সবার ওপরে মুরালিধরন

উৎপল শুভ্র

১৬ এপ্রিল ২০২১

সবার ওপরে মুরালিধরন

ইতিহাসগড়া সেই বল। ছবি: গেটি ইমেজেস

কোর্টনি ওয়ালশের রেকর্ডটা মুরালিধরনই ভেঙেছিলেন। বেশিদিন অবশ্য সেটি তাঁর অধিকারে থাকেনি। শেন ওয়ার্নের সঙ্গে এই রেকর্ড নিয়ে এমন `মিউজিক্যাল চেয়ার`-এর খেলা চলেছে যে, অনেক সময় মনে রাখাই মুশকিল হতে পড়ত, রেকর্ডটা এখন কার। ৭০৮ উইকেট নিয়ে ওয়ার্ন অবসর নেওয়ার পর রেকর্ডটিতে মুরালির প্রায় চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত নেওয়াটা নিশ্চিত হয়ে যায়। ওয়ার্নকে ছাড়িয়ে সেই পথে যাত্রা শুরু কিনা নিজের শহর ক্যান্ডিতেই!

প্রথম প্রকাশ: ৪ ডিসেম্বর ২০০৭। প্রথম আলো।

মুত্তিয়া মুরালিধরনও এখন মানবেন, রেকর্ডটা অস্ট্রেলিয়ায় না হয়েই ভালো হয়েছে! শেন ওয়ার্নের দেশে শেন ওয়ার্নের মাথা থেকে মুকুটটা কেড়ে নেওয়ার একটা বাড়তি আনন্দ নিশ্চয়ই থাকত। কিন্তু সেটি কি আর নিজের শহরে টেস্ট ক্রিকেটের বোলিংয়ের চূড়ায় উঠে যাওয়ার আনন্দের চেয়ে বেশি হতো? ব্রিসবেন বা হোবার্টে কি আর এমন ‘মুরালি’ ‘মুরালি’ চিৎকারে মুখরিত হয়ে উঠত চারপাশ, ম্যাচের মাঝেই শুরু হয়ে যেত আতশবাজির খেলা, যে সেন্ট অ্যান্থনি কলেজের বড় পরিচয় ‘মুরালিধরনের স্কুল’, সেটির কয়েক শ ছাত্রের উপস্থিতি রঙিন করে তুলত এই অবিস্মরণীয় অর্জনের শুভলগ্ন?

কাল সকালে পল কলিংউডকে বোল্ড করে মুত্তিয়া মুরালিধরন টেস্ট ক্রিকেটে ৭০৯ নম্বর উইকেটটি পাওয়ার পর এর সবই হলো। আসগিরিয়া স্টেডিয়াম আর শুধুই স্টেডিয়াম না থেকে হয়ে গেল উৎসবের এক মঞ্চ। ক্যান্ডি হয়ে গেল উৎসবের শহর, শ্রীলঙ্কা উৎসবের দেশ। ৭০৯ এমনিতে কোনো ম্যাজিক্যাল ফিগার নয়, কিন্তু শেন ওয়ার্ন ৭০৮ উইকেট নিয়ে শেষ করার পর থেকেই শয়নে-স্বপনে এই ‘৭০৯’ সংখ্যাটি দেখে এসেছেন মুরালিধরন। কাল সেটি পেরিয়ে ৭১০ উইকেট হয়ে গেল তাঁর।

শৈলনিবাস ধরনের ছোট্ট শহরটা পর্যটকদের ছুটি কাটানোর প্রিয় ঠিকানা। এই রোদ তো এই বৃষ্টি, না-গরম না-শীত। ক্যান্ডির মূল আকর্ষণ এটাই। পাহাড়ের কোল ঘেঁষে টলটলে জলের লেক; পুরাকীর্তির মর্যাদা পেয়ে যাওয়া সব মন্দির, যার একটিতে গৌতম বুদ্ধের দাঁত রাখা আছে বলে বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বীদের বিশ্বাস—এ সবকিছু ছাপিয়ে ক্রিকেটামোদীদের কাছে অনেক দিনই এটির পরিচয় ‘মুরালিধরনের শহর’। রেকর্ডটা ক্যান্ডিতে হয়েই ভালো হয়েছে!

এমন নয় যে, টেস্ট ক্রিকেটে সবচেয়ে বেশি উইকেটের রেকর্ডটা এই প্রথম আলিঙ্গনপাশে বাঁধল মুরালিধরনকে। প্রায় সাড়ে তিন বছর আগেই তো তাঁর পরিচয় এই গৌরবের সঙ্গে। ২০০৪ সালের মে মাসে কোর্টনি ওয়ালশের কাছ থেকে রেকর্ডটা কেড়ে নেওয়ার পর খুব বেশিদিন অবশ্য সেটি তাঁর অধিকারে থাকেনি। পুরো ২০০৪ সালটাই চলেছে রেকর্ড নিয়ে ওয়ার্ন-মুরালির ‘মিউজিক্যাল চেয়ার’-এর খেলা। পরবর্তী ইতিহাস; ইনজুরি, অতীত হেনস্তার প্রতিবাদে অস্ট্রেলিয়া সফরে না যাওয়া—এসবে পিছিয়ে পড়া মুরালিকে ছাড়িয়ে ওয়ার্নের অনেক দূর এগিয়ে যাওয়া। মুরালির আগেরবারের রেকর্ড গড়ার সঙ্গে এবারের পার্থক্য হলো, এখন আর কেউ তাঁর ঘাড়ের ওপর নিঃশ্বাস ফেলছে না। ওয়ার্ন অবসর নিয়ে ফেলেছেন। এখন যাঁরা খেলছেন, তাঁদের মধ্যে সবচেয়ে কাছাকাছি অনিল কুম্বলে, এবং ভারতীয় লেগ স্পিনার ‘মাত্র’ ১৩৩ উইকেট পিছিয়ে। এখন মুরালিধরনের লড়াই তাঁর নিজের সঙ্গেই।

২০১১ বিশ্বকাপ পর্যন্ত খেলবেন বলে ঘোষণা দিয়েছেন। জানিয়ে দিয়েছেন লক্ষ্যের কথাও—এক হাজার টেস্ট উইকেট! টেস্ট ক্রিকেটে প্রথম তিন শ উইকেট পাওয়ার পর ফ্রেডি ট্রুম্যান বলেছিলেন, ‘আমার রেকর্ড যে ভাঙবে, সে হবে খুবই ক্লান্ত এক লোক।’ ইংলিশ ফাস্ট বোলার বেঁচে থাকলে মুরালির মুখে হাজার উইকেটের লক্ষ্যের কথা শুনে কী বলতেন, কে জানে! ‘সময় কেমন সব পাল্টে দেয়’ ভাবতে ভাবতে হয়তো কিছু না বলে চুপই করে থাকতেন। এক হাজার টেস্ট উইকেট সম্ভব কি না—এ প্রশ্নই যে কেউ তুলছে না! এত বছরেও মুরালি-রহস্যের উত্তর খুঁজে না পাওয়া ঘূর্ণিজাদুতে বিবশ ব্যাটসম্যানদের এখনো যেমন ড্রেসিংরুমমুখী মিছিল, তাতে প্রশ্ন হলে তা হবে একটাই—কবে?

চুড়োয় উঠবার পরমুহূর্তের দৃশ্য। ছবি: গেটি ইমেজেস

টেস্ট ইতিহাসের সেরা বোলার কি না, তা নিয়ে তর্ক থাকতে পারে। তবে ‘সফলতম’ বলে তো প্রমাণ করে দিচ্ছে পরিসংখ্যানই। সফলতম তো বটেই, টেস্ট ইতিহাসের সবচেয়ে বিতর্কিত খেলোয়াড়ের নামও কি মুত্তিয়া মুরালিধরন নয়? ক্রিকেটের সবচেয়ে বড় বিতর্ক বলে বিবেচিত ‘বডিলাইন’ ছিল ক্রিকেট ট্যাকটিকস নিয়ে মত-ভিন্নমতের ব্যাপার, কিন্তু শুধুই একজন খেলোয়াড়কে নিয়ে এমন বিতর্ক, ক্রিকেট বিশ্বের দ্বিধাবিভক্ত হয়ে যাওয়ার তুল্য ঘটনা ইতিহাসে আর কই?

সাদা চোখে ব্যাটসম্যানরাই ছিল প্রতিপক্ষ, কিন্তু শুধু কি তাঁরাই? ক্যান্ডি থেকে ৬ কিলোমিটার দূরের শহরতলি কুন্ডেসালের বিস্কুট ফ্যাক্টরির মালিকের ছেলের প্রতিপক্ষ ছিল ক্রিকেট আইন, জন্মগতভাবেই বিকৃত হাতের কারণে অদ্ভুতুড়ে বোলিং অ্যাকশন নিয়ে হাজারো কটাক্ষ আর গায়ে লাগিয়ে দেওয়া ‘প্রতারক’ তকমাটিও।

দিনের পর দিন এসবের সঙ্গে লড়ে মুত্তিয়া মুরালিধরন আজ যে পাহাড়চুড়োয়, সেটি আসলে ৭১০ উইকেটের চেয়েও অনেক বেশি উঁচু।

আরও পড়ুন......
মুরালিধরন ‘জিনিয়াসের’ ব্যাখ্যা খুঁজতে কুন্ডেসালে মুরালিধরনের বাড়িতে
ক্রিকেটীয় রূপকথা লিখে শেষ মুরালির
সেই মুরালি এই মুরালি
‘আমার শুধু বোলিং করে যেতে ইচ্ছে করে’

 

সম্পর্কিত বিষয়:

শেয়ার করুনঃ
আপনার মন্তব্য
আরও পড়ুন
×