সমস্যা শুধু ব্যাটিং-বোলিংয়ে নয়, মাথায়ও!

উৎপল শুভ্র

৯ ডিসেম্বর ২০২১

সমস্যা শুধু ব্যাটিং-বোলিংয়ে নয়, মাথায়ও!

অভাবনীয় জয়ের আনন্দ এমন বাঁধনহারাই হয়! ছবি: বিসিবি

প্রথম দুদিনে যে টেস্টে খেলা হয়েছে মাত্র ৬৩.২ ওভার, তৃতীয় দিনের পুরোটাই ধুয়ে গেছে বৃষ্টিতে; সেই টেস্টেরই কিনা এমন রোমাঞ্চকর সমাপ্তি! রেজাল্ট তো হলোই, তার আগে তা ছড়াল রুদ্ধশ্বাস উত্তেজনাও। পুরো পাঁচ দিনের সবকিছু যেন ঠেসেঠুসে এই টেস্টের আয়ুষ্কাল দিন আড়াইয়ের মধ্যে ঢুকিয়ে দেওয়া। শুধু টেস্ট ক্রিকেট বলেই যা সম্ভব। হয়তো একটি দল বাংলাদেশ বলেও।

টেস্ট ম্যাচের বিজ্ঞাপন হিসেবে এর চেয়ে আদর্শ আর কিই-বা হতে পারে! প্রথম দুদিনে যে টেস্টে খেলা হয়েছে মাত্র ৬৩.২ ওভার, তৃতীয় দিনের পুরোটাই ধুয়ে গেছে বৃষ্টিতে; সেই টেস্টেরই কিনা এমন রোমাঞ্চকর সমাপ্তি! রেজাল্ট তো হলোই, তার আগে তা ছড়াল রুদ্ধশ্বাস উত্তেজনাও। পুরো পাঁচ দিনের সবকিছু যেন ঠেসেঠুসে এই টেস্টের আয়ুষ্কাল দিন আড়াইয়ের মধ্যে ঢুকিয়ে দেওয়া। শুধু টেস্ট ক্রিকেট বলেই যা সম্ভব। সবাই হাততালি দিন ভাই। জোরে হাততালি দিন।

কই, হাততালির শব্দ তো শোনা যাচ্ছে না! কিভাবে শোনা যাবে? ওপরে টেস্ট ক্রিকেটের যে গুণকীর্তন করা হলো, নিরপেক্ষ দর্শক তাতে মোহিত হতে পারেন। ও হ্যাঁ, পাকিস্তানি দর্শকও। কিন্তু বাংলাদেশের দৃষ্টিকোণ থেকে দেখলে টেস্ট ক্রিকেটের মহিমায় আচ্ছন্ন হওয়ার সুযোগ কোথায়? অন্য অনেক অনুভূতি তীব্র হয়ে ওঠে তখন। অবিশ্বাস-রাগ-ক্ষোভ-হতাশা...। দিন আড়াইয়ের টেস্ট বলেছিলাম, আসলে তো আড়াই দিনও নয়। একেবারে কাঁটায় কাঁটায় হিসাব করলে আড়াই দিনে ২২৫ ওভার, খেলা তো হয়েছে আরও ১০ ওভার কম। এই সময়ের মধ্যেই ইনিংসে হারার প্রায় অসাধ্য কাজটা করে ফেলার পর টেস্ট ক্রিকেটের বৃহত্তর চেতনায় উদ্বুদ্ধ হওয়াটা একটু কঠিনই বটে। 

অসাধ্য-এর আগে ‘প্রায়’ শব্দটাও রাখতে হচ্ছে, কিছুক্ষণ আগেই ঘটনাটা চোখের সামনে ঘটতে দেখেছি বলে। নইলে এই টেস্ট হারার সাধ্য কয়টা দলের আছে? আগের দিন বিকালে বোধবুদ্ধিহীন ব্যাটিংয়ে ৭১ রানে ৭ উইকেট হারিয়ে ফেলার পর আজ সকালে ৮৭ রানেই শেষ বাংলাদেশের প্রথম ইনিংস। দ্বিতীয় ইনিংসের ২০৫ সে তুলনায় অনেক ভালো। টেস্ট ক্রিকেটে ২০৫-কেই ’অনেক ভালো’ মনে হওয়া থেকেই বুঝে নেওয়া যায় ব্যাটিংয়ের ছিরি। সাজিদ খান: আগের তিন টেস্টে ৬ উইকেট, এই এক টেস্টেই ১২! ছবি: বিসিবি

চতুর্থ দিন বিকালে বাংলাদেশের ব্যাটসম্যানদের ব্যাটিং অ্যাপ্রোচ দেখে বিস্মিত হয়েছিলাম। আর ম্যাচশেষের ভার্চুয়াল সংবাদ সম্মেলনে অধিনায়ক মুমিনুল হকের কথা শুনে শুধু বিস্মিত নয়, হতবুদ্ধি হয়ে গেলাম। বাংলাদেশের ব্যাটসম্যানদের অমন অ্যাগ্রেসিভ মেজাজ নিয়ে নামার পেছনের চিন্তাটা জানতে চেয়েছিলেন এক সাংবাদিক। মুমিনুল অবলীলায় দাবি করলেন, ’কই, কেউই তো অ্যাগ্রেসিভ খেলেনি।’ প্রশ্নটা শুনে যারপরনাই অবাক হওয়ার কথাও জানিয়ে দিলেন অম্লান বদনে। যা শুনে মনে হলো, শুধু মাঠেই নয়, মাঠের বাইরেও চিন্তাভাবনায় অন্ত:সারশূন্যতায় বাংলাদেশ দল পুরো ক্রিকেট বিশ্বকে চমকে দেওয়ার প্রতিজ্ঞা নিয়ে নেমেছে।

চিন্তাভাবনায় অন্ত:সারশূন্যতার আরও উদাহরণ চান? চট্টগ্রামে প্রথম টেস্টের মতো মিরপুরেও বাংলাদেশের ব্যাটিং মাথাহীন শরীর। ওপরে কিচ্ছু নেই। প্রথম ইনিংসে প্রথম চার ব্যাটসম্যানের মধ্যে নাজমুল হোসেন শান্ত তা-ও ৩০ রান করতে সক্ষম হয়েছিলেন, দ্বিতীয় ইনিংসে চারজনই এক অঙ্কের গান গাইতে গাইতে ফিরলেন। সাদমান ২, জয় ৬, শান্ত ৬, মুমিনুল ৭। সিরিজে বাংলাদেশের চারটি ইনিংসেরই শুরু আসলে পাঁচ নম্বর ব্যাটসম্যানকে দিয়ে। প্রথম তিনটিতে এমন হওয়ার পরও কেন ব্যাটিং অর্ডারটা একটু বদলে দেওয়ার কথা কারও মাথায় এলো না?

২০০১ সালে ভারত-অস্ট্রেলিয়ার বিখ্যাত সেই ইডেন টেস্টের কথা কি আপনাদের মনে আছে? ভারতের ১৭১ রানের প্রথম ইনিংসে ছয় নম্বরে নেমে সর্বোচ্চ ৫৯ রান করে শেষ ব্যাটসম্যান হিসেবে আউট হয়েছেন ভেঙ্কট লক্ষ্মণ। আউট হয়ে ফেরার পর তাঁকে আর প্যাড খুলতে দেননি কোচ জন রাইট আর অধিনায়ক সৌরভ গাঙ্গুলী। ভারত যে তখন ফলো অন করছে এবং লক্ষ্মণকে স্বচ্ছন্দ দেখে দ্বিতীয় ইনিংসে তাঁকে তিন নম্বরে পাঠানোর সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলেছেন কোচ-অধিনায়ক। সেই সিদ্ধান্তের ফসল লক্ষ্মণের মহাকাব্যিক ২৮১। তিন থেকে ছয়ে নেমে যাওয়া রাহুল দ্রাবিড় যোগ্য সঙ্গত করায় ভারতের অভাবনীয় এক জয়।  

এখানে বাংলাদেশের জয়ের প্রশ্ন আসেইনি। তবে প্রথম ইনিংসে সর্বোচ্চ ৩৩ রানে ফলো অন বাঁচানোর সম্ভাবনা জাগিয়ে শেষ ব্যাটসম্যান হিসেবে আউট হওয়া সাকিব আল হাসানকে কি ওই কম্পমান টপ অর্ডারের কারও বদলে উপরে তুলে দেওয়া যেত না? কিন্তু বাংলাদেশ দলে এই চিন্তাটা করবেন কে? ভিন্ন কিছু ভাবার বদলে সবাই তো মুখস্থ বিদ্যার মতো গৎবাঁধা চিন্তাতেই বাঁধা পড়ে আছেন। যে কারণে সাকিব সেই সাত নম্বরেই নেমেছেন এবং একটা সময় অবধারিতভাবেই উইকেটে টেল এন্ডারদের উপস্থিতি তাঁকে আর স্বাভাবিক ব্যাটিং করতে দেয়নি। সাকিবকে আগে পাঠালেই যে বাংলাদেশ ম্যাচ বাঁচিয়ে ফেলত, এর কোনো গ্যারান্টি কেউই দিতে পারেন না। তবে ভিন্ন কিছু চেষ্টার প্রতিফলন তো অন্তত দেখা যেত।

সাকিবকে দ্বিতীয় ইনিংসে আগে নামানোর চিন্তাটা কেন কারও মাথায় এলো না! ছবি: বিসিবি

সেটিকে ধন্য আশা কুহকিনী বানিয়ে বাংলাদেশ সেই মুখস্থ বিদ্যাই অনুসরণ করে যাওয়ায় দ্বিতীয় ইনিংসে যা একটু প্রতিরোধ, তার শুরু ২৫ রানে ৪ উইকেট পড়ে যাওয়ার পর। প্রথমে মুশফিক-লিটন, এরপর লিটন-সাকিব, কিছুক্ষণ সাকিব-মিরাজ। যে বাবর আজম এই টেস্টের আগে কখনো বোলিংই করেননি, তিনিই কিনা টেস্টের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ব্রেক থ্রুটার নায়ক। মিরাজের আউটেই তো মোটামুটি নিশ্চিত হয়ে যায়, আলোর স্বল্পতা ছাড়া এই টেস্টে বাংলাদেশের বাঁচার আর কোনো উপায় নেই। কিন্তু ঢাকার আকাশ যে টানা চার দিন গোমড়া মুখ আর কান্নাকাটি শেষে এদিন হাসিখুশি রূপে দেখা দিয়েছে। তারপরও পড়ন্ত বিকেলের মরে আসা আলো আগের দিনের মতো পেসারদের শুধুই ফিল্ডার বানিয়ে স্পিনময় করে দিয়েছিল বোলিং আক্রমণকে। এতে যে কিছু আসে যায় না, আগের দিন ব্যাটসম্যানদের অকাতর সহায়তাকে কাজে লাগিয়ে সাজিদ খানই তা প্রমাণ করে দিয়েছেন। 

সকালে বাকি তিন উইকেটের দুটিই তুলে নিয়ে ৪২ রানে তাঁর ৮ উইকেট। এর আগে বাংলাদেশের এক ইনিংসে ৮ উইকেট নিতে পেরেছেন একজন বোলারই। তবে সেজন্য স্টুয়ার্ট ম্যাকগিলকে খরচ করতে হয়েছিল ১০৮ রান। ২০০৬ সালে ফতুল্লায় বাংলাদেশের জন্য সেই আফসোসের টেস্ট ম্যাচের প্রথম ইনিংসে ম্যাকগিলের ৮ উইকেটের চেয়ে অস্ট্রেলিয়ার আরেক লেগ স্পিনারের ১১২ রান দিয়েও উইকেটশূন্য থাকা সম্ভবত আরও আরও বড় বিস্ময়ের। ওই লেগ স্পিনারকে যে সবাই শেন ওয়ার্ন নামে ডাকে।

মিরাজকে আউট করে বাবর আজমের একমাত্র আন্তর্জাতিক উইকেটটাকে এই টেস্টের ফলাফল নির্ধারক বলে মনে হতে পারে, তবে আসল টার্নিং পয়েন্ট তো মুশফিকের রান আউট। ক্রিকেটের নতুন আইনে ব্যাট একবার ক্রিজ ছুঁয়ে ফেলার পর শূন্যে উঠে গেলেও ব্যাটসম্যানের আর রান আউটের ভয় নেই। মুশফিকের দুর্ভাগ্য যে, তাঁর ব্যাট শূন্যে থেকেই ক্রিজ পেরিয়েছে।

দুর্ভাগ্য বলছি বটে, কিন্তু আসল প্রশ্ন তো অন্য। চা বিরতির মিনিট কয়েক আগে অমন ঝুঁকি নিয়ে ওই রানটা নিতে গেলেন কেন? আগের দিন বিকেলে মুমিনুলের রান আউটটি নিয়ে যে প্রশ্নটা আরও উচ্চকিত। যা বলে দিচ্ছে, সমস্যাটা শুধু ব্যাটিং-বোলিংয়ে নয়, মাথায়ও!

ব্যাটিং লাইন আপের যেমন, তেমনি শরীরেরও।

শেয়ার করুনঃ
আপনার মন্তব্য
আরও পড়ুন
×