তাঁরা দুজন: লক্ষ্য এক, পথ ভিন্ন
ব্যাটিংয়ের মতো ব্যক্তিত্বে-চরিত্রেও ওয়ার্ল্ড টেস্ট চ্যাম্পিয়নশিপের প্রথম ফাইনালের দুই দলের অধিনায়ক দাঁড়িয়ে বিপরীত দুই মেরুতে। একটু ভিন্নভাবে ভাবতে গিয়ে অবাক হয়ে গেলাম এই আবিষ্কারে, চাইলে তো দুজনের মধ্যে তাঁদের দেশের প্রতিচ্ছবিও খুঁজে পাওয়া যায়।
ফায়ার অ্যান্ড আইস!
চক অ্যান্ড চিজ!
প্রথমটার সহজেই বাংলা করা যাচ্ছে। দ্বিতীয়টাতেই সমস্যা।
সমস্যা যখন, তখন বাংলা না করলেই তো হয়। ‘আগুন আর বরফ’ দিয়েই তো যা বোঝানোর, তা দারুণ বোঝানো যাচ্ছে। কোন দুজন, তা কি আর বলতে হবে? উপরের ছবিটা দেখেই কি আপনি তা বুঝে ফেলেননি!
বিরাট কোহলি আর কেন উইলিয়ামসন।
ওয়ার্ল্ড টেস্ট চ্যাম্পিয়নশিপের প্রথম ফাইনালটা ভারত আর নিউজিল্যান্ডই খেলছে, এটা নিশ্চিত হওয়ার পর থেকেই ‘ফায়ার অ্যান্ড আইস’, ‘চক অ্যান্ড চিজ’ হয়ে এই দুজন মাথায় ঘুরছেন। এমন না যে, এর আগে কখনো কোহলি বনাম উইলিয়ামসন হয়নি। তারপরও ওয়ার্ল্ড টেস্ট চ্যাম্পিয়নশিপের প্রথম ফাইনাল বলে কথা। এ কারণেই হয়তো যুযুধান দুই অধিনায়কের বৈপরীত্যটা এমন বড় হয়ে চোখে পড়ছে।
যা শুধু ব্যক্তিতেই শেষ হচ্ছে না। ফাইনালের দুটি দেশকে বোঝাতেও দুই অধিনায়ক আশ্চর্য প্রতীকী রূপে দেখা দিচ্ছেন। বিরাট কোহলিই তো ভারত। কেন উইলিয়ামসনই নিউজিল্যান্ড। তা দল তো অধিনায়কের নামাঙ্কিতই হওয়ার কথা। বিশেষ করে ক্রিকেট দল। কোচিং স্টাফের বহর দিনকে দিন বড় হতে থাকার পরও এখনো যা ‘ক্যাপ্টেনস্ গেম’-ই হয়ে আছে। কোহলিই ভারত, উইলিয়ামসনই নিউজিল্যান্ড...এতে তাই এমন অবাক হওয়ার কী আছে, এটাই বলবেন তো?
ভারত-নিউজিল্যান্ড বলতে এখানে ক্রিকেট দল নয়, বোঝাচ্ছি ‘দেশ’–এটা বললে আশা করি, ঘুরিয়ে-পেঁচিয়ে বলা কথাটা পরিষ্কার হয়ে যাবে। এবার বিরাট কোহলির কথা ভাবুন, সঙ্গে ভারতের কথা। এরপর আসুন কেন উইলিয়ামসন আর নিউজিল্যান্ডে। শুধু ব্যাটসম্যান কোহলি-উইলিয়ামসন নিয়ে ভাবলেও চলবে, তবে আরও ভালো হয় তাঁদের ব্যক্তিত্ব-চরিত্র-প্রকাশভঙ্গি পুরোটা সমেত ভাবলে। দেখুন তো, কোহলির মধ্যে ভারত ফুটে ওঠে কি না, উইলিয়ামসনের মধ্যে নিউজিল্যান্ড?
হইচই, কোলাহল, উত্তেজনা, আবেগ...এই জাতীয় শব্দগুলো দিয়ে আপনি ভারতকে যেমন বোঝাতে পারবেন, তেমনি বিরাট কোহলিকেও।
শান্তি, নীরবতা, নির্বিরোধ, নিরুদ্বেগ...এসব নিউজিল্যান্ডের প্রতিশব্দ হিসেবে যেমন দারুণ মানিয়ে যায়, তেমনি কেন উইলিয়ামসনের সঙ্গেও।

লক্ষ্মণরেখাটা দুই অধিনায়কের নিজ নিজ দেশের ক্রিকেটে এঁকে দিলেও তো পার্থক্যটা একই রকম থাকে।
ভারতে ক্রিকেট অনেক দিনই খেলার সীমানা ছাড়িয়ে এক উন্মাদনার নাম। ক্রিকেটাররা একেকজন তারকার গন্ডি ছাড়িয়ে পরিণত 'ডেমি গড'-এ। এমনই যে, ক্রিকেটের নতুন সংজ্ঞা হিসেবে বহুদিনই চালু হয়ে গেছে কথাটা, ক্রিকেট ইজ অ্যান ইন্ডিয়ান গেম অ্যাক্সিডেন্টালি ইনভেন্টেড বাই দ্য ইংলিশ।
নিউজিল্যান্ডেও একটা খেলা নিয়ে প্রায় একই রকম উন্মাদনার সঙ্গে প্রত্যক্ষ পরিচয় হয়েছে অনেকবার। তবে সেটির নাম ক্রিকেট নয়, ওই খেলাটাকে 'রাগবি' বলে। নিউজিল্যান্ডেও খেলোয়াড়েরা 'ডেমি গড' হিসেবে বিবেচিত হন। তবে শর্ত একটাই। তাঁকে 'অল ব্ল্যাকস'-এর হয়ে খেলতে হবে। 'ব্ল্যাক ক্যাপস'-এর হয়ে নয়।
বিরাট কোহলি ভারতের রাস্তায় বেরোলে কিছুক্ষণের মধ্যেই দাঙ্গা পুলিশের ডাক পড়াটা অনিবার্য। রাস্তা পর্যন্ত যাওয়ারই বা কী দরকার, মাঠ থেকে ফিরে হোটেলের লবি থেকে লিফটে উঠতেই তো কোহলিকে রীতিমতো 'লড়াই' করতে দেখেছি। ২০১৭ সালের ফেব্রুয়ারিতে হায়দরাবাদে তাজ কৃষ্ণা হোটেলের লবিতে কোহলির সঙ্গে সেলফি তোলার জন্য মা-মেয়ের মধ্যে রীতিমতো 'যুদ্ধ' লেগে যেতেও। পরে লিফটে যেটির সরস বর্ণনা শুনেছি খোদ বিরাট কোহলির মুখেই।
আর উইলিয়ামসন? হ্যামিল্টন-ওয়েলিংটনের রাস্তায় তাঁকে নিশ্চিন্তে ঘুরে বেড়াতে দেখেছি। এবং একটুও অবাক হইনি। কারণ ততদিনে চার-পাঁচটি নিউজিল্যান্ড ট্যুর করে ফেলেছি বলে অবাক হওয়ার কোর্সটা ২০০১ সালে প্রথম ট্যুরেই সারা হয়ে গেছে। যখন ওই হ্যামিল্টনেই সেভাবে কারও মনোযোগ আকর্ষণ না করেই হেঁটে যেতে দেখেছি স্যার রিচার্ড হ্যাডলিকে। যা নিয়ে বিস্ময় প্রকাশ করায় রিচার্ড হ্যাডলি ততোধিক বিস্মিত হয়ে পাল্টা প্রশ্ন করেছেন, 'হোয়াটস্ দ্য বিগ ডিল?'
ভারতীয় ক্রিকেট জনপ্রিয়তা আর অর্থবলে বলীয়ান হয়ে কখনো কখনো উদ্ধত আর মারমুখী। ঠিক বিরাট কোহলির মতো।
নিউজিল্যান্ডের ক্রিকেট সৌম্য, শান্ত, নির্বিরোধ। ঠিক যেন কেন উইলিয়ামসন।

চাইলে দুই দেশের ঘরোয়া টি-টোয়েন্টি লিগ দিয়েও তো দুজনকে খুব ভালো বোঝানো যায়। ভারতের ঘরোয়া টি-টোয়েন্টি লিগের নাম জানে না, ক্রিকেট বিশ্বে এমন কাউকে খুঁজে বের করার জন্য কোটি টাকা পুরস্কার ঘোষণা করাতেও কোনো ঝুঁকি নেই। আইপিএলে অর্থের এমনই ঝনঝনানি যে, ক্রিকেটের সীমানা ছাড়িয়ে প্রায়ই তা বৈশ্বিক অন্য সব ক্রীড়া আয়োজনের সঙ্গে তুলনায় চলে আসে। নিউজিল্যান্ডেরও একটা ঘরোয়া টি-টোয়েন্টি লিগ আছে। কিন্তু 'সুপার স্ম্যাশ' বললে ক্রিকেটের বাকি দুনিয়ার কজন তা সঙ্গে সঙ্গে বুঝে ফেলবেন, এ নিয়ে ঘোরতর সন্দেহ আছে। টাকাপয়সার হিসাবে আর না-ই গেলাম। কোহলি আর উইলিয়ামসন এখানেও নিজ নিজ দেশের যথার্থ প্রতিনিধি। যদিও 'সুপার স্ম্যাশ' নামটা একটু ঝামেলা করছে। এটা যে উইলিয়ামসনের সঙ্গে একেবারেই যায় না। কোহলির সঙ্গে বরং খুব ভালো যায়।

খেলার সীমারেখা মুছে দিয়ে আবার যদি দেশে ফিরি, প্রথম টেস্ট চ্যাম্পিয়নশিপের দুই ফাইনালিস্ট আরেকটা বিবেচনাতেও তো পুরো বিপরীত মেরুতে দাঁড়িয়ে। টেস্ট প্লেয়িং দেশগুলোর মধ্যে ভারত সবচেয়ে জনবহুল দেশ। আর নিউজিল্যান্ডের জনসংখ্যা সবচেয়ে কম। হ্যাঁ, টেস্ট পরিবারের নবীন দুই সদস্য আয়ারল্যান্ড ও আফগানিস্তানকেও হিসাবে নিয়েই।
দেখতেই পাচ্ছেন, 'ফায়ার অ্যান্ড আইস' বা 'চক অ্যান্ড চিজ' কথাগুলোর ব্যবহার অনেক ব্যাপ্তি নিয়ে ফেলছে। তবে প্রথম তো সেটি মাথায় এসেছিল কোহলি আর উইলিয়ামসনের পার্থক্য বোঝাতেই। সেই পার্থক্য শুধু দুজনের ব্যক্তিত্ব, মাঠে আবেগের প্রকাশ এসবেই নয়, ব্যাটিংয়ের ধরনেও। ব্যাটসম্যান হিসেবে দুজনের মধ্যে একটাই মিল। তা হলো রান করায়। ব্যাটিংয়েই ব্যাটসম্যানের ব্যক্তিত্বের প্রতিফলন ঘটে বলে যে কথাটা খুব প্রচলিত, এর সবচেয়ে বড় উদাহরণও হতে পারেন এই দুজনই।
কোহলির ব্যাটিং তাঁর মতোই উদ্ধত, আত্মগর্বী, দুবির্নীত–যা থেকে ফুটে বেরোয় প্রতিপক্ষকে দুমড়ে মুচড়ে দেওয়ার প্রতিজ্ঞা।
উইলিয়ামসনের ব্যাটিং তাঁর মতোই নরম, পেলব, বিনয়ী–মাখনে ছুরি চালানোর মতো মসৃণ স্ট্রোক প্লেতে বুঝতে না বুঝতেই প্রতিপক্ষের সর্বনাশ হয়ে যায়।
মাঠে টগবগ করে ফুটতে থাকা কোহলি যেন যেকোনো মুহূর্তে বিস্ফোরিত হতে অপেক্ষমান এক মানব-বোমা। আর শান্ত, নিরাবেগ উইলিয়ামসন যেন ধ্যানমগ্ন এক ঋষি। দুজনেরই অভিন্ন লক্ষ্য, তবে তাতে পৌঁছানোর উপায়ে এমনই ভিন্নতা যে, একেবারেই অন্য প্রসঙ্গে বলা শ্রী রামকৃষ্ণ পরমহংস দেবের বাণীটা মনে পড়ে যায়। যত মত তত পথ।

এখানে দুজনের পথের চূড়ান্ত গন্তব্য যদি 'ক্রিকেটীয় গ্রেটনেস'কে ধরি, সেই গন্তব্য কিন্তু দৃশ্যমান। তা বোঝাতে পরিসংখ্যানের দ্বারস্থ হওয়া ছাড়া গতি নেই। কিন্তু লেখাটাকে যে সংখ্যা দিয়ে ভারাক্রান্ত করতে ইচ্ছা করছে না। ব্যাটসম্যান হিসেবে কে এগিয়ে, এই আলোচনাও তাই স্থগিত রাখতে হচ্ছে। লেখাটা শুরু করার আগে যদিও বিষয় হিসেবে প্রাথমিক চিন্তা সেরকমই ছিল বলে বিস্তর নোট-টোটও নিয়েছিলাম। আপাতত তা নয় অব্যবহৃতই থাকল, পরে কোনো লেখায় নিশ্চয়ই তা কাজে আসবে। এই দুজনের গল্প তো এখনো অনেক বাকি।
সেজন্য অপেক্ষা মানতে যদি আপনার আপত্তি থাকে, লেখার সঙ্গে দুটি ছক তো রইলই। একটা শুধুই ব্যাটসম্যান কোহলি-উইলিয়ামসনের, আরেকটা যখন তাঁরা অধিনায়ক। সংখ্যা দিয়ে কোহলি-উইলিয়ামসনকে বিচার করার নীরস কাজটা আপনার ওপরই চাপিয়ে দিয়ে আমি দুজনের ভিন্নতার সৌন্দর্যে বুঁদ হয়ে থাকতে চাই।










