনালে হাঙ্গেরির সামনে আসে ১৯৫০ বিশ্বকাপের রানার্স আপ আরেক ফেভারিট ব্রাজিল। ব্রাজিলকে ৪-২ গোলে হেসেখেলেই হারিয়ে দেয় পুসকাসবিহীন হাঙ্গেরি। সেমি ফাইনালে ডিফেন্ডিং চ্যাম্পয়ন উরুগুয়ের সামনে পড়ে হাঙ্গেরি এবং অতিরিক্ত সময়ে তাদের হারায় ৪-২ গোলের ব্যবধানে, চলে যায় ফাইনালে। 

অন্যদিকে পশ্চিম জার্মানি প্রথম ম্যাচে তুর্কিকে হারায় ৪-১ গোলে। পরের ম্যাচে হাঙ্গেরির কাছে ৩-৮ গোলের বিশাল ব্যবধানে হারে জার্মানরা। হাঙ্গেরির সাথে হেরে তুর্কির সাথে প্লে অফ খেলে তারা। সেই ম্যাচেও ৭-২ গোলের জয় পায় তারা। কোয়ার্টার ফাইনালে তারা মুখোমুখি হয় যুগোস্লোভিয়ার। যেখানে ২-০ গোলের জয় পায় তারা। সেমিতে তাদের প্রতিপক্ষ হয়ে দাঁড়ায় অস্ট্রিয়া। ৬-১ গোলে অস্ট্রিয়াকে হারিয়ে ফাইনালের টিকিট পায় জার্মানি। 

এরপরই চার জুলাই বার্নের ওয়াংডর্ফ স্টেডিয়ামের সেই ঐতিহাসিক ফাইনাল। ফাইনাল ম্যাচে হাঙ্গেরির হয়ে নামেন পুসকাস। মাত্র ছয় মিনিটেই পুসকাসের গোলে এগিয়ে যায় হাঙ্গেরি। ককসিস এর বল ব্লক করলেও সে বল গোলপোস্টের কাছ থেকে জালে জড়ান পুসকাস। জার্মান ডিফেন্সের ভুলে ঠিক দুই মিনিট পরেই আরও এক গোল দিয়ে বসে হাঙ্গেরি। গোল করেন জিবর। ডিফেন্ডারের করা ব্যাকপাস গোলকিপার টনি টুরেকের উইক ফুটের দুর্বল বল কন্ট্রোলিং এর সুযোগ নিয়ে চলে আসেন জিবর। খালি জালে  জড়িয়ে দেন বল। সব ম্যাচের মত গোল উৎসবের প্রস্তুতি নেয় দর্শকরা। 

গোল খেয়েই আক্রমণে যায়  পশ্চিম জার্মানি। দশ মিনিটের সময় লেফট উইং দিয়ে বুজানস্কির পায়ের ফাঁক দিয়ে চলে যাওয়া ফ্রিটজ ওয়াল্টারের ক্রস থেকে গোল করেন ম্যাক্স মরলোক। ম্যাচের বয়স তখন আঠার, মরলোক ড্রিবলিং করে হাঙ্গেরির ডিফেন্স ভাঙ্গার চেষ্টায় এগুলেও সেখানে বল ক্লিয়ার করেন লরেন্ত। কর্নার পায় জার্মানি। ওয়াল্টারের কর্নার এবার ক্লিয়ার করেন বুজানস্কি। ২য় কর্নার থেকে গোল করে সমতা ফেরান রান। 

ম্যাচ ২-২ এ সমতায় আসার পর হাঙ্গেরি শুরু করে পালটা আক্রমণ, দখল নেয় ম্যাচের। বেশি কিছু ভালো সুযোগও তৈরি করে তারা। ২৩ মিনিটের সময় লেফটব্যাক লান্টোসের চিপ করা ক্রস খুঁজে পায় ককসিসের মাথা, সেখান থেকে বল যায় হাইডগুতির কাছে। কিন্তু হাইডগুতির শট অসাধারণ দক্ষতায় ঠেকিয়ে দেন ২য় গোল খাওয়ার মূলহোতা গোলকিপার টুরেক। চার মিনিট পর হাইডগুতির শট ফিরে আসে পোস্টে লেগে। ৪২ মিনিটের সময় গোল লাইন থেকে রান এর গোলমুখী শট ক্লিয়ার করেন বুজানস্কি।  

২য় অর্ধে একদম এটাকিং মুডে থাকে হাঙ্গেরি। একের পর এক সুযোগ তৈরি করতে থাকে তারা। বিরতির দুই মিনিট পর গোলমুখে শট নেন পুসকাস। কিন্তু বল চলে যায় সরাসরি টুরাক এর হাতে। ৫৪ মিনিটে টথের করা শট দুইবার গোল লাইন থেকে ক্লিয়ার করেন জার্মান লেফটব্যাক কলমেয়ার। ৬৭ ও ৭৮ মিনিটে হাঙ্গেরি ভালো দুটি সুযোগ তৈরি করলেও ক্রসবার ও গোলকিপার টুরেকের কল্যাণে বেঁচে যায় জার্মানি। 

ম্যাচের তখন বাকি ছয় মিনিট। জার্মান লেফট উইংগার স্কাফার হাঙ্গেরির মিডফিল্ডার বজসিকের কাছ থেকে বল পেয়ে ক্রস করেন পেনাল্টি বক্সে। সেই শট পায়ে আসে আরেক উইংগার ২য় গোল স্কোরার রান এর পায়ে। সেইখান থেকে বল পান সেন্টার ফরোয়ার্ড ওটামার ওয়াল্টার নিচু জোরালো শটে গ্রসিকসে ফাকি দিয়ে তিন নম্বর গোল এনে দেন জার্মানিকে। 

দুই মিনিট পরেই গোল শোধ দেন পুসকাস। গোল বাতিল হয়ে যায় অফসাইডে। হাঙ্গেরিয়ান প্ল্র্যারদের মতে লিং প্রথমে গোল দিতে চাইলেও ওয়েলশ লাইন্সম্যান গ্রিফিতের সাথে আলোচনা করে বাতিল করেন গোল, যদিও টিভি ফুটেজে পুসকাসের অবস্থান সম্পর্কে পরিষ্কার ধারণা পাওয়া যাচ্ছিল না। 

দুই মিনিট পরেই গোল শোধ দেন পুসকাস। গোল বাতিল হয়ে যায় অফসাইডে। হাঙ্গেরিয়ান প্ল্র্যারদের মতে লিং প্রথমে গোল দিতে চাইলেও ওয়েলশ লাইন্সম্যান গ্রিফিতের সাথে আলোচনা করে বাতিল করেন গোল, যদিও টিভি ফুটেজে পুসকাসের অবস্থান সম্পর্কে পরিষ্কার ধারণা পাওয়া যাচ্ছিল না। 

একদম এটাকিং মুডে থাকে হাঙ্গেরি

শেষবাঁশি বাজার সাথে সাথেই শেষ হয় হাঙ্গেরির সেই গোল্ডেন জেনারেশনের অপরাজিত থাকার দৌড় আর প্রথমবারের মত চ্যাম্পিয়ন হয় পশ্চিম জার্মানি। 
এই ম্যাচে হাঙ্গেরি শট করে মোট ২৬ টি যার ১৬টিই ছিল অনটার্গেট। অন্যদিকে পশ্চিম জার্মানি শট করে ১৫টি যার দশটি ছিল অনটার্গেট। ৯ বার অফসাইডের ফাঁদে পড়ে জার্মানরা আর ৩ বার ভাগ্য সহায় হয় নি হাঙ্গেরির। 

১৯৫৬ সাল পর্যন্ত অক্ষত থাকে ‘মাইটি মাগার্স’। ১৯৫৬ সালে কোচ বদলের সাথে সাথে বাদ পড়েন পুসকাসসহ কয়েকজন ফুটবলার। ১৯৫৮ সালে এই দলের মাত্র চারজন জায়গা পান বিশ্বকাপে। ২০১৫ সালে হাঙ্গেরিয়ান শেষ মেম্বার বুজানস্কি মারা যান। একমাত্র জার্মান দলের একেল এখনও বেঁচে আছে  সেই ম্যাচের সাক্ষী হয়ে।

শেয়ার করুনঃ
আপনার মন্তব্য
আরও পড়ুন
×