বিশ্বকাপ জিতেই ছাড়ল ইউনুসের পাকিস্তান

উৎপল শুভ্র

২৭ জানুয়ারি ২০২১

বিশ্বকাপ জিতেই ছাড়ল ইউনুসের পাকিস্তান

ট্রফি নিয়ে পাকিস্তান দল। টুর্নামেন্ট শুরুর আগে এই ছবি কেউ কল্পনাও করেনি

কনফেত্তি উড়ল। এর আগে চারপাশ থেকে আগুন আর ধোঁয়া। তাতে কি পাকিস্তান ক্রিকেট দলের প্রতীকী উপস্থাপনাও! পাকিস্তানের ক্রিকেট মানেই তো অনিশ্চয়তার ধোঁয়া। পাকিস্তানের ক্রিকেট মানেই তো কেউ যখন কল্পনাও করেনি, তখন আগুনের মতো জ্বলে ওঠা। টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপের দ্বিতীয় আসর হয়ে থাকল সেই চির রহস্যময়-রোমাঞ্চকর পাকিস্তানি ক্রিকেটের আরেকটি গল্প।

প্রথম প্রকাশ: ২৩ জুন, ২০০৯। প্রথম আলো।

টুর্নামেন্টের শুরুতে পাকিস্তান নিয়ে কী ভবিষ্যদ্বাণী করেছিলেন, তা ভেবে লজ্জা পাওয়ার দরকার নেই। ইউনুস খান নিজেই তো ভাবেননি!

নিজেদের দেশে অনেক দিন আন্তর্জাতিক ক্রিকেট নেই, সামনে ঘোর অনিশ্চিত ভবিষ্যত্, আইপিএলেও খেলতে পারেনি কেউ—মরচে পড়ে যাওয়া ব্যাট আর বলের এক দলের অধিনায়ক। এ কথা বলা তাই খুবই স্বাভাবিক ছিল যে, ‘সেমিফাইনাল খেলতে পারলেই ভাবব, আমরা দারুণ কিছু করেছি।’

কাল ইংলিশ গ্রীষ্মের রোদ-ঝলমলে অপূর্ব এক বিকেলে সেই ইউনুস খানের হাতেই বিশ্বকাপ। কনফেত্তি উড়ল। এর আগে চারপাশ থেকে আগুন আর ধোঁয়া। তাতে কি পাকিস্তান ক্রিকেট দলের প্রতীকী উপস্থাপনাও!

পাকিস্তানের ক্রিকেট মানেই তো অনিশ্চয়তার ধোঁয়া। পাকিস্তানের ক্রিকেট মানেই তো কেউ যখন কল্পনাও করেনি, তখন আগুনের মতো জ্বলে ওঠা। টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপের দ্বিতীয় আসর হয়ে থাকল সেই চির রহস্যময়-রোমাঞ্চকর পাকিস্তানি ক্রিকেটের আরেকটি গল্প। 

গতবার ভারতের বিপক্ষে ফাইনালে তীরের কিনারে গিয়ে তরী ডুবিয়েছিলেন মিসবাহ-উল হক। এবার সেটির প্রায়শ্চিত্ত করবেন কি, সেমিফাইনালের মতো ফাইনালেও যে বেচারা ব্যাট করতে নামারই সুযোগ পেলেন না! এই দুই ম্যাচের পাকিস্তান এমনই দুর্দম্য যে, ব্যাটিং শক্তির সামান্যই কাজে লাগাতে হলো তাদের।

কীভাবে এমন ভোজবাজির মতো বদলে গেল পাকিস্তান? পাকিস্তান তো এমনই—হ্যাঁ, এটা একটা ব্যাখ্যা বটে। তবে এখানে বোধহয় আরও কিছু ছিল। খেলা যখন নিছক খেলার সীমানা ছাড়িয়ে জীবনের প্রেক্ষাপট নিয়ে দাঁড়িয়ে যায়; তখন আসলে প্রতিপক্ষ কে, তাতে আর কিছু আসে-যায় না! গৃহযুদ্ধে জ্বলছে পাকিস্তান, জ্বলছে ইউনুসের নিজের শহর মারদান—পাকিস্তানের কাছে কালকের ফাইনাল ছিল তাই উদ্বাস্তু হাজারো মানুষের মুখে হাসি ফোটানোর উপলক্ষ। এই পাকিস্তানকে কীভাবে ঠেকাবে শ্রীলঙ্কা!

করাচিই তাঁর ঠিকানা, তার পরও শরীরে বইতে থাকা পাঠান রক্তে তো জ্বলন্ত পেশোয়ার, খাইবার-পাসের জ্বালা। দক্ষিণ আফ্রিকার পর শ্রীলঙ্কাকেও পুড়িয়ে মেরে সেই জ্বালা জুড়ালেন শহীদ আফ্রিদি। অধারাবাহিকতা যাঁর নামের প্রতিশব্দ, সেই তিনিই আসল দুই ম্যাচে আশ্চর্য ধারাবাহিক। বোলিংয়ে ৪ ওভারে মাত্র ২০ রান দিয়ে ১ উইকেটের পর ৪০ বলে অপরাজিত ৫৪ রান করে ফাইনালেরও নায়ক।

যেভাবে হিসাব করে খেলে, যখন প্রয়োজন শুধু তখনই চার-ছয় মেরে দক্ষ পাইলটের মতো দলকে জয়ের রানওয়েতে নামালেন, সেই আফ্রিদিকে কি ক্রিকেট বিশ্ব দেখেছে আগে!

ওয়ানডেতে যাঁর ব্যাটে ৩৭ বলে সেঞ্চুরি আসতে পারে, তাঁর পক্ষে সবকিছুই সম্ভব। কিন্তু কালকের আফ্রিদিকে যে ‘অসম্ভব’ বলেই জানতেন সবাই। যেভাবে হিসাব করে খেলে, যখন প্রয়োজন শুধু তখনই চার-ছয় মেরে দক্ষ পাইলটের মতো দলকে জয়ের রানওয়েতে নামালেন, সেই আফ্রিদিকে কি ক্রিকেট বিশ্ব দেখেছে আগে! জয়সূচক রানটি আসার পর উইকেটের পাশে দুহাত শূন্যে তুলে মূর্তির মতো দাঁড়িয়ে গেলেন। এই টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপের সবচেয়ে বিখ্যাত ছবিও বোধহয় হয়ে গেল এটিই।

শ্রীলঙ্কা দলের জন্য এই বিশ্বকাপে দু রকম অভ্যর্থনাই ছিল। গ্যালারিতে ছিলেন সমর্থকেরা, আর বেশির ভাগ ম্যাচেই মাঠের বাইরে তামিল বিক্ষোভ মিছিল। কালও লর্ডসে শ্রীলঙ্কান টিম বাসকে স্বাগত জানাল ব্যানার-প্ল্যাকার্ড হাতে বিক্ষুব্ধ প্রবাসী শ্রীলঙ্কান তামিলরা। মুহুর্মুহু স্লোগানও উঠল, যাতে শ্রীলঙ্কা ক্রিকেট দলকে পর্যন্ত ‘সন্ত্রাসী’ বানিয়ে দেওয়া হলো। টসে জিতে প্রথমে ব্যাটিং করতে নামা শ্রীলঙ্কার সাড়ে পাঁচ ওভারের মধ্যে ৪ উইকেটে ৩২ হয়ে যাওয়ার সঙ্গে এর যোগসূত্র খুঁজতে চাইলে অবশ্য কুমার সাঙ্গাকারাই সবচেয়ে বড় আপত্তিটা করবেন।

তা করার মুখও আছে তাঁর। ফাইনালটাকে টি-টোয়েন্টি ম্যাচের কলঙ্ক হওয়ার হাত থেকে বলতে গেলে একাই বাঁচালেন শ্রীলঙ্কান অধিনায়ক। ৫২ বলে অপরাজিত ৬৪—১৩ ওভার শেষে ৬ উইকেটে ৭০ হয়ে যাওয়ার পর এক অ্যাঞ্জেলো ম্যাথুসই যা একটু সঙ্গ দিলেন তাঁকে। এর আগেই তো শ্রীলঙ্কান ইনিংস রীতিমতো ধ্বংসস্তূপ।

ক্রিকেটে আজকের রাজা যে কালকের ফকির—আবারও তা প্রমাণ করে টুর্নামেন্ট মাতিয়ে রাখা তিলকরত্নে দিলশান আসল সময়ে মারলেন গোল্লা। প্রথম চার বলে রান না নিতে পারার পর পঞ্চম বলে আউট!

সাঙ্গাকারা-ম্যাথুসের কল্যাণে শেষ ৫ ওভারে ৫৯ রান তুলল শ্রীলঙ্কা, কিন্তু পাওয়ার প্লের ৬ ওভারেই ৪ উইকেট হারিয়ে ফেলার ধাক্কা সামলানোর জন্য সেটিও যে যথেষ্ট নয়। যথেষ্ট হতে পারত পাকিস্তানের ব্যাটিংয়ে পাগলামি ভর করলে।

কিন্তু কালকের পাকিস্তান যে ব্যতিক্রমী, লক্ষ্যে অবিচল সুস্থির এক দল। তরুণ শাহজাইবের সঙ্গে ৭ ওভারে কামরান আকমলের ৪৮ রানের উদ্বোধনী জুটিটিই পাকিস্তানি ইনিংসকে জয়ের রাজপথে তুলে দিয়েছিল। এই ৪৮-এর ৩৭-ই আকমলের ব্যাট থেকে, সেটিও মাত্র ২৮ বলে। মেন্ডিসকে নিয়ে যে ভয় ছিল, তৃতীয় বলেই তাঁকে ছক্কা মেরে তা অনেকটাই দূর করে দিলেন। ১৫ রানের মধ্যে দুই ওপেনারের বিদায়ের পর আফ্রিদি-মালিকের ৫৭ বলে ৭৬ রানের জুটিতে ৮ বল বাকি থাকতেই ম্যাচ শেষ।

পাকিস্তানের বিশ্বকাপ জয়টাকে যদি চমক বলেন, ইউনুস খানের ঘোষণাটাকে কী বলবেন? টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপ জেতার পরই যে জয়ী অধিনায়ক আন্তর্জাতিক টি-টোয়েন্টি থেকে অবসরের ঘোষণা দিয়ে ফেললেন!

সম্পর্কিত বিষয়:

শেয়ার করুনঃ
আপনার মন্তব্য
আরও পড়ুন
×