টি-টোয়েন্টিতে বাংলাদেশের `প্রথম` জয়ের গল্প

অস্ট্রেলিয়ার বিপক্ষে পঞ্চম ম্যাচে, অন্যদের কী খবর

উৎপল শুভ্র

৪ আগস্ট ২০২১

অস্ট্রেলিয়ার বিপক্ষে পঞ্চম ম্যাচে, অন্যদের কী খবর

সময়ের হিসেবে ১৪ বছর হলেও ম্যাচ তো মাত্র ৫টি। পঞ্চম ম্যাচে এসে টি-টোয়েন্টিতে অস্ট্রেলিয়ার বিপক্ষে প্রথম জয়। অন্য সব `বড়` দলগুলোকে হারাতে কত ম্যাচ অপেক্ষা করতে হয়েছিল বাংলাদেশকে?

টি-টোয়েন্টি যুগের একেবারে শুরুর দিকেই দুই দলের প্রথম দেখা। তারপরও এই সিরিজের আগে ১৪ বছরে কিনা অস্ট্রেলিয়ার বিপক্ষে মাত্র ৪টি টি-টোয়েন্টি! সেই ৪টিও টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপের কল্যাণে। ২০০৭ সালে দক্ষিণ আফ্রিকায় প্রথম টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপে অস্ট্রেলিয়ার সঙ্গে খেলার সুযোগটা অবশ্য আইসিসি করে দেয়নি। বাংলাদেশই তা আদায় করে নিয়েছিল। প্রাথমিক পর্বে তিন দলের গ্রুপে রানার্স আপ হয়ে সুপার এইটে। সেখানেই চার দলের গ্রুপে পেয়েছিল অস্ট্রেলিয়াকে। কেপটাউনের সেই ম্যাচটা স্মরণীয় হয়ে আছে টি-টোয়েন্টিতে প্রথম হ্যাটট্রিকের কারণে। সেই হ্যাটট্রিক বাংলাদেশকেই পুড়িয়েছিল। বোলারের নাম ব্রেট লি।

এরপর ২০১০, ২০১৪ ও ২০১৬ টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপে আরও তিনটি বাংলাদেশ-অস্ট্রেলিয়া ম্যাচ, তিনটিতেই বাংলাদেশের পরাজয়। টি-টোয়েন্টিতে অস্ট্রেলিয়াকে হারানোর অপেক্ষার অবসান পঞ্চম ম্যাচে এসে। এরই সূত্র ধরে একটা কৌতূহল জাগল মনে, প্রথম জয় পেতে কোন দেশের বিপক্ষে কত ম্যাচ খেলতে হয়েছে বাংলাদেশকে। 

এই আলোচনায় যাওয়ার আগে একটা মানদণ্ড ঠিক করে নেওয়া উচিত বলে মনে হচ্ছে। এক শর বেশি দেশ এখন টি-টোয়েন্টি খেলে। আইসিসির সহযোগী সদস্য দেশগুলোর মধ্যকার টি-টোয়েন্টি ম্যাচও এখন আন্তর্জাতিক বলে স্বীকৃত। বাংলাদেশও হংকং, সংযুক্ত আরব আমিরাত, ওমান, নেদারল্যান্ড, নেপাল, স্কটল্যান্ড, কেনিয়া এমন সব সহযোগী সদস্য দেশের সঙ্গে টি-টোয়েন্টি খেলেছে। ২০১৪ বিশ্বকাপে হংকংয়ের বিপক্ষে একমাত্র ম্যাচটিতে হেরে বসার তিক্ত অভিজ্ঞতাও হয়েছে। 

এসব বাইরে থাকুক, বাইরে থাকুক জিম্বাবুয়েও, যে দলগুলো ‘বড়’ বলে স্বীকৃত, তাদের বিপক্ষে টি-টোয়েন্টিতে প্রথম জয় পেতে বাংলাদেশকে কত ম্যাচ খেলতে হয়েছে, সেই হিসাবটাই বরং করি। প্রথমে বলে নিই, এখনো টি-টোয়েন্টিতে বাংলাদেশের অবধ্য আছে কোন কোন ‘বড়’ দল। প্রথমেই আসবে নিউজিল্যান্ডের নাম। যাদের বিপক্ষে দশ-দশটি ম্যাচ খেলেও বাংলাদেশের কোনো জয় নেই। জয় নেই দক্ষিণ আফ্রিকার বিপক্ষেও। ছয় ম্যাচ খেলে ছয়টিতেই পরাজয়। ইংল্যান্ডের বিপক্ষেও টি-টোয়েন্টিতে বাংলাদেশের কোনো জয় নেই। তা থাকা সম্ভবও নয়। এই রেকর্ড ঘাঁটতে গিয়েই প্রথম খেয়াল করলাম, বাংলাদেশ-ইংল্যান্ড কোনো টি-টোয়েন্টি ম্যাচ এখনো হয়ইনি। বাংলাদেশ জিতেছে, এমন বড় দলগুলোর তালিকায় তাই চারটি নাম: ওয়েস্ট ইন্ডিজ, শ্রীলঙ্কা, পাকিস্তান ও ভারত। প্রথম জয়ের স্মৃতিচারণাটা সাফল্যের ক্রমানুসারেই না হয় আসুক।

২০০৭ টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপে প্রথম দেখাতেই ওয়েস্ট ইন্ডিজকে হারিয়ে দেওয়ার পর

প্রথম দেখাতেই ওয়েস্ট ইন্ডিজ
ম্যাচ ১২, জয় ৫, পরাজয় ৬, পরিত্যক্ত ১

যাদের বড় দল বলছি, তাদের মধ্যে বাংলাদেশের জন্য সবচেয়ে সুখস্মৃতির নাম ওয়েস্ট ইন্ডিজ। জয়-পরাজয়ের রেকর্ড হিসাব করলে ক্যারিবিয়ানদের বিপক্ষে বাংলাদেশের রেকর্ডই সবচেয়ে ভালো। প্রথম দেখাতেই বাংলাদেশের জয়ও শুধু ওয়েস্ট ইন্ডিজের বিপক্ষেই। সেটি ২০০৭ সালের প্রথম টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপে। জোহানেসবার্গে মোহাম্মদ আশরাফুলের ২৭ বলে ৬১ রানের অবিশ্বাস্য এক ইনিংসের কল্যাণে পাওয়া সেই জয়েই বাংলাদেশের সেই বিশ্বকাপের সুপার এইটে উঠে যাওয়া। এর আগে ক্রিস গেইলের সেঞ্চুরির পরও টুর্নামেন্টের উদ্বোধনী ম্যাচে দক্ষিণ আফ্রিকার কাছে হেরেছে ওয়েস্ট ইন্ডিজ। বাংলাদেশের বিপক্ষে পরাজয় তাই প্রথম পর্ব থেকেই বিদায় করে দিয়েছিল টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপ ইতিহাসের সফলতম দলকে।

প্রথম দেখাতেই হারিয়ে দেওয়ার আত্মবিশ্বাসই কারণ কি না কে জানে, টি-টোয়েন্টির সবচেয়ে সমীহ জাগানো দলটিকে এরপর আরও চারবার হারিয়েছে বাংলাদেশ। পরের জয়টা তৃতীয় ম্যাচেই। ২০১১ সালে মিরপুরে সেই ম্যাচ দিয়ে মুশফিকুর রহিমের অধিনায়কত্বে অভিষেক। ২৬ বলে অপরাজিত ৪১ রানে সেই জয়ে নেতৃত্ব দিয়ে ম্যাচ-সেরাও মুশফিক।

এরপর টি-টোয়েন্টিতে আরও যে তিনবার ওয়েস্ট ইন্ডিজকে হারিয়েছে বাংলাদেশ, এর মধ্যে সবচেয়ে স্মরণীয় ২০১৮ সালে ওয়েস্ট ইন্ডিজ সফরে (শেষ দুটি ম্যাচ অবশ্য হয়েছিল যুক্তরাষ্ট্রের ফ্লোরিডায়) তিন ম্যাচ সিরিজের শেষ দুটিতে জয়। টি-টোয়েন্টির বিশ্ব চ্যাম্পিয়নদের বিপক্ষে পরভূমে সিরিজ জয় ক্রিকেটের সংক্ষিপ্ততম সংস্করণে তর্কযোগ্যভাবে বাংলাদেশের সেরা সাফল্য।

শ্রীলঙ্কার বিপক্ষে টি-টোয়েন্টিতে প্রথম জয়ে ম্যাচ-সেরা সাব্বির রহমান। ছবি: এপি

ওয়েস্ট ইন্ডিজের পরই শ্রীলঙ্কা
১১ ম্যাচ, জয় ৪, পরাজয় ৭

অস্ট্রেলিয়াকে হারাতে যেমন পঞ্চম ম্যাচ পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হয়েছে, শ্রীলঙ্কাকে হারাতেও তা-ই। ঢাকায় ২০১৬ এশিয়া কাপে জয়খরা ঘুচে যাওয়ার পর থেকে অবশ্য বাংলাদেশের প্রিয় টি-টোয়েন্টি প্রতিপক্ষ হিসেবে ওয়েস্ট ইন্ডিজের প্রতিদ্বন্দ্বীই হয়ে উঠেছে শ্রীলঙ্কা। এশিয়া কাপের সেই জয় থেকে ধরলে সর্বশেষ সাত ম্যাচের চারটিতেই জিতেছে বাংলাদেশ। এর মধ্যে সর্বশেষ দুই ম্যাচেই, সেটাও আবার শ্রীলঙ্কার মাটিতে নিদাহাস ট্রফিতে স্বাগতিকদের বিদায় লিখে দিয়ে। লেখাটা যেহেতু প্রথম জয় নিয়ে, সেই জয়ের নায়কের নামটাও বলা উচিত। বাংলাদেশের ব্যাটসম্যানদের মধ্যে প্রথম টি-টোয়েন্টি স্পেশালিস্ট হিসেবে পরিচিতি পাওয়া সাব্বির রহমান।  ১০টি চার ও ৩টি ছয়খচিত ৫৪ বলে ৮০ রানের সেই ইনিংসটা বাংলাদেশের টি-টোয়েন্টি ইতিহাসের সেরা বলে দাবি জানাতেই পারে।

মোস্তাফিজুর রহমানের আন্তর্জাতিক অভিষেকের সঙ্গে মিলে গিয়েছিল পাকিস্তানের বিপক্ষে টি-টোয়েন্টিতে বাংলাদেশের প্রথম জয়। ছবি: এএফপি

পাকিস্তানের বিপক্ষে টানা দুই
১২ ম্যাচ, জয় ২, পরাজয় ১০

প্রথম জয় টানা সাত ম্যাচ হারার পর। অষ্টম ম্যাচে এসে জয়টা ২০১৫ সালের স্মরণীয় সেই সিরিজে। সিরিজের একমাত্র টি-টোয়েন্টিতে এই জয়ের আগে ৩-০ ম্যাচে ওয়ানডে সিরিজ জিতেছে বাংলাদেশ। যে পাকিস্তানকে ১৯৯৯ বিশ্বকাপে সেই ঐতিহাসিক জয়ের পর হারানোই যাচ্ছিল না, তাদের বিপক্ষে টানা চার জয়ে সূচনা হয়েছিল বাংলাদেশের ক্রিকেট ইতিহাসের সবচেয়ে স্মরণীয় মৌসুমের। পরের বছর এশিয়া কাপে পাকিস্তানকে আবারও হারায় বাংলাদেশ। এরপর অবশ্য সর্বশেষ তিনটি ম্যাচেই পরাজয় মানতে হয়েছে। শ্রীলঙ্কার বিপক্ষে প্রথম জয়ের মতো পাকিস্তানের বিপক্ষে প্রথম জয়েও ম্যাচ-সেরার স্বীকৃতি সাব্বিরের। বাংলাদেশের ইনিংসে সর্বোচ্চ রান ছিল সাকিবের (৪১ বলে ৫৭), তবে ৬ রান কম করলেও সাব্বিরের স্ট্রাইক রেট ছিল প্রায় ৩৩ বেশি (৩২ বলে ৫১)। বাংলাদেশের ক্রিকেট ইতিহাসে এই ম্যাচটা অবশ্য বেশি স্মরণীয় হয়ে আছে মোস্তাফিজুর রহমান নামে প্রায় অজানা-অচেনা এক তরুণের আন্তর্জাতিক অভিষেকের কারণে। অভিষেকে ২০ রানে ২ উইকেট নিয়েছিলেন মোস্তাফিজ, দুই শিকার শহীদ আফ্রিদি ও মোহাম্মদ হাফিজ।

ভারতের বিপক্ষে টি-টোয়েন্টিতে প্রথম জয়ে প্রায়শ্চিত্ত হয়েছিল মুশফিক ও মাহমুদউল্লাহর। ছবি: এএফপি

ভারতের বিপক্ষে প্রথমটাই এখনো শেষ
১১ ম্যাচ, জয় ১, পরাজয় ১০

টানা আট ম্যাচে হারার পর ভারতের বিপক্ষে প্রথম জয় এবং সেই জয় এমন সময়ে, যখন কেউ তা আশা করেছিলেন বলে মনে হয় না। ২০১৯ সালে বাংলাদেশ দল ভারত সফরে যাওয়ার ঠিক আগে ফিক্সিংয়ের প্রস্তাব পেয়েও তা গোপন করার অপরাধে নিষিদ্ধ হলেন অধিনায়ক সাকিব আল হাসান, তড়িঘড়ি করে মাহমুদউল্লাহকে অধিনায়ক করা হলো হতচকিত এক দলের। সেই দলই দিল্লিতে টি-টোয়েন্টি সিরিজের প্রথম ম্যাচেই হারিয়ে দিল ভারতকে। ৪৩ বলে ৬০ রান করে ম্যাচ-সেরা হয়েছিলেন মুশফিকুর রহিম। বাংলাদেশের জয়ের সময় উইকেটে তাঁর সঙ্গী মাহমুদউল্লাহ। প্রায়শ্চিত্তের এর চেয়ে বড় উদাহরণ ক্রিকেটে খুব বেশি নেই। সাড়ে তিন বছর আগে বেঙ্গালুরুতে টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপে ভারতের বিপক্ষে অবিশ্বাস্য ওই পরাজয় ডেকে আনার প্রায়শ্চিত্ত। জিততে যখন ৩ বলে ২ রান লাগে, পরপর দুই বলে একই রকম শট খেলে মুশফিক ও মাহমুদউল্লাহর আউট হয়ে যাওয়ার দৃশ্য এখনো মানুষের চোখে ভাসে। এই জয়ে সেই দুঃস্বপ্নকে কিছুটা হলেও ভুলতে পেরেছিলেন এঁরা দুজন। 

এবং আফগানিস্তান ও আয়ারল্যান্ড

শুধু 'বড়' দলেই আলোচনাটা সীমাবদ্ধ রাখব বলেছিলাম, তবে শেষে এসে মনে হচ্ছে, আফগানিস্তান ও আয়ারল্যান্ডের কথা একটু হলেও উল্লেখ করা উচিত। বিশেষ করে আফগানিস্তান। আয়ারল্যান্ডের বিপক্ষে টি-টোয়েন্টিতে প্রথম ম্যাচেই (২০০৯ বিশ্বকাপে) হারার পর টানা তিন ম্যাচ জিতেছে বাংলাদেশ। আফগানিস্তানের বিপক্ষে প্রথম ম্যাচেই জিতেছে, জিতেছে সর্বশেষ ম্যাচেও। কিন্তু এই দুই জয়ের মাঝখানে টানা চার ম্যাচে পরাজয়। আফগানিস্তানের বিপক্ষে বাংলাদেশের টি-টোয়েন্টি রেকর্ডটা (জয় ২, পরাজয় ৪) তাই যথেষ্টই বিব্রতকর।

শেয়ার করুনঃ
আপনার মন্তব্য
আরও পড়ুন
×